পোষ্য প্রশিক্ষণ। এই কাজে এতদিন পুরুষই ছিল একচেটিয়া। ক্রমশ মহিলারাও কাজটি আয়ত্তে এনে ফেলেছেন। পোষ্যদের পাশাপাশি সিকিওরিটি ডগ ট্রেনিংয়ের কাজও করছেন তাঁরা। কয়েকজন মহিলা পশু-প্রশিক্ষকের সঙ্গে কথা বললেন কমলিনী চক্রবর্তী।
আর্থার কোনান ডয়েল রচিত গোয়েন্দা শার্লক হোমস একবার সহকারী ওয়াটসনকে বলেছিলেন, ‘পরিবারে শান্তি আছে কি না তা সেই বাড়ির কুকুরের আচরণ দেখেই বোঝা যায়। হাসিখুশি পরিবারে অপ্রসন্ন কুকুর দেখেছ কখনও?’ হোমসের এই উপলব্ধি ‘মিস্ট্রি অব দ্য ক্রিপিং ম্যান’-এর রহস্য সমাধানে সহায়ক হয়েছিল। এই সারসত্যটাই আবার একেবারে ভিন্নভাবে সত্য হয়ে উঠেছে জয়শ্রী রাম মোহনের জীবনে। জয়শ্রী গোয়েন্দা নন, তিনি অ্যানিমাল ট্রেনার। বাড়ির পোষ্যদের পোষ মানানোর কায়দাটি তাঁর নখদর্পণে। আর সেই কাজ করতে গিয়েই জয়শ্রী দেখেছেন বাড়ির পরিবেশ হাসিখুশি হওয়া বা না হওয়ার উপর কুকুর বেড়ালের আচরণ ও ভাবভঙ্গি শতকরা একশোভাগ নির্ভর করে। সেই কারণেই কলকাতার এই কন্যাটি পোষ্যদের পাশাপাশি পালকদেরও প্রশিক্ষণ দেন।
জয়শ্রীর কথা
ছোট থেকেই পশুপ্রেমী ২৬ বছরের জয়শ্রী রাম মোহন। রাস্তাঘাটে কুকুর, বেড়াল তো বটেই এমনকী পাখির পরিচর্যাও ছিল তার নেশা। সেখান থেকেই এই পেশার কথা ভাবনায় আসে তাঁর। তাঁর কথায়, ‘আমাদের দেশে পোষ্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যাপারে পালকদের সচেতনতা খুবই কম। সেই কারণেই কুকুরও এখানে অকারণ চিৎকার করে, তেড়ে যায়— এগুলো সবই প্রশিক্ষণের অভাব। ফলত মানুষের একটা ভয় জন্মায় তাদের প্রতি। এমনটা কিন্তু বিদেশে হয় না। পোষ্যদের প্রশিক্ষণ নিয়ে আরও ভালোভাবে জানার জন্যই এই বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করি। তারপর প্র্যাকটিকাল ধারণা সঞ্চয় করতে গিয়ে দেখলাম আমাদের দেশের লোকেরা পোষ্যদের বড় করার ব্যাপারে একেবারেই নভিস। সেই সংক্রান্ত জ্ঞান যে নেওয়া যেতে পারে, সেই ধারণাও তাদের নেই। তাই কুকুর বেড়ালকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার আগে বরং পালকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া দরকার।’ এই ধারণা থেকেই ‘বিহেভিয়েরাল থেরাপি’ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন জয়শ্রী। তারপর অ্যানিমাল ট্রেনিংকে পেশা হিসেবে নেন। ‘আমাদের দেশে এই পেশাটি অল্প পরিচিত তো বটেই, এবং ট্রেনাররা অধিকাংশই পুরুষ। সম্প্রতি হাতে গোনা কয়েকজন মহিলা এই পেশায় এসেছেন। আর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন পদ্ধতিগত কিছু বদল,’ বললেন জয়শ্রী। তাঁর মতে, মহিলাদের ট্রেনিংয়ের মধ্যে একটা সুললিত ব্যাপার থাকে যেটা এর আগে ছিল না। ফলে পোষ্যদের প্রশিক্ষণের দুটো ধরন, ওল্ড স্কুল এবং মডার্ন থেরাপি। জয়শ্রী এই মডার্ন থেরাপি মতে প্রশিক্ষণ দেন। সেই নিয়ম অনুযায়ী পোষ্যদের পাশাপাশি পালকদেরও কয়েকটি জিনিস শেখানো হয়। আমাদের দেশে অনেকেই ঝোঁকের বশে কুকুর পোষেন। তাঁরা