গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
ক্যালেন্ডারে বছরের পর বছর বদলে গেলেও, রাজ্যের জলছবি কিন্তু বদলায় না। বৃষ্টির দাপটে রাজ্যের উত্তর ভাগ যেমন ভেসেছে, কয়েক দফা বৃষ্টিতে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় ছিল হাঁটু জল। অসংখ্য মানুষ জল যন্ত্রণার শিকার। তবে এসবের মধ্যে সবচেয়ে বড় মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারে বিভিন্ন ধরনের জলবাহিত রোগের বাড়বাড়ন্ত। তাই এই পরিস্থিতিতে সতর্কতা প্রয়োজন।
সমস্যার গোড়ায়
আমাদের দেশ তথা রাজ্যের গ্রামের এবং শহরের পানীয় জলের ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। গ্রাম বাংলায় অনেক মানুষ পুকুর, ঝিল, কুয়োর জল পান করেন। সমস্যা হল, বৃষ্টির কারণে মল, মূত্র অন্যান্য আবর্জনা এসে এই পানীয় জলের উৎসে মেশে। পানীয় জল সংক্রামিত হয়। এবার সেই অপরিশোধিত জলপান করলে মানুষের বিভিন্ন ধরনের সমস্যায় আক্রান্ত হওয়াই স্বাভাবিক।
অন্যদিকে শহরে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পাইপের মাধ্যমে পানীয় জল পৌঁছে দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে সাধারণত নদীর জলকে বিভিন্ন উপায়ে পরিশোধিত করে মানুষের কাছে জল পৌঁছানো হয়। ফলে এই জলে সংক্রমণের আশঙ্কা তুলনায় অনেকাংশে কম। তবে এক্ষেত্রেও জল পরিশোধনে খামতি থাকলে সমস্যা হতে পারে। কারণ এখন দেশের বেশিরভাগ বড় নদীই দূষণের শিকার। এবার কোনও কারণে সেই নদীর সংক্রামিত জল সঠিক পদ্ধতিতে পরিশোধিত না করে মানুষের বাড়ি পৌঁছে গেলেই সমস্যা। এক্ষেত্রে সংক্রামিত জলপান করে মানুষ বিভিন্ন জলবাহিত রোগে আক্রান্ত হন। এই ধরনের সমস্যা অনেকসময় মহামারীর আকার নেয়। আমাদের রাজ্যেও এই ধরনের ঘটনার সংখ্যা ভুরি ভুরি। আবার শহরাঞ্চলে অনেকসময় পানীয় জলের পাইপ ফেটেও জলে সংক্রমণ হয়। মূলত বর্ষাকালে পানীয় জলের পাইপ লাইনে ফাটলের মাধ্যমে নোংরা জল প্রবেশ করে। তখন পানীয় জল সংক্রামিত হয়। সেই জলপান করেও বহু মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়েন।
এক নজরে বিভিন্ন জলবাহিত অসুখ
ব্যাকটেরিয়াল ডায়ারিয়া—ই-কোলাই ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণের কারণে মূলত মানুষ এই সমস্যায় আক্রান্ত হন। সাধারণত এই ধরনের ব্যাকটেরিয়া অন্ত্র বা ইনটেসটাইনে ইনফেকশন তৈরি করে। ফলে মানুষ ডায়ারিয়াতে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে রোগী বারংবার তরল মলত্যাগ করেন। পাশাপাশি বমি, পেট কামড়ানো, জ্বরের মতো সমস্যাও দেখা দিতে পারে। এই সমস্যার প্রাথমিক চিকিৎসা হল ওআরএস। ডায়ারিয়ার সময় শরীরকে রিহাইড্রেট করার জন্য ওর্যাল রিহাইড্রেশন সলিউশন বা ওআরএসের কোনও জুড়ি নেই। ডায়ারিয়া শুরু হওয়ার সময় থেকেই ওআরএস মেশানো জলপান করলে ভালো ফল দেয়। এক্ষেত্রে এক প্যাকেট ওআরএস এক লিটার জলে গুলে নিতে হবে। তবে সমস্যা খুব বেড়ে গিয়ে থাকলে অবশ্যই অপেক্ষা না করে চিকিৎসকের কাছে যাওয়া উচিত।
অনেকের আবার পায়খানা, বমির সমস্যায় ওষুধের দোকানে বলে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার অভ্যেস রয়েছে। এই অভ্যেস কিন্তু অত্যন্ত বিপজ্জনক। এর থেকে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কাই বেশি। তাই ওষুধের দোকানে জিজ্ঞাসা করে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার অভ্যেস ছাড়তে হবে। বদলে এমন সমস্যা হলে প্রাথমিক পর্যায়ে ওআরএস পান করা দরকার। সমস্যা বেগতিক বুঝলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকই রোগীর শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী সঠিক পরামর্শ দিতে পারেন।
