রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
পয়লা বৈশাখের মহরৎ ছিল ছবির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষদের বাৎসরিক মহোৎসব। তাঁদের কাছে এই দিনটি ছিল দুর্গোৎসবের থেকেও বড়। টেকনিশিয়ানরা নতুন জামাকাপড় কিনতেন। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওতে নহবৎ বাজত। কার্ড ছাপিয়ে নিমন্ত্রণ করা হত। গোটা স্টুডিও সাজানো হত ফুলমালায়। অতিথি অভ্যাগতদের আমপোড়া শরবৎ, ডাবের জল, বেলের শরবৎ ইত্যাদি খাইয়ে চলত আপ্যায়ন। মহরতে ক্ল্যাপস্টিক দিতে বিধানচন্দ্র রায়, হরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় কে না আসতেন! আটের দশকে শ্রীনিবাস চক্রবর্তীর ‘পথে সাথী’ ছবির ক্ল্যাপস্টিক দিতে দেখেছি মাদার টেরেসাকে। নজরুল ইসলাম, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নৃপেন্দ্রকৃষ্ণ চট্টোপাধ্যায়, বিধায়ক ভট্টাচার্য প্রমুখ কৃতবিদ্য সাহিত্যিকরা যখন সিনেমার কাজে ডুবে তখনকার মহরৎই ছিল আলাদা রকমের। বিএন সরকার এই দিন ফ্লোরে ঢুকতেন না। নিউ থিয়েটার্স স্টুডিওর বিখ্যাত গোলঘরে (এইখানে রবীন্দ্রনাথ নটীর পূজার শ্যুটিং দেখতে এসে বসেছিলেন) সারাক্ষণ বসে থাকতেন। এই স্টুডিওর পুজো দেওয়া হত কালীঘাটে। এম পি স্টুডিও এবং অরোরা স্টুডিওর পুজো দেওয়া হত যথাক্রমে দক্ষিণেশ্বরে ভবতারিণী ও বাগবাজারের সিদ্ধেশ্বরী কালী মন্দিরে। দুপুরে মহাভোগের পর খাবারের এলাহি আয়োজন থাকত। ইন্দ্রপুরীতে এই রকমই এক দিনে জমিয়ে দুপুরের খাওয়াদাওয়া হচ্ছে। তখন শেষপাতের আইটেম চলছে। একটি ছেলে রসগোল্লার বালতি নিয়ে দৌড়ে আসছে। হঠাৎ পায়ে ইলেকট্রিকের তার জড়িয়ে আছাড় খেল। হাতের বালতি ছিটকে পড়ল রাস্তায়। রসগোল্লা সাবুর দানার মতো ছড়িয়ে গেল গোটা রাস্তায়। ঠিক সেই সময় জহর রায় হাজির। ছেলেটি তখন উঠে ভয়ে কাঁপছে। প্রোডাকশন ম্যানেজার তার মজুরিটাই হয়তো আটকে দেবে। জহরবাবু বলে উঠলেন, ‘দুর বোকা ভয় কীসের! রসগোল্লগুলোকে জড় করে ধুলো মাখিয়ে বালুসাই বলে চালিয়ে দে, কেউ টের পাবে না!’
১৯৫৭ সালের মহরত অনুষ্ঠানে কালী ফিল্মস স্টুডিতে ভুরিভোজ হচ্ছে। তখনকার তাবড় শিল্পীরা হাজির। ছবি বিশ্বাস খুব আম খেতে ভালোবাসতেন। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে প্রযোজক ল্যাংড়া আমের ব্যবস্থা করেছেন। অন্যদিকে পাহাড়ি সান্যালের পছন্দের খাবার ছানার ডালনা। তিনিও খবর নিয়ে জেনেছেন তাঁর প্রিয় পদটি থাকছে। কিন্তু খেতে বসে দেখা গেল দুটো পদই নেই। এইবার পাহাড়ি সান্যাল ছবি বিশ্বাসকে লক্ষ করে বলে উঠলেন, ‘টাকায় টাকা বাড়ে, গরমে বাড়ে ঘাম/ প্রোডিউসার এত কিপটে, পাতে দেয়নি আম!’ ছবিবাবুও কম যান না। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘হায়রে ছানা পাইনা দেখা/ কোথায় গেলি তুই?/ তোর অভাবে ভরলো না পেট, হাত-পা তুলে শুই!’ ভুরিভোজের সঙ্গে অতিথিরা ফ্রিতে এইরকম রসিকতাও পেতেন।
১৯৬০ সালে কালী ফিল্মস স্টুডিওতে শুধু মেকআপে চমকে দিয়েছিলেন বিকাশ রায়। নামভূমিকায় অভিনয়ের সঙ্গে ছবির পরিচালকও তিনি। কাহিনীকার প্রমথনাথ বিশী আমন্ত্রিতদের মধ্যমণি হয়ে এসেছেন। বিকাশবাবু যেভাবে কেরিসাহেবের মেকআপ নিয়ে অতিথিদের আপ্যায়ন করতে লাগলেন স্বয়ং কাহিনীকারও মুগ্ধ। ফ্লোরেই বোঝা গেল এছবি সুপার হিট হবে।
এই মেকআপ নিয়ে একটি রসিকতা বহুদিন স্টুডিও পাড়ায় চালু ছিল। রাধা স্টুডিওর মেকআপ রুমে মেকআপ নিতে নিতে গল্প করছেন শ্যাম লাহা আর কালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ফ্লোর থেকে জোনে যাওয়ার জন্য বারে বারে ডাক আসছে। শ্যামবাবুর সব হয়ে গিয়েছে, শুধু গোঁফটা লাগানো বাকি। তিনি মেকআপম্যানকে ডাকছেন। সে তখন অনুপস্থিত। এমন সময় কালীবাবু বলে উঠলেন, ‘দাদা, অত দুঃশ্চিন্তা করছ কেন? তোমার অত বড় কিংসাইজের ভুরু—একখানা কেটে ঠোঁটের ওপর বসিয়ে নাও না।’
শ্যাম লাহা বললেন, ‘সে না হয় হল, ফাঁকা ভুরুটার কী হবে?’
