বৈদান্তিক আচার্যরা বলেন ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন মানেই মানুষের অন্তর্নিহিত ভক্তির প্রকাশ সাধন। যে ভক্তি সে খুঁজছে তা তার ভিতরেই আছে। মানুষ জন্ম থেকেই ভগবানকে ভালবাসে, ভগবানকে চায়। জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে ঠিকপথে বা ভুলপথে চলে সে সেই সর্বোচ্চ, মহত্তম ঈশ্বরকেই চায়। অবশেষে সে বুঝতে পারে তার প্রেমাস্পদকে খোঁজা তখনই শেষ হবে যখন সে ভালবাসার সর্বশ্রেষ্ঠ পাত্র সেই এক অদ্বিতীয় মহত্তমকে পাবে। দুটি শ্রেষ্ঠ বা দুটি উচ্চতম বস্তু হতে পারে না। উচ্চ বা উচ্চতর বস্তু হাজার হাজার হতে পারে; ভাল, অধিকতর ভাল শয়ে শয়ে থাকতে পারে; কিন্তু উচ্চতম বা শ্রেষ্ঠ একটিই হয়; আর এটি খুঁজে বের করাই হল মানবজীবনের অভীষ্ট লক্ষ্য। এখানে, সেখানে সর্বত্র আমরা ঐটি আবিষ্কারের চেষ্টা করছি। ভক্ত তাই বলেন, “হে প্রভু, এ জগতে সম্পদের অন্বেষণে গিয়ে পরম সম্পদ তোমায় পেয়েছি। এ জগতে ভালবাসার পাত্র খুঁজতে গিয়ে পরম প্রেমাস্পদ তোমায় পেয়েছি। তোমার শ্রীপাদপদ্ম ছাড়া আর কোথায় আশ্রয় নেব বল। তুমিই আমার পরম আশ্রয়, আমার যথাসর্বস্ব।” আমরা যথার্থ ভালবাসার পাত্র খুঁজছি—যাকে সবচেয়ে বেশি ভালবাসতে পারি। জীবনের যাত্রাপথে অনেক মিষ্টি অনেক তেতো বড়ি গিলে শেষে অনুসন্ধানকারী বুঝতে পারে তার এই প্রেমাস্পদের সন্ধান শেষ হবে তখনই যখন সে পূর্ণ এক পরম প্রেমাস্পদের সন্ধান পাবে। মানব-হৃদয় এই সর্বশ্রেষ্ঠকে পাবার জন্যই তৈরী হয়েছে। এর কমে মানুষ কিছুতেই তৃপ্ত হতে পারে না। এই অন্তর্দৃষ্টি সহায়ে আমাদের আধ্যাত্মিক ভাব গভীরতর হয়, আমাদের ঈশ্বরানুসন্ধান তীব্রতর হয়, আমাদের প্রার্থনা একাগ্র হয়। একটি বা দুটি ভাব আমাদের অধ্যাত্মজীবনের মূলসুর হয়। শ্রীরামকৃষ্ণ কী বালসুলভ সরলতার সঙ্গে ব্যাকুলভাবে জগজ্জননীর কাছে প্রার্থনা করতেন তা উদ্ধৃত করব। আপনার ভক্তি থাকলে তবেই ভগবানের ধ্যান করা আপনার পক্ষে সম্ভব হবে। গভীর ধ্যান হলে ভগবদ্দর্শন হবে, আর ভগবদ্দর্শন হলে দেখবেন আপনিও ভগবানে অধিষ্ঠিত। তিনি অস্তিত্বের পূর্ণরূপ।
জগজ্জননীকে সম্বোধন করে শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেন— “ও মা, তোমার কৃপার উপর আমি নির্ভর করছি; তোমার শ্রীপাদপদ্মে শরণ নিয়েছি। দেহসুখ চাই না, মা; নাম-যশ চাই না, মা; অষ্টসিদ্ধি চাই না, মা। কৃপা কর, মা। তোমার পাদপদ্মে যেন শুদ্ধাভক্তি হয়। নিষ্কাম, অহৈতুকী ভক্তি দাও, মা। ভালবাসার জন্যই যেন ভালবাসতে পারি।” “ও মা, তোমার জগৎ বিমোহিনী মায়ায় যেন মুগ্ধ না হই, এই জগতে যেন আসক্ত না হই। তোমার সম্মোহিনী মায়ার সৃষ্টি কামিনী-কাঞ্চনে যেন আসক্ত না হই। ও মা, তুমি বই আমার আর আপন কেউ নাই। কেমন করে পূজা করতে হয় জানি না, মা। আমি ভজনহীন, সাধনহীন, ভক্তিহীন, জ্ঞানহীন। কৃপা কর মা, তোমার অপার করুণায় আমার যেন তোমার পাদপদ্মে ভক্তি হয়।”
স্বামী সৎপ্রকাশানন্দের ‘ধ্যান সাধনা সিদ্ধি’ থেকে