কালী বললে শুধু কি দেবী? ভারতের সেই নারীর কথাও কি মনে পড়ে না যাঁর জন্ম আগুন থেকে আর যাঁর জীবন কেটে যায় যুদ্ধের আগুন, প্রতিজ্ঞার আগুনে? তিনি কৃষ্ণা। তিনি দ্রৌপদী। চিরাচরিত যে শিষ্ট অবনতমস্তকা নারীমূর্তিকে ভারতের পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ঘরে বাইরে স্থাপন করতে চেয়েছে, তার বিপরীত মুখে দাঁড়িয়ে থাকেন এই নারী। তেজে গুণে যিনি অনন্যা। ব্যক্তিত্বে যিনি অপ্রতিরোধ্য। দুঃশাসনের ‘মলেস্টেশন’ এবং ‘অ্যাটেম্পট টু রেপ’ নামে দু’টি আধুনিক শব্দ দিয়ে ব্যাখ্যাকারী পরিস্থিতির মুখে দাঁড়িয়ে তিনি ভরা রাজসভায় প্রশ্ন তোলেন ধৃতরাষ্ট্রর কাছে— যুধিষ্ঠির যদি নিজে জুয়া খেলায় হেরে যাওয়ার পর দ্রৌপদীকে বাজি রাখেন সেই বাজি রাখা কি আদৌ বৈধ? এবং এই প্রশ্নের উত্তর কেউই দেননি বা দিতে পারেননি। সেদিনের ভয়ানক লাঞ্ছনার উত্তরে এই তেজস্বিনী বলেছিলেন, যতদিন না দুঃশাসনের রক্তে স্নান করবেন, ততদিন কেশ পরিচর্চা করবেন না। রূপচর্চা নয়, রাজভোগ নয়, প্রতিজ্ঞাতেই তিনি যেন শক্তিরূপিণী কালী। মা কালী তখন এক নির্দিষ্ট দেবী নয়, নারীশক্তির প্রতিমূর্তি হয়ে প্রতিভাত হন।
মা দুর্গার অসুরদলনী রূপ সর্বগ্রাহ্য হলেও সেই রূপে যেন যুদ্ধের তিক্ততা নেই, নেই তাতে একক বিদ্রোহ কিংবা পুরুষতন্ত্র নস্যাৎ করার তেজ। দুর্গার লড়াইয়ের পরতে পরতে থাকে শিবের ভরসা এবং অন্য দেবতাদের আশীর্বাদ। অবলম্বনও তাঁদের দেওয়া অস্ত্র।
কিন্তু মা কালী কেমন? পুরাণ মতে, তিনি দশমহাবিদ্যার এক মহাবিদ্যা। শাক্তরা আদ্যাশক্তি মনে করেন। তাঁর চার হাত। ডান দিকে দু’হাতে খটাঙ্গ ও চন্দ্রহাস। এবং বাঁ দিকে দু’হাতে চর্ম ও পাশ। গলায় নরমুণ্ড, দেহে ব্যাঘ্রচর্ম। বড় বড় দাঁত, রক্তচক্ষু, বিস্তৃত মুখ, স্থূলকর্ণ। বাহন কবন্ধ। তবে বিষ্ণু ধর্মোত্তরে ভদ্রকালী শান্ত ও সুন্দর। কিন্তু লোকবিশ্বাসে বাঙালিদের কালীপুজোয় কিংবা কালী-চেতনায় এই দেবীর ভয়ঙ্কর রূপ মিলেমিশে আছে অদ্ভুতভাবে। শিবের বুকে দণ্ডায়মান, হাতে নরমুণ্ড নিয়ে এই কালী। এই মূর্তির আদল কি ভারতের জনজীবনে নারীর কাছে অনুসরণযোগ্য হয়েছে? শান্ত, সৌম্য রূপের বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা এই ‘অদেবীসুলভতার’ জন্যই কি তাঁর প্রতি লোকের ভক্তি বেড়েছে? নাকি ভীতিপ্রদ এই রূপ মানুষকে ভয়জাত ভক্তিতে নত করেছে?
