হ্যান্ড ব্লক প্রিন্টে আধুনিকতার ছোঁয়া এনে দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ক্রেতাদের মন জয় করছে কনিষ্ক। বিপণির কর্ণধার নন্দিতা রাজার সঙ্গে কথায় অন্বেষা দত্ত।
১৫ আগস্ট, ১৯৭০ সাল থেকে পথচলা শুরু করে শহর কলকাতার অন্যতম পুরনো বিপণি, কনিষ্ক। দিলীপ এবং নন্দিতা রাজার হাত ধরে যার সূত্রপাত। দম্পতির প্রথম সন্তান কনিষ্কর নামে নামটি হয় বিপণির। হাতে বোনা টেক্সটাইল নিয়ে তীব্র আগ্রহ ছিল নন্দিতাদের। সে আগ্রহই রূপ পেল এ বিপণির পথচলায়। নয় নয় করে পাঁচ দশকেরও বেশি সময় কাটিয়ে ফেলেছে অভিজাত বিপণিটি। চলার পথে সবসময় মনে রেখেছে লোকঐতিহ্যের কথা। সেই কারণে দেশীয় তাঁতি, ক্র্যাফটসম্যানদের সঙ্গে নিয়ত সম্পর্ক রেখে চলেছে তারা। হাতের নকশা দীর্ঘকাল ধরে রূপ পেয়ে এসেছে শাড়িতে। তিন বছর আগে স্বামীকে হারালেও নন্দিতা সেই পথচলা থেকে সরে আসেননি। তাঁর অভিজ্ঞতার কথা জানালেন সবিস্তারে।
• হ্যান্ডলুম বা হ্যান্ডব্লক প্রিন্ট নিয়ে আপনাদের বরাবরের আগ্রহ। এটা কোথা থেকে হল যদি একটু বলেন...।
ছোটবেলা থেকেই ডিজাইন দেখার প্রতি আগ্রহ ছিল। স্কুল থেকে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতাম। একটা ছোট দোকান ছিল পথে। দু’জন প্রিন্টার (অতীতে তাই বলা হতো) চৌকিতে মুখোমুখি বসে কাজ করতেন। ওঁদের কাজ দেখতাম। খুব ভালো লাগত। একদিন বললাম, আমার পুতুলের জন্য শাড়ি করে দেবে? ওঁরা বললেন, হ্যাঁ নিয়ে এসো। টুকরো কাপড় নিয়ে গেলাম বাড়ি থেকে। ওঁরাও বানিয়ে দিলেন। রোজই যেতাম! ওঁরা আবাক হতেন। আবার দেখতেও দিতেন। বাড়িতেও জানত, স্কুল থেকে ফিরতে দেরি হচ্ছে কারণ আমি প্রিন্টারদের সঙ্গে ওখানে বসে গল্প করছি। তখন থেকেই ভালোলাগা। তারপর কোনও ভালো ডিজাইন কোথাও দেখলে খুঁটিয়ে দেখতাম। তখনও তো ম্যাগাজিন জাতীয় কিছু কমই হাতে আসত। পেপার বা অন্য কোথাও কিছু খুঁজে পেলেই কেটে রাখতাম। স্ক্র্যাপবুকে সব গুছিয়ে রাখতাম। পড়াশোনা বাদ দিয়ে এসবে মন দেওয়ার জন্য বাড়িতে কত বকুনি খেয়েছি। বড় হয়ে হ্যান্ড ব্লক প্রিন্টের দিকে ঝুঁকলাম। আর তখনই মনে হল হ্যান্ড ব্লক প্রিন্ট যখন, তখন কেন মিলের কাপড়ে করব কাজটা? হাতে বোনা শাড়িতে কেন নয়? ছোট তাঁতিরা এত শাড়ি বুনছেন। সেই সব মিলিয়ে একদিন কাজ শুরু করলাম।
• ৫০ বছরের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসে এই ইন্ডাস্ট্রিতে কী কী পরিবর্তন চোখে পড়ে?
অনেক পরিবর্তন। আমি যখন ৫০ বছর আগে কাজটা শুরু করি, তখন সেটা ছিল খানিকটা হবির মতো। বাড়ির মধ্যে বসে কাজ করতাম। এই নেশা যে পরে পেশা হবে, ভাবিনি কখনও। এখন যাঁরা শুরু করছেন, তাঁরা কিন্তু প্রফেশনাল হিসেবেই শুরু করছেন। সেক্ষেত্রে দ্রুত সবটা শিখে নেওয়ার একটা প্রবণতা রয়েছে। তবে এই কাজ শেখার জন্য সবচেয়ে যেটা জরুরি, সেটা হল ধৈর্য। যেটা এখন একেবারে দেখা যায় না। এই প্রজন্মের ভাবনাটা হল তাড়াতাড়ি নাম করব, পয়সা করব। কাজটা ভালোবেসে যদি করতে হয়, তাহলে কিন্তু এটা হবে না। এটাও তো একটা আর্ট ফর্ম। কিছু বই পড়ে, কিছু নিজের আগ্রহ আর সৃষ্টিশীলতা কাজে লাগিয়ে আমি কাজ করেছি। আমাদের সময় ফ্যাশন স্কুল ইত্যাদি এতরকম সুযোগ তো ছিল না। তাঁতিদের থেকে, প্রিন্টারদের থেকে, কারিগরদের থেকে একটু একটু করে শিখেছি। কত জিনিস নষ্ট হয়েছে, তা নিয়ে মাথা ঘামাইনি। সস্তায় হাওড়ার মঙ্গলাহাট থেকে তাঁতের শাড়ি কিনেছি। তাতে কাজ করেছি। একেবারে মূল থেকে শেখা। এখনও এইভাবে অনেকে কাজ করে হয়তো। কিন্তু কারও থেকে জিনিস কিনে আরও বেশি দামে বেচে দেওয়া তো শিল্প নয়। আর হাতের কাজের জন্য টাকা বেশি দিতে হবে, এটা কিন্তু ক্রেতাও জানেন। তাই সৃষ্টিশীলতার কোনও বিকল্প হয় না।
• আপনারা শুরুতে যেভাবে কাজটা করতেন, এখনও কি সেই যত্ন বা অধ্যবসায় লক্ষ করা যায়?
