কথায় বলে, ‘একা বোকা’। কিন্তু একা থেকে বুদ্ধিমানের মতো জীবন কাটানোও সহজ। দরকার শুধু কিছু পরিকল্পনা আর হিসেব কষে সিদ্ধান্ত নেওয়া। যেসব মেয়ের একার সংসার, তিনিও হতে পারেন লক্ষ্মীমন্ত। সংসার সামলানোর কিছু জরুরি টিপস জানলেই কেল্লা ফতে। লিখছেন মনীষা মুখোপাধ্যায়।
বাংলা ভাষার ভারি মজা! ব্যঙ্গ বিদ্রুপের জন্যও সেখানে তৈরি কিছু প্রবাদ প্রবচন। কথায় বলে ‘হাতে পায়ে লক্ষ্মী’, যার বিস্তারিত অর্থ মোটেই স্বস্তিদায়ক নয়। হাত ও পা যাবতীয় বিপদ ও আকখুটেপনার জন্য দায়ী হলে, দামাল দস্যিপনার জন্য ভাঙচুর ও ক্ষয়ক্ষতির কারণ হলে সেই মেয়ের ‘হাতে পায়ে লক্ষ্মী’ বলে গাল পাড়া হয়। এবার তেমন কোনও মেয়ে যখন একা থাকতে শুরু করে, সেই লক্ষ্মীশ্রীর ছাপ পড়ে তার যাবতীয় কর্মকাণ্ডে। আবার শান্তশিষ্ট কোনও মেয়েও হয়তো একা হাতে সংসার সামলাতে গিয়ে নাজেহাল হচ্ছে রোজ! বাজারের ট্রে-তে আনাজ ঢালতে ঢালতে হয়তো তেল পুড়ে গেল, সারাদিন হা ক্লান্ত থাকার পর একটু বিছানায় গা এলিয়েই মনে পড়ল, এব্বাবা! আজ তো পাড়ায় একটা জরুরি মিটিং ছিল! সারাদিন কাজের চাপে মনেই পড়েনি। কিংবা চাকরি আর ঘর সামলানোর মাঝেই এসএমএস এল প্রিমিয়াম বা কেওয়াইসি দেওয়ার দিন পেরিয়ে গিয়েছে গতকাল! এবার লাগবে বাড়তি জরিমানা। একদিক সামলাতে গিয়ে বেরিয়ে পড়ছে অন্যদিকের হা হতোস্মি দশা!
একা থাকা মেয়েদের এসব বেশ পরিচিত ছবি। নিজে একা মানুষ হলে যাও বা কিছু কিছু বিষয় জোড়াতালি দিয়ে চলে যায়, সঙ্গে সন্তান থাকলে সেই একা মায়েদের হতে হয় আরও অনেক সচেতন। কোথাও কোনও কাজে ফাঁক রাখার জো থাকে না। তাই একা থাকলে অথই জলে পড়েন অনেক মেয়েই। কারওকে আবার পেশাসূত্রে বাড়ি থেকে দূরে গিয়ে একাই সাজাতে হয় একার সংসার। কেউ আবার একা থাকতে পছন্দ করেন বলেই একাকী জীবন বেছে নেন। কারও ক্ষেত্রে আবার নিয়তিই একা থাকার বন্দোবস্ত করে রাখে। কারণ যা-ই হোক, একটু বুঝে ও হিসেব কষে চললে একার সংসারেও সবকিছুই থাকবে হাতের মুঠোয়। একাই একশো মেয়ের সংসারে বসত করবে লক্ষ্মীর শ্রীরূপ।
আসলে একা থাকার কোনও মেড ইজি হয় না। নেই কোনও সমাজের বটিকা মেশানো সাজেশন। এই সিলেবাসের পুরোটাই পরিস্থিতি ও পরিবেশ নির্ভর। জীবনের গতিপথ অনুযায়ী এর দাবি বদলে বদলে যায়। সেই অনুসারে প্রতিক্রিয়া জানাতে পারাই ‘একা লক্ষ্মী’-র পাশ মার্ক।
তাই একা থাকার পরিসরে কিছু ফর্মুলা জানা থাকলে ঘর-বার সামলানো মেয়েটির জীবন আরও সহজ ও ঝঞ্ঝাটহীন হতে পারে। রইল তেমন কিছু ছোট ছোট উপায়ের সুলুকসন্ধান।
আপদকালীন হিসেব