ভারতের মতো দেশ বিপ্লবী নারীদের নায়িকা হিসেবে বা সার্বিকভাবে গ্রহণযোগ্যা করে তুলতে পারেনি। ব্যক্তিগতভাবে লেখক কবিদের প্রচেষ্টা থাকলেও বিপ্লবী নারীদের দল হয়ে আছে একঘরে। নায়িকা মানেই তাঁরা দেবীর মতো ক্ষমাশীলা এবং গৌরবর্ণা। দ্রৌপদীর উদাহরণ সামনে থাকলেও বিপ্লবী নায়িকারা প্রায় হাতে গোনা। সাহিত্যে এবং জীবনেও।
আঠারো শতকে পূর্ববঙ্গের মেয়ে ছিলেন বৈজয়ন্তী দেবী। ফরিদপুরের খানুকা গ্রামে তাঁর জন্ম। পণ্ডিত ছিলেন দর্শন ধর্মশাস্ত্রে। অর্থাৎ যে সময়ে মেয়েরা অক্ষরজ্ঞানেরই সুযোগ পাচ্ছে না, সেই সময়ে তিনি প্রসিদ্ধ হয়েছিলেন পাণ্ডিত্যে। কিন্তু তাঁর রূপ ছিল না। অসুন্দর হওয়ার কারণে তিনি স্বামীর কাছে ত্যাজ্য হয়েছিলেন। পরবর্তীকালে সংস্কৃত শ্লোকে রচিত তাঁর পত্রে তাঁর কবিত্বশক্তির পরিচয় পেয়ে স্বামী তাঁকে নিজগৃহে নিয়ে যান। স্বামীর সঙ্গে মিলিতভাবে ‘আনন্দলতিকা’ নামে এক কাব্য রচনা করেন। মনে পড়ে যায়, এই সময়ের হটি এবং হটু বিদ্যালঙ্কারের কথাও। হটু তৎকালীন সমাজে দাঁড়িয়েও আজীবন বিবাহ করেননি। মস্তক মুণ্ডন করে মাথায় শিখা রেখে পুরুষের জীবন যাপন করতেন। রূপচর্চা আর সুন্দর হওয়ার পিছনে না দৌড়ে নিঃশব্দ বিপ্লব ঘটানো নারীদের আদৌ কি স্বীকৃতি দিয়েছে ভারতের ইতিহাস, বাংলার ইতিহাস?
এই প্রশ্ন একদা উত্তর প্রজন্ম তুলবে ভেবেই যেন তৈরি হয়েছিল ‘শান্তি’ চরিত্রটি। বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠ’-এর শান্তি যেন যুগকাল অতিক্রমকারী সেই বিপ্লবী নারী, যাঁদের অস্তিত্ব বাস্তবেই লাখে এক এবং সাহিত্যে তো বটেই।
‘শান্তি’কে সৃষ্টির প্রেক্ষাপটেও ছিল বাংলার সেই অশান্ত সময়—ছিয়াত্তরের মন্বন্তর, আর তার ফলে উদ্ভূত সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। মাতৃহীন শান্তি পিতার টোলের ছাত্রদের সঙ্গে খেলাধুলো করে বড় হয়েছিল। ফলে নারীসুলভ সজ্জা বা লজ্জা কোনওটাই তার গড়ে ওঠেনি। সে পরবর্তীকালে জীবানন্দের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলেও তার পুরুষসুলভতা ঘুচল না। ফলে শ্বশুরবাড়ি থেকে সে বিতাড়িত হল। জীবনান্দ সন্ন্যাস দলে যোগ দিলে পরবর্তীকালে শান্তিও তাতে যোগ দিল পুরুষ সেজে।
