সম্পত্তিজনিত বিষয়ে অশান্তি বৃদ্ধির আশঙ্কা, আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি। শেয়ার, ফাটকা, লটারিতে অর্থাগম, কর্মক্ষেত্রে গোলযোগের ... বিশদ
অদিতি বসুরায়: সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাস থেকে ছায়াছবি নির্মাণ করেছিলেন ১৯৮৪ সালে। মানে আজ থেকে ৩৪ বছর আগে। আপনি ঠিক ৩৪ বছর পরে আবার একই উপন্যাস থেকে ছবি তৈরি করলেন। ভবিষ্যতে কঙ্কনার কাছ থেকেও কি বাঙালি দর্শক এই উপন্যাস থেকে আরও একটি ছবির আশা রাখতে পারে?
ভবিষ্যতে কী হবে সেটা তো বলা যায় না। কঙ্কনার আদৌ ছবি করতে আর ইচ্ছে হবে কিনা তাও জানি না। আমি শুধু নিজের কথাটা বলতে পারি (হাসি)।
‘ঘরে বাইরে’ উপন্যাসকেই নির্বাচন করলেন কেন ছবির জন্য?
আমাকে অনেকেই বিশেষ করে কঙ্কনা অনেকবার জিজ্ঞেস করেছে কেন রবীন্দ্রনাথের গল্প নিয়ে ছবি করি না। তখন প্রথমেই ‘গোরা’র কথা মনে হয়েছিল। কিন্তু সেই সময়টাকে ধরতে গেলে ‘গোরা’ করা খুব কঠিন। তাছাড়া ‘গোরা’ বড্ড বেশি তাত্ত্বিক। তাই অনেকের পক্ষে বোঝা মুশকিল হবে। তবে আমার ছবিটিতে ‘গোরা’র উপাদান আছে। সন্দীপের মধ্যেই আছে। এই প্রসঙ্গে গৌরী লঙ্কেশ ও সুজাত বুখারির হত্যাকাণ্ডের খানিকটা প্রভাবও কাজ করেছে। গৌরীর মতো একজন চমৎকার হাসিখুশি ভদ্রমহিলা যিনি অসাধারণ লিখছিলেন প্রান্তিক মানুষদের নিয়ে, তিনি কার কী অসুবিধে করেছিলেন আমি বুঝতে পারি না। কিন্তু তাঁকে মেরে ফেলা হল। আমি সেদিন রাতে ঘুমাতে পারিনি। ঘটনাটা আমাকে খুব নাড়িয়ে দিয়েছিল। সেদিনই ভোরের দিকে আমি স্বপ্ন দেখি একজন তরুণ পরিচালক যে আবার সত্যজিত রায়ের ফ্যান, সে তার প্রথম ছবি করছে ‘ঘরে বাইরে’ নিয়ে কিন্তু তা এখনকার সময়ে দাঁড়িয়ে। এই স্বপ্নের রেশ অনেকক্ষণ ছিল এবং আমি বুঝতে পারলাম যে আমাকে আবার ছবি করতে হবে আর ওই তরুণটি আসলে আমি। আমার প্রত্যেকবারই ছবি করার সময় মনে হয় যে এটাই আমার প্রথম ছবি। গোড়ায় তাই আমি ভেবেছিলাম যে ছবিটি করবই এইভাবে যে একজন নতুন পরিচালক ‘ঘরে বাইরে’ করছে। কিন্তু পরে মনে হল, সেটা করতে গেলে অনেক জটিল হয়ে যাবে বিষয়টা। তাই এই ছবিটা সোজাসুজি ভাবে বলতে গেলে, একটা ত্রিকোণ প্রেমের ছবি। সেই সঙ্গে এই ব্যক্তিগত বিষয়কে বাইরের রাজনীতি কীভাবে আক্রান্ত করছে, তারও ছবি।
তার মানে এই ছবিতে রাজনীতির প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে?
রাজনীতির বাইরে এই ছবি যাবে কি করে বলুন? রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসটিতেও তো রাজনীতিই আছে। সেটা অবশ্য তখনকার দিনের রাজনীতি। সত্যজিত রায়ের ছবিতেও সেই একই জিনিস আছে। আমি এই যুগের কথা বলছি ছবিতে। তাই আমাকে এই যুগের রাজনীতিই তুলে ধরতে হয়েছে।
রাজনীতির প্রভাব থাকা প্রসঙ্গে বলি, আজকাল তো শাসকের বিরুদ্ধে কথা বললে নানাভাবে হেনস্তা হতে হয়। কিংবা গৌরী লঙ্কেশের মতো পরিণতির জন্য তৈরি থাকতে হয়। আপনার এই ছবিতে যদি সেরকম কিছু থেকে থাকে, তবে আপনাকেও তো রাষ্ট্রের রোষে পড়তে হতে পারে। সেই ব্যাপারটা সম্বন্ধে কী ভাবছেন?
