ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
দক্ষিণ কলকাতার একটি নামী স্কুলের অনতি দূরেই রমরমিয়ে চলছে একটি হুকা বার। তবে স্কুলের ইউনিফর্মে সেখানে প্রবেশ নিষেধ! তাতে কী! ইউনিফর্ম পালটে ফেললেই নিশ্চিত!
কলকাতার আরও বেশ কিছু জায়গায় বেশ ভালোই ব্যবসা করে খাচ্ছে হুকা বারগুলি। সাধারণত অভিজাত স্কুল-কলেজের পড়ুয়ারা ভিড় জমায় এই হুকা বারগুলিতে। আপাত নিরীহ এই হুকা বারগুলি সম্বন্ধে কিশোর-কিশোরী বা তরুণ-তরুণীদের ধারণা— এগুলি স্বাস্থ্যসম্মত এবং সিগারেট-এর একটি স্বাস্থ্যকর বিকল্প! কারণ এতে নাকি তামাক ব্যবহার করা হয় না। তাই তামাকের ক্ষতির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যায়। উপরন্তু হুকার সুগন্ধযুক্ত ধূমপানে বেশ আবেশ আসে শরীরে ও মনে। কতটা যুক্তিসম্মত এই ধারণা? সত্যিই কি হুকা বার সিগারেটের স্বাস্থ্যকর বিকল্প না কি সিগারেটের মতোই সমান ক্ষতি সাধিত হয় এখানে?
হুকা কী?
প্রথমে আসা যাক হুকাপানের কথায়। হুকা হল একটা জলভর্তি পাইপ বা নল যেটি মিষ্টি সুগন্ধযুক্ত এবং বিভিন্ন ফ্লেভারের তামাক সেবনের কাজে ব্যবহার করা হয়। এই পাইপ সাধারণত বেশ লম্বা হয় এবং তলায় থাকে একটি জল ও একটি তামাকের চেম্বার। এটি একাধিক ফ্লেক্সিবেল টিউব-এর সঙ্গে যুক্ত থাকে, যাতে একই হুকা থেকে একসঙ্গে একাধিকজন ধূমপান করতে পারে। এই তামাকের চেম্বার বা প্রকোষ্ঠটিতে একটি বাটিতে জ্বলন্ত চারকোল রাখা হয় এবং চারকোলগুলি তামাকের উপর স্থাপন করা হয়। তামাক এবং চারকোলের মাঝখানে একটি ছিদ্রযুক্ত অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল রাখা থাকে। চারকোল যখন তামাককে গরম করে তোলে, তখন তামাকে থেকে ধোঁয়া বের হয় এবং এই ধোঁয়া জলের মধ্য দিয়ে অতিক্রম করে বলে, তাপমাত্রা হারিয়ে ঠান্ডা হয়ে যায়। তাই সিগারেটের গরম ধোঁয়ার বদলে হুকা থেকে ঠান্ডা ধোঁয়া নির্গত হয়।
হুকার তামাক
হুকাতে যে তামাক ব্যবহার করা হয় তাকে মিষ্টি স্বাদের এবং সুগন্ধযুক্ত করার জন্য নানারকম ফলের শাঁস এবং মধু মেশানো হয়। পছন্দ অনুযায়ী নারকেল, পুদিনা বা কফির ফ্লেভারও মেশানো হয়ে থাকে। এই মিষ্টি স্বাদ ও নানারকম পছন্দের গন্ধ অল্পবয়সীদের কাছে হুকাকে আকর্ষণীয় করে তোলে।
হুকাপানের প্রচলন
হুকাপানের প্রচলন করেন হাকিম আব্দুল ফতে নামক একজন ভারতীয় ডাক্তার ১৬০০ শতকের প্রথম দিকে। তাঁর ভ্রান্ত ধারণা ছিল যে হুকার ধোঁয়া জলের মধ্য দিয়ে অতিক্রান্ত হয় তাই এর দ্বারা ফুসফুসে কোন ক্ষতি হয় না।
ক্ষতি হয় কতটা?