কুকুরটিকে খেলনার মতো ব্যবহার করেন। নিজের খেয়ালে আদর করেন না হলে তাকে আপনমনে থাকতে বাধ্য করেন। এর ফলে শিশু কুকুরের মনে চাপ পড়ে। তারা রাগী হয়ে যায়। একটা কুকুরের বাচ্চাকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সময় জয়শ্রী প্রথমেই কিছু জিনিস খেয়াল করেন, সে অযথা তেড়ে আসছে কি না, লোক দেখলে সে চিৎকার করছে কি না, কেউ ভালোবেসে আদর করতে গেলে তাকে কামড়াতে যাচ্ছে কি না, বাড়িতে অতিথি এলে তার অপছন্দ হচ্ছে কি না। এই বিষয়গুলোর উপরেই পশু ও পালককের প্রশিক্ষণ নির্ভর করে। জয়শ্রী বললেন, ‘কুকুর কিন্তু স্বভাবে মিশুকে। ফলে লোক দেখলে তেড়ে যাওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও যদি এমনটা হয়, তাহলে বুঝতে হবে তার অযত্নের ভয় আছে মনে। সেই কারণেই বাড়িতে বাইরের লোক দেখলে সে ভাবে তাকে আরও অযত্ন করা হবে। এবং সে তাদের দিকে তেড়ে যায়। অযথা চিৎকারের ক্ষেত্রে আবার দুটো জিনিস খেয়াল করতে হবে। অনেক কুকুর লেজ নাড়তে নাড়তে চেঁচায়। সেক্ষেত্রে সে অ্যাটেনশন চাইছে বলেই চেঁচাচ্ছে। এমন অবস্থায় একটু গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে সে আবার চুপ করে যাবে। কিন্তু বডি ল্যাঙ্গুয়েজে যদি একটু হিংস্রভাব থাকে তাহলে সাবধান হতে হবে। সেই ক্ষেত্রে তাকে প্রশিক্ষণও দিতে হবে।’ কুকুর একটু আদরপ্রিয়। পালক যদি আদর করে তাকে কাছে রাখে, তার সঙ্গে খেলা করে, তাকে নিয়ে নিয়ম করে বেড়াতে যায় তাহলে কোনও সমস্যাই হয় না, বললেন জয়শ্রী। তাছাড়া মানুষের বাচ্চাকে যেমন ভালোবেসে, হেসে খেলে মানুষ করতে হয় কুকুরের বাচ্চাকেও তেমনই করা উচিত। এটা অনেকেই জানেন না বা জানলেও মনে রাখেন না। আর সেখানেই সমস্যা দেখা দেয়। কিন্তু শুধুই কি পশুপ্রেম নাকি জয়শ্রীর অ্যানিমাল ট্রেনার হয়ে ওঠার পিছনে অন্য কোনও কারণও ছিল? তাঁর কথায়, ‘মূলত দুটো কারণে আমি অ্যানিমাল ট্রেনার হয়ে উঠেছি। প্রথমটা খুবই সাধারণ। বসে কাজ করার মানসিকতা আমার নেই। ন’টা-পাঁচটার চাকরি তাই আমার পোষাত না কোনওকালেই। বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি থাকা সত্ত্বেও কোনও অফিস জব তাই আমি করতে পারিনি। কিন্তু দ্বিতীয় কারণটাই আমার অনুপ্রেরণা। পশুদের আচরণ বিষয়ে ট্রেনিং নেওয়ার পরে আমার এক প্রতিবেশীর কুকুরকে প্রথম প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম। সেটা ছিল একটা জার্মান শেফার্ড। এমনিতে মিশুকে কিন্তু খাবার সময় কাউকে ধারে কাছে ঘেঁষতে দেয় না। আমি একটু লক্ষ করে দেখলাম কুকুরটির ছোট বয়স থেকেই পালক তাকে একা খাওয়ার অভ্যাস করিয়েছে। সেই কারণেই খাওয়ার সময় সে লোক দেখলেই নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে এবং তর্জন গর্জন করে। অভ্যাসটা ভাঙার জন্য আমিও খাবার নিয়ে ওর কাছে যেতে লাগলাম। প্রথমে একটু দূরে বসে দু’জন খেতাম। কুকুরটা ক্রমশ নিরাপত্তাহীনতা কাটিয়ে উঠল। এখন আর ও একা খায় না। এই ঘটনাটা আমার আত্মবিশ্বাস অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছিল। তারপর থেকেই অ্যানিমাল ট্রেনিংয়ের পাশাপাশি তাদের পালকদেরও ট্রেন করার সিদ্ধান্ত নিই।’
