আমরা মেয়েরা

নীরবতা যখন বাঙ্ময়

ভারতে মহিলা মূকাভিনয় শিল্পীর সংখ্যা হাতে গোনা। কৃষ্ণা দত্ত তাঁদের মধ্যে অন্যতম। একসময় প্রায় ভুলতে বসা এই শিল্পকে বর্তমান সময়ের আঙ্গিকে সাজিয়ে শিল্পের গরিমা ফেরাতে চান তিনি। আলোচনায় অন্বেষা দত্ত।

গত ৩৩ বছর ধরে অভিনয়ের ভাষায় ‘নীরব’ থেকেও তিনি অত্যন্ত বাঙ্ময়। কারণ মূকাভিনয় শিল্পী কৃষ্ণা দত্ত তাঁর শিল্পকে নিজের গণ্ডিতে আটকে রাখেননি। মঞ্চ থেকে তাঁর শিল্প ছড়িয়ে গিয়েছে বহু শিশুর মননে। জন্মগতভাবে মূক ও বধির শিশুদের মুখে এখনও ভাষা জুগিয়ে চলেছেন তিনি।   
মূকাভিনয় শিল্পী হওয়ার আগে কৃষ্ণা ছিলেন বাচিক নাট্যশিল্পী। প্রথম মঞ্চে পদার্পণ ধ্রুব চরিত্র দিয়ে, বিসর্জন নাটকে। ছোটখাট এমন অনেক কাজই চলছিল। বাকি বাঙালি শিশুর মতো ‘ডাকঘর’-এর অমল হওয়া সেইভাবেই। তাঁর দাদু হাতির পিঠে চেপে অভিনয় করতেন। তাই বলেন, রক্তেই তো অভিনয়। বাবা-কাকা অবশ্য শখে অভিনয় করতেন। মা অর্গ্যান বাজিয়ে গান গাইতেন। রাইফেল শ্যুটারও ছিলেন। তাই এই মায়ের মেয়েকে অভিনয় করতেই হতো। সেই নিয়মেই অভিনয়ের সঙ্গে কৃষ্ণার বেড়ে ওঠা। ১৮-২৫ বছর বয়সিদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের সংস্কৃতি মন্ত্রকের একটা ন্যাশনাল স্কলারশিপ হয় অভিনয়ে, সেটি পেয়েছিলেন। কিন্তু অভিনয়ের পথটা একটু বদলাল। বাচিক অভিনয় থেকে মূকাভিনয়। কেন এই পথ পরিবর্তন? কৃষ্ণা জানালেন, অভিনয় করতে করতে জেনেছিলেন নাটকে অনেক মুহূর্ত আসে যখন বাঙ্ময়তা তুলে ধরতে প্রয়োজন হয় নৈঃশব্দ্যের। থিয়েটারের মঞ্চ তাঁকে শিখিয়েছিল সেই পাঠ। যখন আলো কমে নরম হয়, শব্দ হারিয়ে যায়। দরকার শুধু নীরব অভিনয়। তখন তাঁর মনে হয়েছিল মূকাভিনয়ের কথা। মূকাভিনয়ের অন্যতম পথিকৃৎ যোগেশ দত্তের কাছেই কৃষ্ণার হাতেখড়ি। যোগেশ নাকি তাঁকে বলতেন, বড় মেয়ে। সেই শিক্ষার সঙ্গে কৃষ্ণার মনে জুড়ে গিয়েছিল জীবন থেকে পাওয়া সব অভিজ্ঞতাও। ২০১৬ সালে পেয়েছেন ইন্দিরা গান্ধী লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার। প্রথাগত পড়াশোনার পাশাপাশি রবীন্দ্রভারতী থেকে নাটক নিয়ে পড়াশোনা করেছেন।
 মেয়েদের মূকাভিনয়ে আসার অনুপাতটা কেমন? কৃষ্ণা জানালেন, তাঁর সময়ে সেভাবে একা কেউ এই চর্চায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন, মনে পড়ে না। প্রখ্যাত শিল্পী আস্তাদ দেবুর সঙ্গে জারিন চৌধুরি কোরিওগ্রাফির মাধ্যমে সাইলেন্ট অ্যাক্টিং বা নীরব অভিনয় করতেন। সে অর্থে মূকাভিনয়ে প্রথম একক মহিলা শিল্পী কৃষ্ণাই। যোগেশ দত্তের কাছে আরও অনেক মেয়েই শিখতেন, দলবদ্ধভাবে কাজ করতেন তাঁরা। কৃষ্ণার কথায়, ‘তাঁদের একক করতে দেখিনি কাউকে।’ 