একা থাকলে কিছু ক্ষেত্র আলাদা করে মাথায় রাখতে হয়। যেমন, একা থাকলে কিন্তু অসুখবিসুখে প্রাথমিক অবস্থায় কারও সাহায্য মিলবে না। তাই দরকারি প্রেসক্রিপশন, বিশেষ কিছু ওষুধপত্র বাড়িতে মজুত রাখুন। পারিবারিক চিকিৎসক, নিকটবর্তী অ্যাম্বুলেন্স পরিষেবা ও হাসপাতালের নম্বর হাতের কাছে মজুত রাখুন।
বিশ্বস্ত কোনও প্রতিবেশী বা আত্মীয়কে নিজের চিকিৎসকের নম্বর ও ওষুধপত্রের বিষয়ে জানিয়ে রাখুন।
নিজের প্রয়োজনীয় নথি একটা ব্যাগে ভরে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখুন। হারিয়ে গেলে খুঁজে দেওয়ার জন্য কারও সাহায্য পাবেন না ধরেই পরিকল্পনা করতে হবে।
সদ্য একা থাকতে শুরু করেছেন এমন মেয়েদের কাজের বোঝাও বেড়ে যায় অনেক। হাতের কাছে এক কাপ চা ধরার মানুষও থাকে না। তাই ব্যস্ততা সামাল দিতে প্রতিদিনের কাজের একটা রুটিন বানিয়ে রাখুন। সাপ্তাহিক দরকারি কাজগুলো একজায়গায় লিখে সাপ্তাহিক রুটিনও বানাতে পারেন। এতে নিজের কাজ সময়ে শেষ করার একটা নিয়ম তৈরি করা যাবে।
নিজের বাড়ির ডুপ্লিকেট চাবিটি বিশ্বস্ত কোনও প্রতিবেশীর কাছে রাখুন। এতে আপনার অবর্তমানে বাড়িতে হঠাৎ কোনও বিপদ ঘটলে এঁরা বাড়ির ভিতরে ঢুকতে পারবেন।
এ তো গেল কিছু আপদকালীন ব্যবস্থা। একা থাকলে দৈনিক কাজেও আনতে হবে বাড়তি গতি। জানতে হবে সময় বাঁচানোর ফিকির।
পাক ও পাকস্থলী
খরচ করার সামর্থ থাকলে রান্নার জন্য কোনও গৃহকার্যে সহায়ক ব্যক্তিকে বহাল করতে পারেন।
একা মানুষের রান্নার জন্য আলাদা করে কারও সাহায্য নিতে না চাইলে ভরসা করতে হবে নিজের উপরেই। সেক্ষেত্রে বাজার দোকান যাওয়ার পাঠ রোজ রাখবেন না। সপ্তাহে দু’দিন বাজার গিয়ে অনেকটা সবজি, মাছ, মাংস কিনে রাখুন। দোকানের বিষয়ে মাসকাবারি ব্যবস্থা করুন। এতে সময় বাঁচবে। নিত্য দোকান বাজার ছুটতে হবে না।
দোকান-বাজারের সময় আরও কিছুটা কমিয়ে দিতে পারেন কোনও কোনও অনলাইন অ্যাপের সাহায্যে। আজকাল ঘরে বসেই বাজার দোকান করার নানা অ্যাপ আছে। সেখানে অ্যাকাউন্ট
খুলে ফেলুন।
রান্না করতে ও একা হাতে সবটা সামলাতে অসুবিধা হচ্ছে মনে হলে খাওয়াদাওয়ার ভার দিতে পারেন কোনও হোম সার্ভিসকে। আজকাল অনেকেই সারা মাসের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কোনও না কোনও হোম সার্ভিসে করেন।
মাঝেসাঝে স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে অনলাইনে পছন্দের রেস্তরাঁ থেকে খাবার কেনা যেতে পারে। তবে নিত্য এমন ব্যবস্থা করা আর্থিক দিক থেকে খুব একটা সাশ্রয়ী নয়। তার চেয়ে হোম সার্ভিস অনেক বেশি সুবিধাজনক। এতে বাজার দোকানের খরচ, গ্যাসখরচ, সময় ও শ্রম সবই বাঁচে।
নিজে রান্না করলে ইউ টিউবের সাহায্য নিতে পারেন। রান্নার কিছু জরুরি টিপস শিখতেও এই সাইট খুব সাহায্য করবে।