না, শুধু ছলে নয়, বলেও সে পুরুষদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ছিল। সে অনায়াসে ইস্পাতের ধনুকে লোহার তারের গুণ দিয়ে সত্যানন্দকে বিস্মিত করে দেয়। সে নিজের ভূমিকা স্পষ্ট করে বলে, সে জীবানন্দের সঙ্গে দাম্পত্য কাটানোর জন্যে এখানে আসেনি। সে শুধু এসেছে জীবানন্দের দক্ষিণ হস্তে বল বাড়ানোর জন্যে।
এমনকী ক্যাপ্টেন টমাসের অধীনে ইংরেজের ফৌজ এলে সে টমাসের সঙ্গে বাগযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। টমাস তাকে ‘রেবেল’ বলে গুলি করতে গেলে সে টমাসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার বন্দুক কেড়ে নেয়। মনে পড়ে যায় বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দেবী চৌধুরাণী’র কথাও। সে নেতৃত্ব দেয় এক যুদ্ধবাহিনীর। স্বদেশি ডাকাত দলের। ভবানী পাঠকের নির্দেশে তৈরি হয় এই নেত্রী। রাজবেশ থেকে সাধারণ বেশ, দুই-ই থাকে তার সেই প্রস্তুতিপ্রকল্পে। রূপচর্চা নয়, শরীরচর্চা এবং মানসিক জোরের চর্চা, এই-ই ছিল লড়াইয়ের মূল মন্ত্র। এহেন শান্তি কিন্তু ‘আনন্দমঠ’-এর ‘নায়িকা’ হয়ে ওঠেনি। ‘দেবী চৌধুরাণী’-র নায়িকাও প্রফুল্ল। দেবীর ইমেজ খুলে শ্বশুরঘরের পুকুরঘাটে সে বাসন মাজতে বসে! বঙ্কিমচন্দ্রের এই পশ্চাদপসরণ কি নারীর শিষ্ট মূর্তি দিয়ে পাঠকের মনোহরণ করার তাগিদে?
এই শিষ্টতার তোয়াক্কা করেন না মা কালী। মার্কণ্ডেয় পুরাণে চণ্ড-মুণ্ডের সঙ্গে যুদ্ধের সময়ে দুর্গার ভ্রূকুটিকুটিল মুখ থেকে বিনির্গতা দেবী কালী। বামন পুরাণে বলা হয়, নমুচি নিহত হওয়ার পর নমুচির দুই ভাই শুম্ভ নিশুম্ভ ত্রিলোক অধিকার করেন। এদের সেনাপতি ধূম্রলোচন নিহত হওয়ার পর চণ্ড মুণ্ড যুদ্ধে আসে এবং এই সময় ক্রুদ্ধ দেবীর মুখ থেকে কালীর আবির্ভাব। অর্থাৎ ক্রোধই কালীর জন্মরহস্য। যে পবিত্র ক্রোধ বিপ্লবের জন্ম দেয়, যে রাগ অন্যায়ের ধ্বংস সাধন করে, সেই ক্রোধ তৈরি করে কালীকে। কিন্তু তাঁর রূপের ভয়াবহতা, তাঁর আপাত মাধুর্যহীনতা, তাঁর খরতা তাঁকে আরাধ্য করে তোলে ঠিকই, কিন্তু ততটা প্রিয় কি করে তোলে?
আজকের ভারত জুড়ে নারী পুরুষ কি কালীকে অনুসরণযোগ্য মনে করেন? ডাকাতদের কালী ভজনার কারণ ও সাধারণ গৃহস্থের মা কালীর প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তির হেতু মিলেমিশে যেতে পারে কি? নাকি শ্মশানে পূজিতা এই দেবী ‘তামসিকতার দেবী’ মাত্রই হয়েই থাকেন? অশুভ শক্তি বিনাশে শক্তির আরাধনাকে কি আমরা বাস্তবে রূপায়িত করতে পারি না?
