বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
ইংরাজি একবিংশ শতাব্দী আমাদের বঙ্গাব্দ পঞ্চদশ শতক থেকে অনেক অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ তাঁদের খ্রিস্টীয় দু’হাজার উনিশ বছরে সারা পৃথিবী জুড়ে বহু কিছু অঘটন ও অন্যায় ঘটে গিয়েছে, আমরাও আপন গৃহকোণে আবদ্ধ থেকেও সমুদ্র মন্থনের সেই সব বিষ শরীরে ধারণ করে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তাকে বারংবার নিন্দা জানিয়েছি, সে সব অভিযোগ কর্তাব্যক্তিদের কানে পৌঁছেছে কি না জানি না, তবে ইদানীং একটা জিনিস লক্ষ করেছি, মহাযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপে সর্বস্ব হারিয়েও অনেক পরাজিত দেশ আবার জেগে উঠে বিশ্বের মানুষকে দেখিয়েছে, মানুষের অসাধ্য কিছু নেই। বহুজনের অদম্য প্রাণশক্তি ক্ষতবিক্ষত বিশ্বকে আজও মৃত্যুহীন করে রেখেছে।
বিশ্ব তো অনেক দূর, নিজ গৃহকোণে পুরো বিংশ শতাব্দী ধরে যে সব আত্মনিধনের অবিশ্বাস্য প্রচেষ্টা লিপিবদ্ধ হল, তার তোয়াক্কা না করে আমাদের ভারতবর্ষও আবার জগৎসভায় একটা সম্মানিত স্থান নতমস্তকে অধিকার করতে চলেছে; জয় ভারত, জয় হিন্দ যে নিরর্থক একটা বিশ্বজনীন স্লোগান নয়, সত্যিই বিশ্বসংসারে আমাদেরও যে কিছু দেওয়ার আছে তা জগৎসভার অনেকের কাছেই আজ আর অস্পষ্ট নয়।
এ যুগে যাঁরা বোস ঘোষ দে দাস দত্ত হাজরা মণ্ডল সেন সাহা মুখার্জি ব্যানার্জি চ্যাটার্জি বলে নিজেদের স্বাতন্ত্র্যকে সম্পূর্ণ ভুলে যেতে আজ আর তেমন উৎসাহী নন তাঁরাও বছরের এই প্রথম দিনে নিজেদের লাভ লোকসানের হিসেব করতে বসেন। সেই খ্রিষ্টীয় বিংশ শতকের প্রায় শুরুতে উদ্ধত এক হৃদয়হীন ইংরেজ ভাইসরয় যাঁদের বিভক্ত করতে গিয়ে শাসক ইংরেজকে বেশ বিপদে ফেললেন, তাঁর তুলনা মানুষের ইতিহাসে বড় একটা নেই। ভারতের রাজধানী আর কলকাতায় রইল না, যা একদিন বৃহৎ বঙ্গ বলে পরিচিত ছিল তা যথাসময়ে কয়েকবার খণ্ডিত হল, পৃথিবীর ইতিহাসের প্রায় বৃহত্তম অন্নাভাব, সেই সঙ্গে বিশ্বের অন্যতম লজ্জাজনক রায়ট, সেই সঙ্গে বিনা অপরাধে ছিন্নমূল কোটি কোটি নিরপরাধ জনগণের আর্তনাদ, আবার দেশবিভাজন এবং অবশেষে সাতচল্লিশের মধ্যরাতে স্বাধীনতার সূর্যোদয়— একসঙ্গে অনেক কিছু ঘটে গেল নিরীহ নিরপরাধ এক জনসমাজের ওপারে। বাঙালির নরক যন্ত্রণার সেই অভিশপ্ত ইতিহাস দু’মলাটের মধ্যে সহজসরল ভাষায় আজও লিপিবদ্ধ হয়নি। যাঁরা এইসব প্রতিকারহীন অত্যাচারের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন তাঁরা একে একে জীবনলীলা সাঙ্গ করে মরণ-সাগরের ওপারে চলে যাচ্ছেন, তবু যা বিস্ময়কর, এত বিড়ম্বনার পরও বাঙালি নামক জাতটি পৃথিবীর মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন হলো না এবং বরং তার সংখ্যা পঁচিশ কোটি পেরিয়েছে, এই সেদিনও যা ছিল মাত্র সাত কোটি। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিপুলসংখ্যক বঙ্গভাষী প্রমাণ করেছে, বাঙালিরা অনেকটা ধান গাছের মতন, উৎপাটিত হয়ে পুনঃরোপিত হলে তাদের বিকাশ লুকিয়ে রাখা যায় না। বাঙালি কে? বঙ্গে বসবাস করে যে, এবং বাংলায় কথা বলতে পারে সে-ই বাঙালি, এই পুরনো ফর্মুলা অচল। এখন অনেক বাঙালির ছেলেমেয়ে বাংলা ভাষাকে স্বেচ্ছাবর্জন করেছে, অনেকেই বাংলার নাম শুনেছে কিন্তু বাংলার মুখ দেখেনি, বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ-আষাঢ় বলতে কী বোঝায় তাও অনেকের তেমন জানা নেই, তবু আশ্চর্য ব্যাপার, তাদের অনেকে আজও জনগণমন অধিনায়ক-এর লেখক রবীন্দ্রনাথের গানের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বছরের একদিন ‘এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ’ বলতে ভালোবাসে। কোথাও কোথাও তারা নববস্ত্র পরিধান করতেও ভালোবাসে, কেউ কেউ আবার স্বদেশের পরিচিত জনদের ই-মেল পাঠায়— হু ইজ অগস্ত্য মুনি? হোয়াই ডিড হি ব্লাফড্ বিন্ধ্য পর্বত? বছরের প্রথম দিন যদি বাণিজ্যারম্ভের সেরা দিন হয় তাহলে কেন ওই দিন দূরদেশে যাতায়াত নিষিদ্ধ? সবাই যদি সেই পঞ্জিকা নিষেধ মানত তাহলে ইন্ডিয়ান সেন্সাস রিপোর্ট অনুযায়ী সবচেয়ে বেশি সংখ্যক বাঙালি আজও কেন জন্মভূমির বাইরে বসবাস করে?
আরও অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্ন তোলা যায়। দুঃসাহসী বাঙালিরাই কি এই মুহূর্তে দুনিয়ার সবচেয়ে অ্যাডভেঞ্চারস জাত? সারা বিশ্বের প্রায় সমস্ত সমুদ্রগামী জাহাজগুলিতে কারা কাজ করছে? বিলেতের হাজার হাজার রেস্তোরাঁয় সায়েবদের চিকেন টিকিয়া খাওয়াতে বাধ্য করে কারা পলাশীর যুদ্ধের বদলা নিয়েছে? সেই সঙ্গে কারা সারা ইউরোপে, আমেরিকায় এবং এশিয়ার রেল স্টেশন এবং এয়ারপোর্টে ফেরিওয়ালাগিরি করে অনেক পরিষেবা চলমান রেখেছে?
আপন ঘরে কিন্তু বাঙালির বদনামের শেষ নেই। সে নাকি ঘরকুনো এবং শ্রমকাতর, কিন্তু একটা কাজের পিছনে লক্ষ তরুণ-তরুণী আবেদনপত্র পাঠায়, বিশ্বলক্ষ্মী তাদের ত্যাগ করেছে বুঝেও সে জন্মস্থান ছাড়া হতে অতিমাত্রায় ব্যগ্র, যদিও ইদানীং কমমাইনের তাই বিরক্ত বিশ্বের সর্বত্র ‘বং’ বলে তাদের পরিচিতি, সেখানে যদিও ইদানীং কম মাইনের চাকর হিসেবে তাদের যথেষ্ট সুনাম।
দেশ-বিদেশে ঝি-চাকর বাঙালির সুনামের অভাব নেই, কিন্তু বাঙালি কেন মাসমাইনের চাকরি ছাড়া আর কিছুই জানে না? বিজনেস কি এ জাতের ধাতে সয় না? এসব নিয়ে অনেকদিন ধরে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। ইতিহাসের পাতা থেকে পণ্ডিতজন মনে করিয়ে দিয়েছেন, এই বাঙালিই একদিন নিজেদের জাহাজে পাল তুলে ইউরোপে এবং দ্বীপময় ভারতে গিয়ে মাল বেচে এবং তার বদলে স্বদেশে তাল তাল সোনা নিয়ে এসেছে, জুয়েলার বা স্বর্ণকার না হয়েও তাদের নাম হয়েছে ‘সোনার বেনে’, এঁদের মধ্যে শ্রেষ্ঠীর সংখ্যা কম ছিল না, লক্ষ স্বর্ণমুদ্রার অধীশ্বর না হলে নিজের নামের সঙ্গে শ্রেষ্ঠী শব্দটি যোগ করার অধিকার কারও রীতি ছিল না।