শর্মিলার কথা
কলকাতার কন্যা জয়শ্রীর অনেক আগে থেকেই যে মহিলা অ্যানিমাল ট্রেনার হিসেবে নাম করেছিলেন তিনি চেন্নাইয়ের শর্মিলা জয়রাম শর্মা। শহরের উডস্টক অ্যানিমাল ট্রেনিং স্কুলে প্রশিক্ষণ দেন তিনি পশুদের। ‘হ্যান্ড শেক করা বা মাথা নামিয়ে বাও করার মতো পোশাকি প্রশিক্ষণে আমরা বিশ্বাস করি না,’ বললেন শর্মিলা। তিনি কাজটার প্রতি এতটাই টান অনুভব করেছিলেন যে কর্পোরেট চাকরি ছেড়ে এই কাজে নামার সিদ্ধান্ত নেন। শর্মিলা বললেন, ‘পশুদের সঙ্গে মেলামেশা করার পর দেখলাম এখানে পালকদের মূলত ডগ শো-তে প্রাইজ পাওয়ানোই উদ্দেশ্য। কিন্তু কুকুরকে স্বাবলম্বী করা, তাকে আজ্ঞাপালনকারী করে তোলার দিকে তাদের কোনও মন নেই। তাই তাদের সঙ্গে আলোচনা করে প্রথমে কুকুরের কাজ বিষয়ে তাদের সচেতন করা হয়। তারপর সেই অনুযায়ী তাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়। আমাদের এখান থেকে যেসব কুকুর ট্রেনিং নেয় তারা শান্ত, পারদর্শী ও মিশুকে স্বভাবের তৈরি হয়।’
যে কোনও পশুকেই কমিউনিকেশন শেখানো একটা বড় ব্যাপার বললেন, শর্মিলা। সেই কমিউনিকেশন স্কিল তিনি কুকুর, বেড়াল ও পাখিকে শেখান। বিপদ থেকে রক্ষা করার কাজে কোনও পশুকে কখন ও কীভাবে কাজে লাগানো যাবে সেটাই প্রশিক্ষণের আসল উদ্দেশ্য। আর সেক্ষেত্রে পশুদের পাশাপাশি কিছু জিনিস তার পালকদেরও জানানো হয়। শর্মিলা অবশ্য শুধুই পোষ্যদের নিয়ে কাজ করেন না, সিকিওরিটির কাজে যেসব কুকুরকে নেওয়া হয় তাদেরও প্রশিক্ষণ দেন তিনি। এই কাজটা অবশ্য স্কুলে হয় না, এটা তিনি এককভাবে করেন বলেই জানালেন। সিকিওরিটি ডগ ট্রেনিংয়ের জন্য বিশেষ কোনও প্রশিক্ষণ লাগে কি না জানতে চাইলে শর্মিলা বলেন, ‘কুকুরকে সিকিওরিটির কাজে লাগাতে হলে তাকে বিচক্ষণ করে তুলতে হয়। এই কাজটা সাধারণ ট্রেনিংয়ের মাধ্যমে হয় না। তার জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণ লাগে। যেমন শব্দ বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো, শব্দের দিক নির্ণয় ক্ষমতা তৈরি করা, নিজেকে অন্তরালে রেখে বিপদের মোকাবিলা করা, বিপদ থেকে অন্যকে বাঁচানো ইত্যাদি বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিতে হয় সিকিওরিটি ডগদের।’ এই কাজটা কিন্তু বেড়াল বা অন্য পশুকে দিয়ে হয় না। তবে বেড়ালদের আবার থেরাপির জন্য কাজে লাগানো যায়। শর্মিলা বললেন, মার্কিন দেশে গিয়ে তিনি দেখেছেন হাসপাতালের টার্মিনাল ওয়ার্ডে বেড়াল রাখা হয় রোগীদের মন ভালো করার জন্য। সেই ক্ষেত্রেও বেড়ালটি কিন্তু বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। আমাদের দেশে তেমন সুযোগ হয়তো নেই, তবে অনেকেই স্পেশাল নিড চাইল্ডের জন্য পশু পালন করেন। সেক্ষেত্রে যে বাচ্চা চোখে দেখে না বা হাঁটতে পারে না তার সহায়ক হিসেবে কুকুর বা বেড়ালকে ট্রেনিং দেওয়ার কাজও করেন শর্মিলা।