‘কালী’ নাম কেন তাঁর? সে কি তিনি শুধুই ‘কালো’ বলে? তাঁর নামে তো মহাকালেরও ইশারা। দূরদূরান্ত অবধি দর্শন তাঁর। তাঁকে আরাধনা তো সেই কালেরও আরাধনা। তাঁকে পাওয়ার পথ কঠিন তপস্যার। সবাই যে তাঁকে আত্মস্থ করতে পারে না। সাধক রামপ্রসাদ তাঁর গানে ইঙ্গিত দেন সেই পথের—
‘আয় মন বেড়াতে যাবি/কালী কল্পতরুমূলে রে মন,/চারি ফল কুড়ায়ে পাবি।
প্রবৃত্তি-নিবৃত্তি জায়া/(তার) নিবৃত্তিরে সঙ্গে লবি/বিবেক নামে তার পুত্র/তত্ত্ব কথা তায় সুধাবি। /শুচি-অশুচিরে লয়ে/ দিব্য ঘরে কবে শুবি,/ যখন দুই সতীনে পিরিত হবে/ তখন শ্যামা মাকে পাবি।’
কালী সাধনার এই বিবেকই আমাদের মনে পড়ায় প্রায় দশ বছর আগে পশ্চিমবঙ্গের এক সাধারণ গ্রাম কামদুনিতে ঘটে যাওয়া এক ধর্ষণ। যেখানে এক নিরীহ কলেজ ছাত্রীকে নির্জন রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মমভাবে ধর্ষণ করা হয়। রজঃস্বলা মেয়েটি ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় দুর্বৃত্তদের অত্যাচারে। কী নিদারুণভাবে মনে পড়ে যায় দুঃশাসন যখন চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে একবস্ত্রা দ্রৌপদীকে ভরা রাজসভায় এনেছিল অন্তঃপুর থেকে, তখন দ্রৌপদীও ছিল রজঃস্বলা। হাতজোড় করে দ্রৌপদী প্রার্থনা করেছিল সেদিন এই অবমাননা না ঘটাতে। দুঃশাসন শোনেনি। সেদিন কৃষ্ণের দাক্ষিণ্যে লজ্জা রক্ষা হয়েছিল কৃষ্ণার। মহাভারতকার ব্যাসদেব জিতিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কৃষ্ণাকে। কিন্তু কামদুনির মেয়েটির পাশে সেদিন ঈশ্বর ছিল না, ছিলেন না কোনও ব্যাসদেব। মেয়েটির রক্তাক্ত দুই উরু ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। কিন্তু অবাক লাগে এখানেই, সেদিনের দুঃশাসনরা চিহ্নিত হলেও এখনও আইনের ফাঁকতালে সাজাপ্রাপ্ত নন! অথচ তাঁরা সবাই বন্দি।
নাহ্, তবে এখানেই গল্প শেষ হয় না। প্রতিবাদ ওঠে, উঠতেই থাকবে। দিল্লির বুকে ঘটে যাওয়া আর এক বীভৎস ধর্ষণের শিকার নির্ভয়ার সঙ্গে মিলে যান কামদুনির প্রতিবাদীরাও। সবাই বাহ্যত নয়, সবাই রাজনীতির ছত্রছায়াতেও নয়, কিন্তু মনে মনে পথ হাঁটে গোটা ভারত। এই পথ হাঁটা যত জোরদার হবে, তত কালীর আরাধনা হয়ে উঠবে যথাযথ। মনে রাখতে হবে কালীও কিন্তু ‘মা’। মাতৃত্বকে স্নেহময়ী আখ্যা দিয়ে আমরা তার আনুষ্ঠানিক উদ্যাপন যত করি, তার সিকিভাগ উদ্যাপনও করি না মাতৃত্বের রুদ্ররূপের বেলায়। পুরুষতন্ত্র যেভাবে ‘মা’ দেখতে শিখিয়েছে, আমরা শুধু তাতেই স্বচ্ছন্দ হয়েছি। বিবসনা এই মা কালী নির্ভান। তাঁর বাইরের সাজ পোশাকের দরকার নেই। নরমুণ্ডই তাঁর অলঙ্কার।
আমরাও কি পারি না যাবতীয় অকারণ সাজসজ্জা মুখোশ, ভান সব খুলে রেখে অন্যায়ের প্রতিবাদে অন্তরের শক্তির সাধনায় জেগে উঠতে? এই রুদ্ররূপিনী মাকে আরাধনা করতে?
নাহলে যে সত্যিই কাল চলে যাবে, কালীপুজো এক সামাজিক উৎসবমাত্র হয়ে অনুষ্ঠিত হবে, অন্তরের জাগরণ আর হবে না।