তারপরেও বঙ্গজীবনে অনেক কিছু ঘটেছে। পলাশির আম্রকাননে বাংলার অধীশ্বরকে পরাজিত করলেও, বণিক ইংরেজ এক সময় এই বাঙালিকেই ব্যবসায়িক পার্টনার হিসেবে পছন্দ করেছে, তাদের কাছ থেকে টাকা ধার করেছে, কোম্পানির বিলিতি নামের সঙ্গে দে দত্ত সরকার সেন টেগোরের নাম যোগ করে দিতে ইংরেজ দ্বিধা করেনি। অষ্টাদশ, ঊনবিংশ এবং বিশ শতকের মধ্যাহ্ন পর্যন্ত ইন্ডিয়ার বিজনেস হিসট্রি পড়ে দেখুন, বিশ্বাস হবে না।
হাতের গোড়ায় স্টেট ব্যাংক অফ ইন্ডিয়ার ইম্পিরয়াল ইতিহাস ও লেজার খাতাগুলো আজও রয়েছে। ১৮২২ সালে ব্যাঙ্ক অফ বেঙ্গলের খাতা অনুযায়ী, কলকাতায় বিলিতি সায়েবদের বিজনসে রূপার খনি মাত্র ছ’ভাগের এক ভাগ, আর বাকি পাঁচ ভাগ বাঙালিদের মুঠোয়।
তারও আগে ১৭৮৩ সালে শোভারাম বসাক কলকাতায় সাঁইত্রিশটা বিশাল বাড়ি রেখে যান। ১৮৩৭ সালে সিঁদুর পট্টির মল্লিকরা কলকাতার ছিয়ানব্বইটি বড়বড় বাড়ির মালিক ছিলেন। ইদানীং খোঁজখবর নিয়ে জানা গেছে ১৮০০-১৮৫০ এই পাঁচ দশকের মধ্যে কলকাতার ধনবান বাঙালিরা তখনকার সুপ্রিম কোর্টে জোচ্চোর ইংরেজ বিজনেসম্যানদের বিরুদ্ধে এক হাজার মামলা দায়ের করেছে দেনা শোধ না করার অভিযোগ জানিয়ে।
অনেকদিন আগে গবেষক নরেন্দ্রকৃষ্ণ সিনহাকে হাওডায় দেখেছিলাম এবং পরে তাঁর ইকনমিক হিসট্রি অফ বেঙ্গল নামে বই পড়েছিলাম, সেখানে লেখা, হুগলি ছেড়ে যখন ইংরেজরা সুতানুটিতে এসেছিলেন, তখন তাঁরা কিছু বঙ্গীয় সুবর্ণবণিককে সঙ্গে এনেছিলেন— এঁদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত নকু ধর। লেখক নরেন্দ্রকুমার সিনহার বইতে ডজন ডজন বাঙালি ব্যাঙ্কারের নাম পাবেন যাঁরা কোটি কোটি টাকা সায়েবদের ধার দিতেন। যেমন— মথুরামোহন সেন, মদনমোহন সেন, চৈতনচরণ সেন, রামসুন্দর পাইন। আরও আছেন— নিতাইচরণ সেন, কৃষ্ণচন্দ্র সেন! আদালতের খাতায় আরও অনেক নাম— রামতনু মল্লিক, মুট্টিলাল মল্লিক, হরিশচন্দ্র সেন। দত্তরাম দত্ত ডেভারিন ফ্রিডস বলে এক সায়েবকে তিন লাখ কুড়ি হাজার টাকা ধার দিয়ে মাত্র ৮০০০০ টাকা আদায় করতে পেরেছিলেন।
লেখক নরেন্দ্রকুমার বিস্তারিত খোঁজ নিয়ে জানিয়েছেন, ফাঁসিতে (১৭৭৫) ঝোলার আগে মহারাজ নন্দকুমার তাঁর ছেলে গুরুদাসকে পঁচিশ লাখ টাকা দিয়ে যেতে পেরেছিলেন। ১৮০৭ সালে দেহরক্ষার সময় নিমাইচরণ মল্লিকের ক্যাশবাক্সে নগদ ছিল ৮০ লাখ টাকা। প্রাণকৃষ্ণ বিশ্বাসের উইলের মূল্যায়ন হয়েছিল ৪৫ লাখ টাকা। মায়ের শ্রাদ্ধে গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ খরচ করেছিলেন ১৫ লাখ টাকা। রামদুলাল দে’র শ্রাদ্ধে আট হাজার ব্রাহ্মণ পণ্ডিত এসেছিলেন ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। সংখ্যাহীন ভিখিরিকে দেওয়া হয়েছিল নগদ টাকা।