১৯৯১ সালে তৈরি হল তাঁর দল, ‘কলকাতা অনুভব’। তার আগের বছর থেকে কৃষ্ণা সক্রিয়ভাবে মূকাভিনয় করা শুরু করে দিয়েছেন। কিন্তু একক মূকাভিনয় করব ভাবলেই তো আর করা যায় না। মেয়ে হয়ে মূকাভিনয় করার ক্ষেত্রে বেশ কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তাঁকে। শুধুমাত্র মেয়ে বলেই একটা পারফর্মিং আর্ট-এ পোশাক নিয়ে আপত্তি ওঠে। বিদেশে হয়তো নয়, কিন্তু এদেশে, আমাদের সমাজের দেখার চোখ সেই প্রশ্ন তুলে দেয়। কেন অমন আঁটসাট পোশাক পরে মূকাভিনয় করবেন তিনি, এ প্রশ্ন শুনতে শুনতেই শিল্পী হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হয়েছে তাঁকে। সমাজের বাইরের লোক তো বটেই, কখনও কখনও আঙুল উঠেছে পরিবারের অন্দরেও। রাত করে ফিরলে স্বামীকে প্রশ্নের মুখে পড়তে হয় না, কিন্তু স্ত্রী ফিরলে প্রশ্ন ওঠে। যুগ বদলালেও প্রশ্ন থেকে যায় কোথাও না কোথাও। তবে শিল্পের প্রতি টান আর ঘরে-বাইরে সমালোচনা— দুইয়ের লড়াই চালাতে চালাতে অনুপ্রেরণা দেওয়ার লোককেও পাশে পেয়েছেন কৃষ্ণা। অভিনেত্রী সরযূ দেবী (উত্তমকুমার অভিনয়ের আগে যাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতেন) কৃষ্ণাকে একসময় বলেছিলেন, ‘পিঠে কুলো আর কানে তুলো, এইভাবে এগিয়ে যা। তোরা আধুনিক মেয়ে। তোরা পারবি।’ এই সাহসের পরশটুকু আজীবন লালন করেছেন তিনি। 
আর্ট ফর্মেও মেয়েদের পোশাক নিয়ে মানুষের যখন এতই মাথাব্যথা, তখন পোশাককে একটু এদিক ওদিক করে নেওয়া যাক না হয়, একদিন ভেবেছিলেন কৃষ্ণা। কোমরের কাছ থেকে দিয়ে দেওয়া যাক একটু ফ্রিল, যাতে দেহাবয়বে একটা ব্রেক আসে অথচ শিল্পের ক্ষতি হয় না। পোশাকের এই সামান্য অদলবদলে শিল্পের প্রতি ভালোবাসায় টান পড়ল না। লোকের মুখের কথাতেও দাড়ি পড়ল। দর্শকও ইতিবাচকভাবেই নিল এই পরিবর্তন, যন্ত্রণার যাত্রা স্মরণ করতে করতে বলছিলেন শিল্পী।   
এখন তিনি মূক ও বধির শিশুদের নানাভাবে সাহায্য করেন। তাদের থেরাপির সাহায্যে উন্নত করেন। এই প্রশিক্ষণের শুরুও জীবনবোধ থেকেই। জন্মগত মূক ও বধির শিশুর মায়ের যন্ত্রণা তিনি দেখেছেন। সন্তান ঘিরে সেই মায়ের ‘লজ্জা’ও তাঁকে ছুঁয়ে গিয়েছে। তাঁর কাছে প্রশিক্ষণে আসা শিশুর মা বলছেন, আপনি ওকে নাম জিজ্ঞেস করবেন না, ও কথা বলতে পারে না। কৃষ্ণার মনে হয়েছিল, মায়ের কষ্ট তো দেখতে হবে বটেই, এই শিশুদেরও একটা জায়গা দিতে হবে। যৌনকর্মীদের শিশু, পথশিশু বা অন্য কোনওভাবে পরিত্যক্ত মহিলা বা শিশুকেও এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিনি উন্নয়নের পথ দেখিয়েছেন। প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ নেননি। উল্টে সুযোগ খুঁজেছেন এই শিশুরা বা মেয়েরা সেই প্রশিক্ষণকে যাতে কাজে লাগাতে পারে তেমন একটা প্ল্যাটফর্ম করে দেওয়ার। 