আমি ঠিক এইভাবে ভেবে ছবি করি না। তাছাড়া আমার বলার মধ্যে জঙ্গি ভাবটাও থাকে না। এই ছবিতে আমি দক্ষিণপন্থা, বামপন্থা সবটাই দেখিয়েছি নিখিলেশের মধ্যে। তবে সেটা কট্টর লেফটিস্ট মনোভাব নয়। সে সেকুলার। গৌরী লঙ্কেশের অনেকটাই প্রভাব আছে নিখিলেশের চরিত্রে।
যিশু সেনগুপ্ত, অনির্বাণ ভট্টাচার্য আর তুহিনা দাস আপনার ছবির প্রধান চরিত্রগুলোতে আছেন। এঁদের সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতা কেমন ?
অনির্বাণ তো আমারই আবিষ্কার। ‘আরশিনগর’ ছবিতে যিশু, অনির্বাণ দু’জনেই ছিল। এদের সঙ্গে কাজ তো করেছি আগে। আরশিনগরে যিশুকে নিতে অনেকেই আমাকে বারণ করেছিলেন যিশুর বক্সঅফিস নেই বলে। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম ওকেই নেব। আজ দেখুন যিশু কোথায় চলে গিয়েছে। এখন আমাকে বলাই হয়েছিল ওকে নেওয়ার কথা। তবে আমার ছবিতে সন্দীপ আর নিখিলেশ দু’জনের বন্ধুত্বটাকে দেখানো হয়েছে। সত্যজিত বা রবীন্দ্রনাথ যেটা দেখাননি। এটা প্রেমের গল্প যতটাই, ততটাই বন্ধুত্বেরও গল্প। অনির্বাণের অভিনয় ক্ষমতা সম্বন্ধে আমার কোনদিন কোনও সন্দেহ ছিল না। ওর প্রসঙ্গে আমার একটাই দুশ্চিন্তা ছিল। কারণ ও মেদিনীপুরের ছেলে আর আমার নিখিলেশ অক্সফোর্ড ফেরত! তাই ইংরেজিটা কীভাবে বলবে তা নিয়ে একটু চিন্তায় ছিলাম। কিন্তু অনির্বাণ অসম্ভব বুদ্ধিমান ও দক্ষ অভিনেতা। ও যে ইংরেজিটা বলল, কী করে যে বলল, আমিও ভাবতে পারিনি। ও যে কীভাবে করবে তা নিয়েও ও খুব চিন্তায় ছিল। অনেক রাতেই ও আমাকে মেসেজ করে জানতে চাইত, রিনাদি, আমি পারব তো? আমি বলতাম, সবে তো একটা ওয়ার্কশপ করেছিস। নিখিলেশের মতো জটিল চরিত্রকে এত তাড়াতাড়ি বুঝে যাবি, ভাবলি কী করে?(হাসি) তবে আমি বলব, নিখিলেশের চেয়েও এখানে জটিল চরিত্র সন্দীপ। তার কারণ হচ্ছে, রবীন্দ্রনাথ বা সত্যজিতের সন্দীপ অনেক বেশি একপেশে, সেখানে সন্দীপ জাস্ট একটা ভিলেন, এক অন্ধকার চরিত্র। আমার সন্দীপ সেরকম নয়। সে দেশের মানুষকে সমস্ত লিমিটেশন-সমেত গ্রহণ করতে জানে। সে দেশের সেবা করতে চায় খুব সৎভাবে। তুহিনা আমার ছবির বিমলা। সে এখানে দলিত মেয়ে। তাকে পরে নাম দেওয়া হয় বৃন্দা। সৃজিত আমাকে তুহিনা আর শ্রীনন্দার কাস্টিং সাজেস্ট করেছিল। ওকে আমি অ্যাকনলেজও করেছি। সৃজিত আমাকে বলেছিল তুহিনার চেহারায় একটা ‘দলিত কোশেন্ট’ আছে। তারপর একটা পার্টিতে আমি তুহিনাকে দেখি এবং আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলি। ও ভীষণ ভয় পাচ্ছিল। লোকেরা আমাকে ভয় পায় কেন, তা আমার মাথায় ঢোকে না। তবে ভয় পায়। তুহিনা ওরকম কালো, ওরকম সুন্দরী যে অন্যকিছু ভাবিইনি। আমি তো ওকে বলি, তোর জ্য-লাইনটাই এমন সুন্দর যে তোকে তো কিছু করতেই হয় না আলাদা করে। ও চমকে দেবে দর্শককে। ও একেবারে ‘বিমলা’ হয়ে উঠেছে। দেখে নেবেন।
রবীন্দ্রনাথের ছবিতে গানের ভূমিকা বেশ উল্লেখযোগ্য বিষয়। আপনার ছবিতে গান ব্যবহার করেছেন?