কালীবাবুর চটজলদি উত্তর,‘ইলেকট্রিশিয়ান ডাকিয়ে ওই জায়গায় ব্ল্যাকটেপ মেরে দাও!’
ছবির নাম ‘মৌসুমী’। মুখ্যচরিত্রে উত্তমকুমার ও মালা সিনহা। প্রযোজক ইতালি ফেরত। মহরতের দিন জানা গেল চিত্রনাট্যকার নিতাই ভট্টাচার্য স্ক্রিপ্ট রেডি করতে পারেননি। পরিচালকের মাথায় হাত। তিনি জোড়হাত করে নিতাইবাবুকে বলছেন, ‘আমার প্রেমের ছবির বারোটা বাজিয়ে দিলেন দেখছি।
অন্তত চারপাতার একটা স্ক্রিপ্ট লিখে দিন।’
নিতাইবাবু একগাল হেসে বললেন, ‘নিন লিখুন—মিস্টার অ্যান্ড মিস/মিট অ্যান্ড কিস/মোর কিসেস/ মিস বিকাম মিসেস!’ এই ছবি কিছুদিন শ্যুটিংয়ের পর বন্ধ হয়ে যায়। এটা ঠিকই পয়লা বৈশাখ বা অক্ষয় তৃতীয়ায় যেসব ছবি শুরু হতো তার সবগুলোই শেষে হল পর্যন্ত পৌঁছত না। তবু মহরৎ রমরম করে হত।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বামাপ্রসাদ চক্রবর্তীর নামই হয়ে গিয়েছিল মহরৎ চক্রবর্তী। তিনি একসঙ্গে দু-তিনটি ছবির মহরৎ করতেন। কিন্তু কোনও ছবিই হল পর্যন্ত পৌঁছত না। খচাখচ স্টিল ছবি তোলা হত। সংশ্লিষ্ট সকলেই জানতেন এসব হল চক্রবর্তী মশাইয়ের পরের খদ্দের ধরার টোপ। কিছু পরিচালক ছিলেন যাঁরা নতুন অবাঙালি প্রযোজকদের ধরে এনে প্রাণ ভরে স্বপ্ন দেখাতেন। আর বলতেন, বাংলা বছরের শুরুর দিনে ছবি করলে সিনেমা দেবীর আশীর্বাদে মা দুর্গা তাঁর পুজোর সময়ে আপনার ছবি ঠিক রিলিজ করিয়ে দেবেন। সেই পরিচালকদের শ্লোগানই ছিল এইরকম—‘পয়লা বৈশাখে মহরৎ, দেবীপক্ষে রিলিজ।’
এমনও হয়েছে হয়ত চিত্রানাট্য তৈরিই হয়নি। মহরতের জন্য একটি মাত্র সিন লিখে মহরৎ শট নেওয়া হয়েছে। পরে দেখা গেল গল্পের সঙ্গে সেই সিন মিলছে না। কিন্তু এমনই সংস্কার সেই সিনটাকে ফেলা যাবে না। টালিগঞ্জের প্রচলিত বিশ্বাস—মহরতের সিন ফেলতে নেই।
একবার মেদিনীপুর থেকে এক পান বরোজের মালিক এসেছেন ছবি করতে। মহরতের দিন ফ্লোরে প্রচুর সেলিব্রিটি, রাজনৈতিক নেতাদের ভিড়। পুলিস পেয়াদার ছড়াছড়ি। পরিচালক তাঁর প্রযোজক বরোজ মালিকের সঙ্গে সকলের পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন। মুহুর্মূহু ছবি উঠছে। যিনি পান চাষ ছাড়া জগতের আর কিছুই জানতেন না এইসব দেখে তাঁর মাথা গেল ঘুরে। পাশে বসা ঘোমটায় ঢাকা স্ত্রীকে ফিসফিস করে বলছেন, ‘টেঁপির মা, আমি জাতে উঠলুম, এবার ভোটে দাঁডিয়ে পঞ্চাৎ পোধান হব।’ একবার একজন প্রযোজককে এক পরিচালক ঘোল খাওয়ানো চেষ্টা করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। ছবির নাম ‘নিয়তির আক্ষেপ’। মহরতে নারকেল ফাটানো, ক্ল্যাপস্টিক ঠোকা হল। অবাক কাণ্ড! কিটকিট শব্দ করে ক্যামেরা চলছে কিন্তু ভেতরে ঢপর ঢপর করে কী যেন একটা নড়ছে। প্রযোজকের সন্দেহ হল। লাঞ্চ ব্রেকে প্রযোজক চেপে ধরলেন পরিচালককে, ‘যেটুক ছবি তুলেছেন দেখান।’ পরিচালক বললেন, ‘সেটা কী করে হয়? পরের স্লটের টাকা দিন দেখাব।’ প্রযোজক টাকা দিলেও পরিচালক টালাবাহনা করতে লাগলেন। ধৈর্যহারা প্রযোজক টান মেরে ফিল্মের ক্যান খুলে দেখেন ভেতরে নেগেটিভের রিলই নেই! তার বদলে উত্তম-সুচিত্রার দেয়ানেয়া ছবির ফেলে দেওয়া রিলের অংশবিশেষ!