হঠাৎ স্মৃতিমেদুর শিল্পী বলে ওঠেন, ‘জানেন, একবার হঠাৎ বাসে একটি মেয়ে আমার কামিজ ধরে টানছিল। প্রথমে বুঝতে পারিনি কেন। তারপর মেয়েটি সাংকেতিক ভাষায় বলল আমার দেওয়া টাকায় ওর নিজের আর খুদে শিশুকন্যার জামা তৈরি করেছে।’ কিছুই নয়, তবু এই সামান্য প্রাপ্তিতেই মন ভবে ওঠে কৃষ্ণার। কোনও এক কালে সেই মূক ও বধির মেয়েটিকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন তিনি। ফিরে পাওয়া বলতে এইটুকুই।
কৃষ্ণার কন্যা বিজয়া দত্তও মায়ের প্রশিক্ষণেই বড় হয়েছেন। এই কাজটিকে আরও আধুনিকভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে আগ্রহী তিনি। মা বলেন, ‘মেয়ে যখন দশ বছরের ছিল তখন হাতে টাইটেল কার্ড ধরিয়ে মঞ্চে নামিয়ে দিয়েছিলাম। আমাদের অভিনয়ের মাঝে ও এভাবেই ঢুকে পড়েছিল ও। টাইটেল কার্ড নিয়ে ঢুকত, আলো পড়ত ওর উপরে। এইভাবে শুরু। আমার কাছেই প্রশিক্ষণ। ও নিজে ওড়িশি নৃত্যও শিখেছে।’ মেয়েকে প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছেন, মেয়ে শিল্পের অনুরাগী হয়েছে এটা কৃষ্ণার কাছে বড় গর্বের, জানাতে ভোলেন না সে কথা। 
এই সূত্র থেকে মা মেয়ে মিলে মাইম বা মূকাভিনয়ের সঙ্গে মিশিয়ে দিলেন ওড়িশি নৃত্য এবং ছৌ। এই তিন আর্ট ফর্ম মিলল প্রথম কৃষ্ণাদেরই হাত ধরে। এই প্রোডাকশন খুবই সাড়া পেয়েছিল। একটা সময়ের পর মানুষের হাতে বিনোদনের এত উপকরণ এসে গিয়েছে যে কৃষ্ণাও বুঝেছেন শুধু মূকাভিনয় দিয়ে মানুষকে ধরে রাখা যাবে না। তাই সময়ের দাবি মেনে নানা ফিউশন করছেন তাঁরা। এতে লোকের মন ছুঁতে পারছেন। এভাবে তাঁদের মনে হয়েছে বাচিক অভিনয়ের সঙ্গে তো মূকাভিনয়ের কোনও বিরোধ নেই। দুই আর্ট ফর্মকে মেলানো যায়। কিছুটা দর্শকের ভাবনার খোরাকও দেওয়া গেল আর কিছুটা শিল্পী নিজে বাচনভঙ্গির সাহায্যে তাঁদের মাথায় ধরিয়ে দিলেন। কৃষ্ণার কথায়, ‘এটাও একটা স্তর। অর্থাৎ ধরা যাক, বাচিক দিয়ে শুরু হল। তারপর এমন একটা মুহূর্ত তৈরি করা হল, যেখান থেকে মূকাভিনয়ের পরিসর তৈরি হবে। এবার সেটা থেকে মূকাভিনয় শুরু হল। এটা খুবই সাম্প্রতিক পরীক্ষা আমাদের। সাড়া পাচ্ছি। দর্শকের বুঝতেও অসুবিধা হচ্ছে না।’ এই পরীক্ষা করার আগে নিজেকে আয়নার সামনে ফেলে দেখলেন, এটা করা যায় কিনা। নিজে পরিতৃপ্ত হওয়ার পরেই তবেই প্রোডাকশনে মন দিলেন।
কনটেন্ট হিসেবে তাঁর মনের কাছাকাছি কোন বিষয়গুলো? কৃষ্ণা বললেন, ‘নারী হয়ে নারীকেন্দ্রিক বিষয় যে বেশি প্রিয় হবে সেটাই তো স্বাভাবিক। নারীমনের যন্ত্রণা, তার না পাওয়া, ক্ষোভ, অভিমান। তার উপরে হওয়া নির্যাতন, সবসময়েই এগুলো বিষয় হিসেবে নাড়া দিয়েছে। এখন সরকারি নানা প্রকল্প হচ্ছে নারী সহায়তায়। আগে তো এতটা ছিল না। আমার প্রোডাকশন ‘নারী জাগরণ’, ‘অচ্ছুৎ কন্যা’ প্রিয়। একটা মেয়ে