গানের ব্যবহার আছে। এখানে মনোময় গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের সুর দেওয়া বিদ্যাপতির গান। রশিদ খান গেয়েছেন রামদাসী মালহার-এর ওপর একটা গান। দুটোই বর্ষার গান।
সেই ‘থার্টিসিক্স চৌরঙ্গী লেন’ থেকে ‘ঘরে বাইরে আজ’ – এই জার্নিতে পরিচালক অপর্ণা সেন দর্শকদের রেসপন্স কীভাবে পেয়েছেন?
‘থার্টিসিক্স চৌরঙ্গী লেন’ করার সময় অপর্ণা সেন দর্শকের কথা ভাবতই না। কিন্তু এখন ভাবে। ভাবতে হয়। সত্যি বলতে কী, দর্শককে ক্রমশ পাল্টে যেতে দেখলাম চোখের সামনে। যদিও অনেক লোকের রুটিরুজির জোগান দেয় এই ইন্ডাস্ট্রি তবু বলি, এই বাংলা সোপ বা সিরিয়াল দর্শকের রুচিকে অনেকটাই নিম্নগামী করে ফেলেছে। যারা একসময় অজয় কর বা তপন সিংহর ছবি দেখেছে ভালোবেসে, তারা আজ আছে কিনা সন্দেহ! তবে এ নিয়ে খুব বেশি ভাবি না। আমার ছবির কিছু বাঁধা দর্শক আছে। তারা আমার ছবি দেখে এবং অপেক্ষা করে নতুন ছবির। সব ছবি তারা গ্রহণ করতে পারেনি, যেমন সতী বা আরশিনগর তাদের ভালো লাগেনি। তবু আমার ছবি দেখতে যায় তারা। এটা আশা করি তারা গ্রহণ করবে। এটা মূলত একটা ত্রিকোণ প্রেমের গল্প হিসেবেই দেখিয়েছি।
ত্রিকোণ প্রেম নিয়ে ছবি করলেন – ব্যক্তিগত জীবনে ত্রিকোণ প্রেমে বিশ্বাস করেন?
এইখানে একটা কথা আছে। মূল ব্যাপারটা হল – একজনের প্রতি আনুগত্য। আর প্রশ্ন হল ভালোবাসায় আনুগত্য থাকা উচিত কিনা। অনেকেই বলেন, ভালোবাসায় উচিত বলে কিছু হয় না। উচিত আর ভালোবাসা এই শব্দ দুটি পরস্পর বিরোধী।
একটা ছবি তৈরির ঝক্কি তো কম নয়। কী করে পারেন? বয়স কি বাধা হতে পারে বলে মনে হয়?
সত্যি বলছি, বয়সের কথা আমার মনে থাকে না। মনের জোরের জন্য আমার ঝক্কি সে রকম হয় না। কখনও কখনও চোট বা আঘাত পেলে বয়সের কথা মনে পড়ে যায়। এই যেমন তেরোই অক্টোবর আমি পড়ে গেলাম, হাঁটুতে লাগল এবং নি-ক্যাপটা ক্র্যাক করে গেল। শ্যুটিং চলছিল তখন। পুজোর মধ্যে ডাক্তার দেখালাম। একদম অ্যাঙ্কেল থেকে থাই পর্যন্ত একটা ব্রেস পরে থাকতে হল। সারাক্ষণ পা-টা সোজা করে রাখতে হচ্ছিল। ওই অবস্থায় পুরুলিয়া গেলাম গাড়ি করে। শ্যুটিং ছিল। হুইলচেয়ারে বসে কাজ করেছি। আমার বন্ধু সোহাগ সেন আমাকে ওই অবস্থায় দেখে বলল, তোর নাম রিনা না রেখে ব্যালেরিনা রাখতে হবে। বুঝতে পারিনি যে আমার স্পাইনেও লেগেছিল, যা পরে জানা গেল। এখন তাই মাঝে মাঝে মনে হয় আর ছবি না করে দেশ বেড়াতে যাই। লিখতেও ইচ্ছে করে খুব।
এই যে বয়সের কথাটা ভুলে যেতে পারেন – এর রহস্যটা কী?
আমি জানি না, জানেন (হাসি)। আমার বাঁচতেই খুব ভালো লাগে। আমি সবকিছুই খুব উপভোগ করি। আমার রান্না করতে ভালো লাগে, ঘর সাজাতে ভালো লাগে, নিজে সাজতে ভালো লাগে, আমার বেড়াতে যেতে ভালো লাগে, বই পড়তে ভালো লাগে। আমার নেটফ্লিক্স-এ সিনেমা দেখতে ভালো লাগে, স্ক্র্যাবল খেলতে ভালো লাগে, চেজ খেলতে ভালো লাগে। আমার যে কতকিছু ভালো লাগে বলে বোঝাতে পারব না। এই সব করতে করতে আর বয়সটার কথা মনে রাখার ফুরসত পাই না।