এখন প্রশ্ন— বিত্তবান বাঙালি ব্যবসায়ী কবে এবং কীভাবে এবং কেন বিলুপ্ত হলেন? সে সব নিয়ে বিলেত-আমেরিকার ঐতিহাসিকরাও আজকাল খোঁজখবর করছেন।
স্বাধীনতার পরে বাঙালিদের কী অবস্থা হল তা প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু তখনকার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে জানতে চেয়ে লিখেছেন— বাঙালিদের সমস্যাটা কী? দূরদর্শী ডাক্তার বিধানচন্দ্র শোনা যায় অনেক ভেবেচিন্তে ছোট্ট একটা উত্তর দিয়েছিলেন। মনের দুঃখে, বোধহয় কিছুটা হতাশ হয়ে, তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে লিখেছিলেন, আজকের বাঙালিদের তিনটে সমস্যা— (১) অন্নের সমস্যা, (২) রুজিরোজগারের সমস্যা এবং (৩) মাথা গুঁজবার বাসস্থানের সমস্যা।
মুখ্যমন্ত্রীর সেই চিঠি লেখবার পরেও তো বহুবছর কাটল— কিন্তু কোনও সমাধানের অর্থাৎ থাকা, খাওয়া এবং রুজি রোজগারের পথ আজও খুঁজে পাওয়া যায়নি। বহুবছর আগে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় আশঙ্কা করেছিলেন, কলকাতার বিষয়সম্পত্তি বাঙালির হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। সেই হস্তান্তর এবার বোধহয় সম্পূর্ণ হতে চলেছে। সেই সঙ্গে বাঙালির ইতিহাসে একালের অন্যতম বৃহৎ ইমিগ্রেশন। ডিগ্রির খোঁজে, রুজিরোজগারের খোঁজে বোস ঘোষ বসাক সাহা ছুটছে দিল্লি, মুম্বই, ব্যাঙ্গালোরে। সাধের সল্টলেকে, যোধপুরে পড়ে থাকবেন বার্ধক্য জর্জরিত সিনিয়র সিটিজেন বাবা-মা, তাঁরা সারাক্ষণ ভাবছেন কীভাবে মেয়ের জন্য যোগ্য পাত্র খুঁজে পাব।
বাংলা বছরের প্রথম দিনে কঠিন প্রশ্ন: বাঙালি মধ্যবিত্তের এই সংকট-কাল কেন এল? আচার্য প্রফুলচন্দ্র রায় বেঁচে থাকলে হয়তো বলতেন, মধ্যবিত্ত বাঙালি বিত্তলক্ষ্মীর সাধনায় মন দিন না কেন, ছোট বড় মাঝারি ব্যবসায়ে বাঙালি তার অনন্য প্রতিভাকে কেন নিয়োগ করতে সাহস পাচ্ছে না? বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী তো ছেঁদো স্লোগান নয়, এই পথেই তো সেকালের বাঙালি তো ভাগ্যলক্ষ্মীর স্নেহধন্য হয়ে উঠেছিলেন।
কেন আমরা পিছিয়ে গেলাম? কোথায় আমাদের বাধা? অতীতকে দোষ না দিয়ে নির্ভয়ে ভাবা যাক ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে। এক এক সময় মনে হয়, বাংলা বছরের প্রথম দিনে আমরা ব্যবসায়ী বাঙালিকে যথাযথ সম্মান করতে শিখি, তাঁদের বলি, আমাদের সামনে আর কোনও পথ নেই— নান্যপন্থা বিদ্যতেয়ম্। তারপর আমাদের ইস্কুলের সিলেবাসে ঢুকুক নতুন বিষয়— ‘কী করে ব্যবসা করতে হয়’, ‘ব্যবসা ছাড়া গতি নাই’, ‘ছোট ব্যবসাই একদিন বড় হয়’ ইত্যাদি অতি প্রয়োজনীয় বিষয়।
অদূর ভবিষ্যতে বাঙালি অবশ্যই আবার বাণিজ্যে আবার মন দেবে। সে দিন আমাদের পয়লা বৈশাখ আবার নতুন মহিমায় মণ্ডিত হবে।