নির্যাতিত হয়ে কীভাবে আবার ফিরে আসে তার গল্প। ওড়িশায় আমি দেখেছি এমন মেয়েদের। পিঠে বাচ্চাদের নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। এই মেয়েদের ঠিকাদার বা তাঁর সঙ্গীরা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলে যান। বিয়ে হয় না, অথচ অন্তঃসত্ত্বা হয়ে তাঁর সংগ্রামের নতুন অধ্যায় শুরু হয়। এই ধরনের লড়াইয়ের গল্প এখনও গ্রামে মেয়েদের মন ছোঁয়। সন্তানকে বড় করা, ঠিকাদারের বিরুধে প্রতিশোধ নেওয়া— এই পথগুলো তাঁদের ভাবায়।’  
  এই সময়ের ছেলেমেয়েরা মূকাভিনয় নিয়ে কতটা আগ্রহী? একটু দীর্ঘশ্বাসের এক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে কৃষ্ণা উত্তর দেন, ‘সেই ধরনের আগ্রহ একটা সময় ছিল না। এটা ঠিকই। টিভি সিরিয়ালের বাজার যত উন্নত হয়েছে তত এদিকে টান পড়েছে। কিন্তু এটাও ঠিক এই প্রজন্ম বুঝেছে এই প্রশিক্ষণের দাম কতটা। কারণ ক্যামেরার সামনে অভিনয়ের ক্ষেত্রেও এই প্রশিক্ষণ একটা প্লাস পয়েন্ট। এটা প্রাণপণে চেষ্টা করেছি নতুন প্রজন্মকে বোঝাতে। ওরা যখন গ্ল্যামারের দিকে চলে যেতে চাইছে, তখন আমি কিন্তু বাধা দিইনি। কারণ বাধা দিলে ওদের আগ্রহ আরওই চলে যেত। বরং বুঝিয়েছি কেন এই শিক্ষাটারও প্রয়োজন আছে। ওরা বুঝেছে। এটা আমার পাওয়া। মাইম কীভাবে অভিনয়ের পূর্ণ শিক্ষায় কাজে লাগে, সেটা বুঝেছে। টিভি বাদে যেটুকু সময় হাতে থাকে, সেটা এখানে দেয়। আক্ষেপের সঙ্গে বলতে হয়, মাঝে সত্যিই মূকাভিনয় নিয়ে মানুষের আগ্রহ চলে গিয়েছিল। গ্রামে তবু এসব নেয় মানুষ। শহরেই বেশি অনাগ্রহ। আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র বাংলাদেশেও এর কদর। বিদেশে তো রয়েইছে। আমাদের এখানে গ্রামের মানুষ নিজের জীবনের সঙ্গে এখনও এর টান খুঁজে পান। মনে পড়ে গ্রামে কেউ কেউ গায়ে-মুখে হাত দিয়ে দেখত! ভাবত আমি বোধহয় সারাদিন এসবই করি। রংচং তুলে দিনের শেষে আমায় সংসারে ঢুকতে হয়, জেনে তারা অবাক হতো।’ সংসারে ফিরে স্ত্রী-মা-দিদিমার দায়িত্ব পালন করেও নীরবতার কাছে আসন পেতেছেন কৃষ্ণা। তাঁর প্রাণের আরাম যে সেখানেই।
14Months ago
কলকাতা
রাজ্য
দেশ
বিদেশ
খেলা
বিনোদন
ব্ল্যাকবোর্ড
শরীর ও স্বাস্থ্য
বিশেষ নিবন্ধ
সিনেমা
প্রচ্ছদ নিবন্ধ
আজকের দিনে
রাশিফল ও প্রতিকার
ভাস্কর বন্দ্যোপাধ্যায়
mesh

মরশুমি রোগের ভোগান্তিতে স্বাস্থ্যহানির যোগ প্রবল। কাজকর্মে কিছুটা আলস্য ভাব আসতে পারে। বিদ্যায় উন্নতির যোগ।...

বিশদ...

এখনকার দর
ক্রয়মূল্যবিক্রয়মূল্য
ডলার৮৩.৮৩ টাকা৮৫.৫৭ টাকা
পাউন্ড১০৬.১২ টাকা১০৯.৮৭ টাকা
ইউরো৮৭.৯০ টাকা৯১.২৭ টাকা
[ স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া থেকে পাওয়া দর ]
*১০ লক্ষ টাকা কম লেনদেনের ক্ষেত্রে
দিন পঞ্জিকা