রান্নাবান্না মজুত রাখতে ও কাজ দ্রুত সারতে অন্তত ছোট একটা ফ্রিজ, ইন্ডাকশন ও মাইক্রো আভেন কিনে নিন।
কাচার ঝঞ্ঝাট
একা মানুষ হলে সব কাজ একাই সামলাতে হবে। তাই মেশিনকে সঙ্গে নিন। একার জন্য ছোট আকারের ওয়াশিং মেশিন যথেষ্ট। সেটুকু সম্ভব না হলে নিকটবর্তী কোনও লন্ড্রির সঙ্গে যোগাযোগ করুন। নিয়ম করে সেখানে জামাকাপড় পৌঁছে দেওয়ার কাজটি কিন্তু আপনাকে করতে হবে। জামার বোতাম লাগানো, ছোটখাট সেলাফোঁড়াই এগুলো শিখে নিন।
জরুরি পরিষেবা
বিছানার চাদর কাচা থেকে বাড়ি পরিষ্কারের যাবতীয় খুঁটিনাটির জন্য সপ্তাহে একটা বেলা বরাদ্দ রাখুন। নিজে হাতে সবটা সামলে নিতে চাইলে এটুকু সময় বের করতেই হবে। নইলে কোনও অ্যাপ থেকে সাহায্য নিতে পারেন। শহরাঞ্চলে ঘরদোর পরিষ্কারের লোকজন পাওয়া যায় নানা অ্যাপ থেকে।
একা হাতে সবটা সারতে চাইলে নিত্য কাজ সারার সময় বাড়ির আবর্জনা, কুটনো ইত্যাদি রাখার জন্য ছোট ছোট গার্বেজ ব্যাগ ব্যবহার করুন। দিনের শেষে ফেলে দিতে পারেন পঞ্চায়েত বা পুরসভা দ্বারা নির্ধারিত বালতিতে।
সন্তান সঙ্গে থাকলে তার পড়াশোনা ও স্কুল যাতায়াতের ব্যবস্থাও নিজেকেই করতে হবে। সেক্ষেত্রে স্কুলবাস, পুলকার এগুলোর সাহায্য নিন। নিজের হাতে সময় কম থাকলে পড়াশোনায় সাহায্য করতে পারেন কোনও দক্ষ গৃহশিক্ষকের উপর ভরসা করুন।
ঘর যত অগোছালো হোক না কেন, নিজেকেই তা ঠিকঠাক করতে হবে। তাই ছোটখাট কাজগুলো সেরে রাখুন। জায়গার জিনিস জায়গায় রাখুন। বাসন মাজা বা ঘর ঝাড়ামোছার জন্য গৃহসহায়কের সাহায্য নিলে কাজ অনেক দ্রুত ও নিয়মমাফিক সামলাতে পারবেন।
ব্যাঙ্কের কাগজপত্র, বাচ্চার স্কুলের বেতন দেওয়ার দিনক্ষণ, ফিক্সড ডিপোজিট ম্যাচিওরিটির দিন, প্রিমিয়াম দেওয়ার তারিখ বা অন্য কোনও জরুরি কাজের জন্য রিমাইন্ডার সেট করে রাখুন। প্রিয়জনদের জন্মদিন, বিবাহবার্ষিকী ইত্যাদি মনে রাখতেও রিমাইন্ডার আপনাকে সাহায্য করবে।
কাছের কিছু বন্ধু ও আত্মীয়দের সঙ্গে ঘন ঘন যোগাযোগ রাখুন। যে কোনও প্রয়োজনে ও বিপদে পাশে পাবেন তাঁদের।
শেষ কথা
একা থাকার জন্য সবচেয়ে বেশি যা প্রয়োজন, তা মনের জোর ও সাহস। নির্ঝঞ্ঝাট, কৈফিয়তহীন জীবন যেমন এই যাপনের উপহার, তেমন সব বিপদ একা সামাল দেওয়া, যে কোনও
পরিস্থিতির একা সম্মুখীন হওয়া এই যাপনের বাড়তি চাপ। সেই চাপ সামলে নিতে পারার ক্ষমতা ও মনের জোর থাকলে তবেই একা থাকার সিদ্ধান্ত নিন। নইলে সারাদিনের সঙ্গী ও হাতে হাতে কাজকর্ম করার জন্য কোনও সহায়ককে নিয়োগ করতে পারেন। কোনও আত্মীয়কে নিয়ে থাকতে পারলে বিশ্বাস ও আস্থার পাল্লা আরও ভারী হয়।