পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
স্টার থিয়েটারে যখন এরকম ব্যাপার স্যাপার তখন পাশের রাস্তা রাজা রাজকৃষ্ণ স্ট্রিটেও হই হই ব্যাপার। বিশ্বরূপা, রংমহল, সারাকারিনা, রঙ্গনা, বিজন থিয়েটার সব হলেই নতুন নাটকের শো শুরু হচ্ছে। রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, ব্রাত্য বসু, মেঘনাদ ভট্টাচার্যের মতো বাঘা বাঘা পরিচালকরা দায়িত্বে রয়েছেন সেসব নাটকের। অভিনয়ও করছেন এই সময়ের সব স্টলওয়ার্ট শিল্পীরা। দেবশঙ্কর হালদার, গৌতম হালদার, অনির্বাণ ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে সত্রাজিৎ, কৌশিক সব্বাই। কোথাও অভিনীত হবে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে নাটক, কোথাও আবার সমরেশ মজুমদারের লেখা থেকে। সব খবরের কাগজে আগাম বিজ্ঞাপন পড়ে গিয়েছে। টিকিটের জন্য লাইন দিয়েছে সাধারণ মানুষ।
হলের আশপাশের রেস্টুর্যান্ট, খাবারের দোকানগুলিতেও আজ সাজো সাজো রব। সন্ধে হলেই নামবে মনোরঞ্জন পিয়াসী মানুষের ঢল। দর্শকদের জন্য স্পেশাল মেনু তৈরি হয়েছে। প্রচুর বিক্রিবাটার আশায় রয়েছেন দোকানদার আর রেস্তরাঁর মালিকরা। সবমিলিয়ে হই হই রই রই ব্যাপার। কি, যাবেন নাকি!
নাঃ যা লিখলাম পুরোটাই স্বপ্নকল্প। হাতিবাগানের আসল রূপটা আশাকরি সবাই জানেন। রংমহল ভেঙে হাইরাইজ উঠেছে। বিশ্বরূপা, সারকারিনা, রঙ্গনা সব বন্ধ। বিজন থিয়েটার বিক্রি হয়ে গিয়েছে সেখানেও হয়তো কোনওদিন উঠবে কোনও হাইরাইজ, তৈরি হবে শপিং মল! কিন্তু শুরুতে যে স্বপ্নকল্প লিখলাম তা সত্যি হতেও পারত। কারণ একদিন ছিল যখন সত্যি সত্যিই হাতিবাগানের থিয়েটার হলগুলো পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সেজে উঠত। সকালে হতো গণেশ পুজো। বিকেলে সব নাটকেরই ডবল শো হতো। লোক উপচে পড়ত হলগুলোতে। কীরকম ছিল সেই দিনগুলো? নব্বইয়ের কোঠায় পৌঁছনো মনু মুখোপাধ্যায় জানালেন, বিশ্বরূপায় পয়লা বৈশাখের সকালে হত গণেশ পুজো। গ্রিন রুম আর স্টেজের মাঝামাঝি একটা জায়গায় ঠাকুর রেখে পুজো হতো।
পুরোহিত আসতেন। রাসবিহারী সরকার, বিশ্বরূপার দোর্দণ্ডপ্রতাপ মালিক ধুতি পাঞ্জাবিতে সজ্জিত হয়ে হাজির থাকতেন পুজোর সময়। থাকতেন কর্মচারীরা। সময় পেলে অনেক শিল্পীরাও আসতেন।
মনু মুখোপাধ্যায়ের প্রায় সমবয়সী আর এক অভিনেতা নিমু ভৌমিকও পুরনো কথা বলতে বলতে নস্টালজিক হয়ে পড়লেন। বললেন, কী বলব ভাই সেসব দিনগুলো ছিল একেবারে অন্যরকম। কত উৎসাহ, উদ্দীপনা ছিল সে সময়ে। পয়লা বৈশাখের সন্ধেতে হতো ডবল শো। সব হলেই। সকালে ধুমধাম করে হতো গণেশ পুজো। আমি রঙ্গনার সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, রংমহলেও শো করেছি। সব জায়গাতেই দেখেছি এই দিনটাতে দর্শক উপচে পড়ত হলে। রঙ্গনাতে এমনও দেখেছি যে দর্শকাসনে জায়গা না থাকা সত্ত্বেও দর্শকের অনুরোধে হল খুলে দিতে হয়েছে। প্রেক্ষাগৃহের সিঁড়িতে বসে নাটক দেখেছ মানুষ। আজ সেসব কথা মনে করলে স্বপ্ন বলে ভ্রম হয়। অভিনেত্রী ছন্দা চট্টোপাধ্যায়ও নিমু ভৌমিকের কথার প্রতিধ্বনি করে বললেন, শুধু হাতিবাগান পাড়ার থিয়েটার হলগুলোতেই নয়। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে সাজো সাজো রব উঠত চিৎপুরের যাত্রাপাড়ায়ও। সেখানেও সকাল সকাল দলের মালিকরা গদিতে গণেশ পুজো সেরে ফেলতেন। বেলা বাড়তেই জেলা থেকে আসতে শুরু করতেন নায়েকরা। প্রত্যেকের হাতে হাতে ধরিয়ে দেওয়া হত মিষ্টির প্যাকেট। সরবতের গ্লাস ঘুরত হাতে হাতে। সন্ধেবেলা আসতেন শিল্পী আর লেখকরা। স্বপনকুমার, শান্তিগোপাল, ভৈরব গঙ্গোপাধ্যায়, বীণা দাশগুপ্তারা সেজগুজে গাড়ি চেপে চলে আসেতন গদিতে। নায়েকরা টাকার বান্ডিল নিয়ে চলে আসতেন বুকিং করতে। চিৎপুর পাড়ার সেই রমরমাও আজ আর নেই। যদিও যাত্রা আছে। কিন্তু নেই সেই খুশির দিনগুলো। এখন নমো নমো করে পুজোটুকু হয়। কিন্তু সেই উচ্ছ্বাস আর উদ্দীপনা কোথায়? ছন্দা চট্টোপাধ্যায় একসময় সাড়া ফেলে দেওয়া নাটক ‘বারবধূ’-তেও অভিনয় করেছেন। সেই রামমোহন মঞ্চেও পরিচালক অসীম চক্রবর্তী পয়লা বৈশাখের সকালবেলা গণেশ পুজো করতেন। একটু মনে করে ছন্দা চট্টোপাধ্যায় বললেন, বোধহয় সেটা সাতের দশকের শেষাশেষি। তখন রংমহলে আমি ‘সুবর্ণগোলক’ নাটকে অভিনয় করতাম। সরযূবালা দেবী অভিনয় করতেন সে নাটকে। তিনিও পয়লা বৈশাখের সকালে হাজির হতেন হলে। তারপর বাড়ি ফিরে ফের সন্ধেবেলা ডবল শো করতে চলে আসতেন। হায়! আজ সেই রামও নেই, অযোধ্যাও নেই।
ছবি : গোপাল দেবনাথ