আন্ত্রিক—আমাশার একটি বিশেষ ধরন হল আন্ত্রিক। মূলত জলবাহিত ব্যাকটেরিয়া থেকেই এই সমস্যায় মানুষ আক্রান্ত হন। অনেকসময় একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের অনেক মানুষ একসঙ্গে আন্ত্রিকের করলে পড়েন। এক্ষেত্রে রোগী বারংবার রক্ত যুক্ত মলত্যাগ করেন। সঙ্গে পেটে ব্যথা থাকে। এই জটিল সমস্যা সমাধানে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
জন্ডিস— এই সময়ে জলবাহিত হেপাটাইটিসের সংক্রমণ বাড়তে থাকে। মূলত হেপাটাইটিস ই ভাইরাসটিই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এই সমস্যার নেপথ্যে দায়ী। তবে সংখ্যায় কম হলেও, হেপাটাইটিস এ ভাইরাস জলবাহিত হয়ে মানুষের শরীরে সমস্যা তৈরি করতে পারে।
সাধারণত, সেপ্টেম্বর মাস নাগাদই জলবাহিত হেপাটাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ে। কারণ এই ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করার পর প্রায় চার থেকে ছয় সপ্তাহ বাদেই রোগ লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। এই সময়টি হল জলবাহিত হেপাটাইটিসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড। এক্ষেত্রে রোগীর গা-হাত-পা ম্যাজ ম্যাজ করে, চোখ হলদে হয়ে যায়, গা বমি ভাব দেখা দেয়। এছাড়া শরীরে আরও কিছু লক্ষণ ফুটে উঠতে পারে। হেপাটাইটিসের মতো অসুখে প্রথম থেকেই সঠিক চিকিৎসা দরকার। তাই রোগীর শরীরে এমন লক্ষণ দেখা দিলে, যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে আনতে হবে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ খাওয়া উচিত নয়।
টাইফয়েড—জলবাহিত অসুখের তালিকায় টাইফয়েডের নামটি বিশেষভাগে উল্লেখযোগ্য। সামলোনেল্লা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ থেকে মানুষ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়। মূল রোগ লক্ষণ হল জ্বর। এক্ষেত্রে জ্বরের মাত্রা থাকে বেশি। পাশাপাশি দুর্বলতা, মাথাব্যথা, পেটে ব্যথা, বারবার মলত্যাগের মতো উপসর্গও দেখা দিতে পারে। এই রোগের নির্দিষ্ট চিকিৎসা রয়েছে। প্রয়োজন শুধু যত শীঘ্র সম্ভব রোগ নির্ণয়ের। তাই টাইফয়েডের লক্ষণ দেখা দিলেই অবশ্যই চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে।
অনেকসময় রোগীর টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিস একসঙ্গে হতে পারে। এক্ষেত্রে প্রাথমিকভাবে রোগীকে টাইফয়েডের লক্ষণ নিয়ে চিকিৎসকের কাছে আনা হয়। পরে হেপাটাইটিস ধরা পড়ে। তবে এক্ষেত্রেও তেমন দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। চিকিৎসকের পরামর্শ মতো চললে সমস্যার সমাধান সম্ভব।
জলবাহিত রোগ থেকে বাঁচতে
১. জলবাহিত রোগের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার একমাত্র উপায় হল পরিশুদ্ধ পানীয় জলপান করা।
২. গ্রামের দিকে যেই পুকুর বা জলাশয়ের জলপান করা হয়, সেই জলে স্নান, কাপড় কাচা বন্ধ করতে হবে।
৩. সবথেকে ভালো হয় বর্ষার সময় টিউবওয়েলের জলপান করতে পারলে। মোটামুটি ২০০ ফিট বা তার বেশি গভীর টিউবওয়েলের জলে সংক্রমণের আশঙ্কা খুব কম। আর অপরদিকে শহরাঞ্চলে পরিশোধিত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করা ছাড়া কোনও উপায় নেই।
৪. কোনও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে নির্দিষ্ট জলবাহিত অসুখের প্রকোপ বাড়লে সেখানকার মানুষ এবং প্রশাসনকে অবশ্যই আরও বেশি সতর্ক থাকতে হবে।
৫. সবথেকে ভালো হয় জল ফুটিয়ে পান করলে। তবে সব সময় জল ফুটিয়ে পান করা সম্ভব নয়। বিশেষত আমাদের মতো দেশে সকল মানুষ জ্বালানি পুড়িয়ে জল ফুটিয়ে পান করবেন, এটা ভাবাই অবাস্তব। তাই গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সরকারকেই মানুষের কাছে পরিশোধিত পানীয় জল পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অন্যথায় জলবাহিত রোগ প্রতিরোধ প্রায় অসম্ভব।