এই কাজটির বিষয়ে জানলেন কীভাবে? প্রশ্ন করলে শর্মিলা বলেন, ‘প্রথমে তো নিজের পোষ্যটিকে ট্রেনিং দেওয়ার জন্যই খোঁজখবর নিচ্ছিলাম। তখনই উডস্টক স্কুলের খোঁজ পাই, সেখানে গিয়ে কথা বলে, ওদের আদবকায়দা দেখে আগ্রহ জাগে। পশুপাখি এমনিতেই ভালোবাসতাম, সেটাকেই পেশায় রূপান্তরিত করার সুযোগ পেয়ে আর ছাড়তে পারলাম না।’
সুপ্রিয়ার কথা
সিকিওরিটি ডগ-দের কথা যখন উঠলই তখন পুনের সুপ্রিয়া কান্দ্রের নাম অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। পুলিসে কর্মরত কুকুরদের প্রশিক্ষণ দেন সুপ্রিয়া। সিআইডি-র কুকুরদেরও প্রশিক্ষণ দেন তিনি। মধ্যপ্রদেশে ন্যাশনাল অ্যানিমাল ট্রেনিং সেন্টার থেকে এই বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। পুলিস ও প্যারামিলিটারি ডগ ট্রেনার হিসেবে অভিজ্ঞ সুপ্রিয়া।
কেমন সেই প্রশিক্ষণের ধরন? সুপ্রিয়া জানালেন, কঠোর নিয়মানুবর্তিতা দিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু। আমাদের দেশে মাত্র তিন জায়গায় এই ধরনের ট্রেনিং সেন্টার আছে। সেখানে একমাত্র মহিলা ট্রেনার সুপ্রিয়া। অন্য যেসব মহিলা রয়েছে তাঁরা সবাই হ্যান্ডলার। কিন্তু পুলিসি প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটা তাঁরা করেন না। সুপ্রিয়া এই ধরনের কুকুরদের যেসব প্রশিক্ষণ দেন তার মধ্যে ডিটেকশন একটা বড় অংশ। বিপদের আশঙ্কা কোথায় বেশি তা দূর থেকে বোঝার জন্য ট্রেনিং দেওয়া হয়, ল্যান্ডমাইন কোথাও বিছানো থাকলে তা বোঝার জন্য স্নিফিং ক্যাপাসিটি বাড়ানোর ট্রেনিং দেওয়া হয়, এমনকী অপরাধী ধরার জন্য স্পেশাল স্নিফিং অ্যান্ড হিয়ারিংয়ের প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়। এছাড়াও আছে শার্পনেস ট্রেনিং, ফিটনেস ট্রেনিং, ডায়েট ট্রেনিং ইত্যাদি।
এই ধরনের কাজ করার পিছনে অনুপ্রেরণা কী? সুপ্রিয়া বললেন, ‘ছোট থেকেই একটু অন্য কিছু করার ইচ্ছে ছিল। কুকুর আমার বরাবরের প্রিয়। আর ভালো লাগে থ্রিলিং কাজ। সব মিলিয়ে পুলিস বিভাগের কুকুরদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কাজটা খুব মনে ধরেছিল। তবে এই প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য তো নিজেকেও তৈরি করতে হয়েছে। সেই কাজটা করাও বেশ কঠিন। ন্যাশনাল অ্যানিমাল ট্রেনিং সেন্টারে ভর্তি হওয়ার জন্য যখন পরীক্ষা দিচ্ছিলাম তখনই দেখেছিলাম এই কাজে পুরুষদের আধিপত্য কত বেশি। তাদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার জন্য নিজেকে দ্বিগুণ বিচক্ষণ ও সচেতন করে তুলতে হয়েছিল। পান থেকে চুন খসলেও বাতিল হয়ে যাওয়ার ভয় ছিল। আর আমি ঠিকই করে নিয়েছিলাম, ট্রেনার হিসেবে চাকরি পেলে তবেই কাজটা করব। হ্যান্ডলার আমি কিছুতেই হব না।’
ফলে পশু প্রশিক্ষণের কাজে মহিলাদের আগ্রহ ক্রমে বাড়ছে। মেয়েরা সংবেদনশীল, তাই ভিন্ন ধারার কাজে তারা পারদর্শী হয়ে উঠছে।