ক্যামেরা ছাড়া শুধুমাত্র স্টিল ছবি তুলে পয়লা বৈশাখের মহরতও দেখেছি। কোনও প্রশ্ন ছাড়া এক শিফটের কাজের টাকা পেয়েই খুশি। অনেকে কালো টাকা সাদা করার জন্য বৈশাখের পয়লা দিনটাকে বেছে নিতেন। সেইসব প্রযোজকরা প্রায় গোটা টালিগঞ্জ এলাকাকে নিমন্ত্রণ করে আনতেন। বিয়েবাড়ির মতো ফ্লোর সাজত। হাতে হাতে ঘুরতো কোল্ড ড্রিঙ্কস, গোলাপ ফুল। খাবারের প্যাকেটের অঢেল আয়োজনে সকলে ধন্য ধন্য করত। ফিল্মপাড়ার চালু কথা—সিনেমা তৈরির নেশা সব নেশার সেরা। এই নেশায় অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছেন। এরকমই একজনকে দেখেছিলাম যিনি খ্যাত হয়েছিলেন ‘ক্ল্যাপস্টিক ডিরেক্টর’ নামে। মহরতের ক্ল্যাপস্টিক সিনটুকু তুলতেন তারপর ছবি শেষ করতে পারতেন না। বহুদিন পর তিনি একটি ছবি করেন, এমনই ভাগ্য ছবিটি সুপার ফ্লপ হয়। কিছুদিন চুপচাপ থাকার পর আশির দশকের শেষে বৃদ্ধ বয়সে আবার এলেন ইন্দ্রপুরীর ফ্লোরে। বন্ধুরা বললেন, ‘আবার ছবি করছ, এই বয়সে কী লাভ হবে! কত টাকা ক্ষতি হয়েছে বল তো!’ সেই নির্ভীক ‘ক্ল্যাপস্টিক ডিরেক্টর বলেছিলেন, ‘নেশা বল আর যাই বল—টালিগঞ্জে টাকা হারিয়েছে বলে কী শ্যামবাজারে খুঁজলে পাব? টাকা যেখানে হারিয়েছি সেখান থেকেই তুলব।’ শ্রীভেঙ্কটেশ ফিল্মসের (এখন এসভিএফ) প্রথম ছবি ‘ভাই আমার ভাই’-এর মহরতে তাক লাগিয়েছিল তিন ঘণ্টার বৈদিক যজ্ঞ। এনটি ওয়ান স্টুডিওর স্কোরিং রুমের গা লাগোয়া একটা পিপুলগাছকে লাল সুতো জড়িয়ে তার সামনে বসে তিন পুরোহিতের মন্ত্রোচ্চারণ সেদিনের স্টুডিওর চেহারাটাকে পাল্টে দিয়েছিল। তাদের ‘ঝিনুকমালা’, ‘সখি তুমি কার’ ছবির ক্ষেত্রেও একই দৃশ্য দেখেছি।
অম্লমধুর ঘটনার সাক্ষী থাকে স্টুডিওপাড়া। একবার এক বৈশাখী মহরতে ছবির পোস্টারে নামের অবস্থান নিয়ে বাংলা ছবির দুই মহারথী অঞ্জন চৌধুরী আর রঞ্জিত মল্লিকের সম্পর্কে ফাটল ধরে। মিঠুন চক্রবর্তীকে ছবির নামটি ছিল ‘বাঙালিবাবু’।
বাংলা সিনেমার সেই সোনার দিন আর নেই। সময়ের সঙ্গে অনেককিছুই হারিয়েছে। সেই সাবেক পয়লা বৈশাখের মহরতও আর হয় না। স্টুডিও পাড়ার সেই রীতি এখন শুধুই স্মৃতি।