অর্জুন বলিলেন—হে ভগবন্, আমার প্রতি অনুগ্রহ করিয়া অতিগুহ্য পুরুষার্থপ্রদ আত্মানাত্ম-বিবেকবিষয়ক যে অধ্যাত্ম-তত্ত্ব আপনি বলিলেন, তাহার দ্বারা আমার এই (আত্মার কর্তৃত্বাদিশূন্য স্বরূপের আবরক) মোহ দূর হইয়াছে। হে পদ্মপলাশলোচন, ভূতগণের উৎপত্তি ও প্রলয় আপনা হইতে হয় এবং আপনার নিরুপাধিক ও সোপাধিক সর্বাত্মত্বাদিরূপ অক্ষয় মাহাত্ম্য বিস্তৃতভাবেই আপনার নিকট শ্রবণ করিলাম। হে পরমেশ্বর, আপনি যে আত্মতত্ত্ব বলিয়াছেন, তাহা যথার্থ। তথাপি হে পুরুষোত্তম, আপনার জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য ও তেজঃসমন্বিত ঈশ্বরীয় বিশ্বরূপ সাক্ষাৎ করিতে আমি ইচ্ছা করি। হে প্রভো, যদি আমি সেই বিশ্বরূপ দেখিবার যোগ্য হই, তাহা হইলে হে যোগেশ্বর, আমাকে আপনার অব্যয় জগদাত্মরূপ দেখান।
শ্রীভগবান্ বলিলেন—হে পার্থ, নানা বর্ণ ও নানা আকৃতি বিশিষ্ট শত শত এবং সহস্র সহস্র আমার বিভিন্ন দিব্যমূর্তি দর্শন কর। হে ভারত, দ্বাদশ আদিত্য, অষ্ট বসু, একাদশ রুদ্র, অশ্বিনীকুমারদ্বয় এবং ঊনপঞ্চাশ বায়ু দর্শন কর এবং অদৃষ্টপূর্ব অদ্ভূত বস্তুও আমার বিশ্বরূপে দর্শন কর। হে অর্জুন, আমার এই বিরাট শরীরে অবয়বরূপে একত্র অবস্থিত সমগ্র স্থাবরজঙ্গমাত্মক বিশ্ব এবং অন্য যাহা কিছু দেখিতে ইচ্ছা কর, তাহা আজ দর্শন কর। তুমি নিজের প্রাকৃত স্থূল চক্ষু দ্বারা আমার বিশ্বরূপ দর্শন করিতে সমর্থ হইবে না। তোমাকে অপ্রাকৃত জ্ঞানচক্ষু দিতেছি। উহার দ্বারা আমার অঘটনঘটনসামর্থ্যরূপ যোগ-শক্তি দর্শন কর।
সঞ্জয় বলিলেন—হে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মহান্ যোগেশ্বর ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ এইরূপ বলিয়া অর্জুনকে নিজের অলৌকিক বিশ্বরূপ দেখাইলেন। সেই বিশ্বরূপ অনেক মুখ ও অনেক নেত্র-যুক্ত, অনেক অদ্ভূত আকৃতি ও অসংখ্য দিব্য-অলঙ্কার-বিশিষ্ট এবং অনেক উদ্যত দিব্য আয়ুধে সজ্জিত। উক্ত বিশ্বরূপ দিব্যমাল্য ও দিব্য বস্ত্রে ভূষিত, দিব্য গন্ধ দ্বারা অনুলিপ্ত, অত্যন্ত আশ্চর্যজনক, জ্যোতির্ময়, অনন্ত ও সর্বত্র মুখবিশিষ্ট। যদি আকাশে সহস্র সূর্যের প্রভা যুগপৎ সমুদিত হয়, তাহা হইলে সেই দীপ্তি বিশ্বরূপের প্রভার কিঞ্চিৎ তুল্য হইতে পারে। তখন অর্জুন সেই দেবদেবের বিরাট শরীরে দেব, পিতৃ, মনুষ্যাদি নানাভাবে বিভক্ত সমগ্র জগৎ অবয়বরূপে একত্র অবস্থিত দেখিলেন। অর্জুন সেই বিশ্বরূপ দর্শন করিয়া আশ্চর্যান্বিত ও রোমাঞ্চিত হইলেন এবং অবনত মস্তকে বিশ্বরূপধারী ভগবানকে প্রণাম করিয়া করজোড়ে বলিলেন—।
অর্জুন বলিলেন—হে দেব, আপনার এই বিশ্বরূপে সমস্ত দেবতা, চরাচর জগৎ, বশিষ্ঠাদি ঋষিগণ, বাসুকি প্রভৃতি সর্পসমূহ ও পৃথিবীপদ্মের মেরুকর্ণিকাসনে অবস্থিত সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মাকে দেখিতেছি। হে বিশ্বেশ্বর, সর্বত্র বহু বাহু, বহু উদর, বহু মুখ ও বহু নেত্র-বিশিষ্ট আপনার বিরাট মূর্তি দেখিতেছি। হে বিশ্বরূপ, আমি আপনার আদি, মধ্য ও অন্ত দেখিতেছি না। কিরীট, গদা ও চক্রধারী, সর্বত্র দীপ্তিমান, তেজঃপুঞ্জস্বরূপ, দুর্নিরীক্ষ্য, প্রদীপ্ত অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় প্রভাবিশিষ্ট এবং অপ্রমেয়স্বরূপ আপনাকে আমি সর্বত্র দেখিতেছি। আপনি পরব্রহ্ম এবং একমাত্র জ্ঞাতব্য। আপনি বিশ্বের পরম আশ্রয় ও সনাতন ধর্মের রক্ষক।
‘শ্রীমদ্ভগবদ্ গীতা’র বিশ্বরূপদর্শনযোগ থেকে