এটা একটা প্রচলিত ধারণা যে হুকা থেকে যে ধোঁয়া নির্গত হয় তাতে নিকোটিন এবং অন্যান্য দূষিত পদার্থগুলি থাকে না। এটি সম্পূর্ণরূপে ভ্রান্ত। যদিও হুকা থেকে নির্গত ধোঁয়া নরম প্রকৃতির হয় এবং তাপমাত্রা কম থাকায় ফুসফুসের নরম কলাকোষগুলিকে আঘাত কম করে। কিন্তু তাতে হুকার ধোঁয়ায় উপস্থিত দূষিত পদার্থগুলির পরিমাণ তথা ক্যান্সার তৈরি করার জন্য তামাকে উপস্থিত ক্ষতিকর রাসায়নিকগুলির পরিমাণ কম হয় না।
হুকায় কী কী থাকে?
হুকাতে উপস্থিত কয়েকটি ক্ষতিকর রাসায়নিক হল—
কার্বন মনোক্সাইড
টার
আরসেনিক
ক্রোমিয়াম
কোবাল্ট
ক্যাডমিয়াম
নিকেল
ফর্মালডিহাইড
অ্যাসিট্যালডিহাইড
অ্যাক্রোলিন
লেড
পোলোনিয়াম নামক তেজষ্ক্রিয় পদার্থ।
এছাড়াও হুকাতে ব্যবহৃত চারকোল জ্বালালে, তা থেকে কার্বন মনোক্সাইড নানারকম ধাতব পদার্থ এবং ক্যান্সার সৃষ্টিকারী পলি অ্যারোমাটিক হাইড্রোকার্বন উৎপন্ন হয়, যা আরও নানারকম শারীরিক ক্ষতি সাধন করে।
সিগারেট বনাম হুকা
একটি সিগারেটে সাধারণত ৭-২২ মিলিগ্রাম নিকোটিন থাকে যার মধ্যে ১ মিলিগ্রাম শোষিত হয় শরীরে। হুকাতে কিন্তু ৭টি সিগারেটের সমান মাপের নিকোটিন জমা রাখা হয়।
ধূমপায়ীরা একটি সিগারেটে ২০ বার টান দিলে ৫০০-৬০০ মিলিলিটার ধোঁয়া সেবন করেন। সেখানে ৪৫ মিনিট টানা হুকা পান করলে ২০০ বার টান দিতে হয় এবং প্রায় ৯০০০ মিলিলিটার ধোঁয়া যার শরীরের ভিতরে।
সিগারেটের তুলনায় হুকাপানে প্রায় ৬ গুণ বেশি কার্বন মনোক্সাইড এবং ৪৬ গুণ বেশি টাব শরীরে প্রবেশ করে যার ক্ষতির মাত্রা মারাত্মক।
দেখা গিয়েছে, দিনে একবার হুকা পান করলে যে ক্ষতি সাধিত হয়, তা দিনে ২-১০টা সিগারেট পানের সমান।
সুতরাং হুকাপানে শরীরের ক্ষতি কম তো হয়ই না উপরন্তু সিগারেটের থেকেও বেশি ক্ষতি সাধিত হয় শরীরে।
হুকাপানের সঙ্গে রোগের ঝুঁকি
হুকাপান করলে যে রোগগুলির ঝুঁকি বেড়ে যায় সেগুলি হল
মুখের ক্যান্সার
ফুসফুসের ক্যান্সার
পাকস্থলীর ক্যান্সার
ইসোফেগাসের ক্যান্সার
হৃৎপিণ্ডের রোগ ও ফুসফুসের অন্যান্য সমস্যা।
নানারকম সংক্রমণ জনিত রোগ
আজকাল কিছু কিছু কিছু হুকা বার দাবি করে, তারা হুকাতে নানারকম ফ্লেভার ব্যবহার করে। তামাক কোনওভাবেই ব্যবহার করে না।
তাই তামাকজনিত ক্ষতি এখানে সাধিত হয় না। তর্কের খাতিরে সে কথা যদি মেনেও নেওয়া যায়, তবুও চারকোলের ধোঁয়াতে প্রচুর পরিমাণে উপস্থিত কার্বন মনোক্সাইড এবং টারের দূষিত পদার্থজনিত ক্ষতিকে এড়ানো সম্ভব কি? তাই অন্যান্য তামাকজনিত বদঅভ্যাসের মতো হুকাপানও একটি বদভ্যাস।
ভারতের মেট্রো শহরগুলির পাশাপাশি সমগ্র পৃথিবীর ছোট-বড় শহরগুলিতেও হুকাপান দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। অবিলম্বে সতর্ক না হলে তামাকজনিত শারীরিক ক্ষতির পরিমাণ বেড়েই চলবে এবং মারণ রোগগুলির পরিসংখ্যানও বেড়ে চলবে।