না দুঃখিত, দেখা যায় না। এটাই আগে বলতে চাইছিলাম। কুইক ফেম, কুইক মানি চাই। সবার নিশ্চয়ই নয়। কিন্তু প্রবণতাটা তেমনই। গলিতে গলিতে দেখি আজকাল বুটিক। আমাদের সময় তো এমনটা জানতামই না। আজকাল আধুনিক প্রযুক্তি শিখে অনেকেই ভালো কাজ করছেন। কিন্তু অধ্যবসায়ে ঘাটতি আছে।
• হ্যান্ডলুমের নাম দিয়ে বাজারচলতি নানা পণ্যে ছেয়ে গিয়েছে। সঠিক জিনিস সঠিক দামে মানুষ কীভাবে পেতে পারেন তার কোনও গাইডলাইন আছে?
অবশ্যই আছে। জিনিস চিনতে হবে। এগুলো পড়াশোনা করে হয় না। পিওর সিল্ক না মিক্সড সিল্ক, হাত দিলেই বোঝা যাবে। পিওর সিল্কের ওজন কখনওই বেশি হবে না। পলিয়েস্টার মেশানো শাড়ি ভারী হবে। লোকে ভাবে এত ভারী জমকালো শাড়ি সস্তায় পেয়ে গেলাম! কনিষ্কতে কেন এত দাম নেয়? তাঁরা এভাবেই বুঝবেন। কোনও সিল্ক শাড়ির আঁচলের একেবারে কোনা থেকে সামান্য সুতো বা ব্লাউজপিসের অংশ কেটে দেশলাই কাঠির আগুনে জ্বালিয়ে দেখতে পারেন। তাতে যদি দেখা যায়, পাউডারের মতো হাতে চলে এল, বুঝবেন আসল জিনিস। যদি হাতে দানা দানা পড়ে থাকে, সেটা মিক্সড। আমরা প্রয়োজনে ক্রেতাকেও এভাবে দেখাই। তাঁতিদের কাছ থেকেই এসব শেখা আমার।
• এই গোটা শিল্পে মহিলাদের অবদান কতটা? আপনি বিষয়টাকে কীভাবে দেখেন?
মেয়েদের অনেক প্রতিভা। সঠিক জিনিসটা মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তাঁদের নিতে হবে। একটা আর্টিফিশিয়াল জিনিসকে আসল বলে চালাবেন না।
• এখন বহু মহিলা নিজের উদ্যোগে এধরনের কাজ করছেন, তাঁদের কোন কোন বিষয় মাথায় রাখতে বলবেন? এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জগুলো কী কী সেটাও বলুন।
মহিলারা কাজ করছেন, ভালোই করছেন। তবে নিজের কিছু অভিনবত্ব রাখা ভালো। এক জায়গা থেকে কিছু জিনিস তুলে এনে বেশি দামে বিক্রির মধ্যে কোনও অভিনবত্ব নেই। অনেকে অবশ্য শিখছেন সঠিক পথে। বিদেশে হ্যান্ডলুমের বাজার এত বড়, এখন সেটা অনেকেই বুঝছেন। কত কাজ হতে পারে এই নিয়ে। খাদি নিয়ে এখন কত ডিজাইনার বড় বড় কাজ করছেন। এই পথে ভাবতে হবে।
• এখনকার প্রজন্ম, বিশেষত তরুণীরা নিজের দেশের বস্ত্র-ঐতিহ্য নিয়ে কতটা ওয়াকিবহাল? তাঁদের টানতে কী ধরনের উদ্যোগ নিচ্ছেন?
এই প্রজন্মের যারা প্রশিক্ষণ পাচ্ছে, তারা জানে কোনটা কত কাউন্টের শাড়ি বা এইরকম অনেক কিছু। কিন্তু সবাই জানে না। ব্লক প্রিন্ট এখন উঠে যাচ্ছে কেন? কারিগরের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। আমাদের বাংলার এটা কত পুরনো ঐতিহ্য। কিন্তু একজন ব্লক প্রিন্টারের পরের প্রজন্ম এই কাজে ফিরে আসছে না। এটাই মুশকিল। আমি যাঁদের সঙ্গে কাজ করি, তাঁরাই তো বলেন ‘আমরা শেষ প্রজন্ম, আর পাবেন না’। একটা শাড়ির কাজে দিনে ২০০ টাকা পাওয়া যায়। সে কেন করবে? পড়াশোনা শিখে বা প্রযুক্তির কাজ করবে। ফুলিয়াতে একসময় কেউ জানত না পাওয়ারলুম কী। এখন গিয়ে দেখুন, সব পাওয়ারলুম। বেনারসেও তাই। সস্তায় সব করে ফেলতে হবে। শ্রমের বা শ্রমিকের প্রয়োজন কমিয়ে ফেলা হচ্ছে। তাও হ্যান্ডলুমকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে যেতে হবে। যতটা ভারতীয় সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের জন্য করা যায়, সেই সংগ্রামটা করে যেতে হবে। হ্যান্ডলুম চিনতে হবে, চেনাতে হবে।