কোনও কিছুতে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে ভাববেন। শত্রুতার অবসান হবে। গুরুজনদের কথা মানা দরকার। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় সুফল ... বিশদ
প্রথমে রৈবতকের কথা বলি। রৈবতক এখন গিরিনারায়ণ বা গিরনার নামে প্রসিদ্ধ। আমেদাবাদ থেকে ভেরাবলের (প্রভাস তীর্থ) পথে জুনাগড়ে এর অবস্থান। আমি অবশ্য প্রথম এখানে এসেছিলাম ওধা থেকে রাজকোট হয়ে জুনাগড়ে। গিরনারের পাদদেশে তখন ভবনাথের মেলা। শিবরাত্রির সময়। তাই গিরনারে উন্নতমানের সনাতন ধর্মশালা থাকা সত্ত্বেও আমি জুনাগড়েই স্টেশনের কাছে বালিয়া ধর্মশালায় রয়ে গেলাম।
সেদিনটা ধর্মশালায় থেকে পরদিন খুব সকালে রওনা দিলাম গিরনার পাহাড়ে অম্বাজি দর্শনে। সকাল সাতটায় যখন রওনা দিলাম, তখনও আকাশ অন্ধকার।
এক সময় পৌঁছলাম গিরনারে। উচ্চতা ৩ হাজার ৬৬৬ ফুট। ৭০ বর্গমাইল জুড়ে এর অবস্থান। এই পর্বতে মোট পাঁচটি শৃঙ্গ আছে। অম্বাজি, গোরক্ষনাথ, দত্তাত্রেয়, ওখাদ ও কালকা। এর মধ্যে সর্বোচ্চ শৃঙ্গ হল গোরক্ষনাথ।
এই পর্বতে দেবী দুর্গা সর্বক্ষণের জন্য বিরাজ করছেন। তাই গিরনার পর্বতে অম্বাজি এক মহাতীর্থ। বছরের সব সময়েই এখানে যাত্রীর ঢল নামে। মেলার সময় তো কথাই নেই। দেবী অম্বিকা কেন এখানে সর্বক্ষণ বিরাজ করেন? কাহিনী এই রকম—
হর-পার্বতীর বিবাহের সময় নিমন্ত্রিত দেবতাদের আদর-আপ্যায়নের ভার পড়েছিল হিমালয়পুত্র গিরির ওপর। গিরির নিষ্ঠায় এবং আন্তরিকতায় দেবতারা অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলেন এবং গিরিকে বর দিয়েছিলেন, আজ থেকে তুমি নারায়ণস্বরূপ হবে। শুধু তাই নয়, এখানে বসে তপস্যা করলে তপস্বীরাও সিদ্ধিলাভ করবে। সেই থেকেই এই পর্বতের নাম হয় গিরিনারায়ণ। সেকালে পর্বতের পাখা ছিল। তাই তারা ইচ্ছেমতো স্থানান্তরে গেলে বহু জনপদ নষ্ট হয়ে যেত। সে কারণে একবার দেবরাজ ইন্দ্র বজ্র দিয়ে সব পাহাড়ের ডানা কেটে দিতে লাগলেন। গিরিনারায়ণ তখন ইন্দ্রের বজ্রের ভয়ে এইখানে এসে সমুদ্রের তলদেশে আত্মগোপন করে রইল। এদিকে গিরিকে দেখতে না পেয়ে পার্বতীর মন তো খারাপ হয়ে গেল খুব। ভাইয়ের শোকে তিনি দারুণ কান্নাকাটি শুরু করে দিলেন। অবশেষে শিব ও নারায়ণ পার্বতীর কান্না থামাবার জন্য চারদিকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াতে লাগলেন গিরিনারায়ণকে। কিন্তু অনেক খুঁজেও যখন তার কোনও সন্ধান পেলেন না, শিব তখন ধ্যানযোগে জানতে পারলেন গিরি সমুদ্রের তলদেশে আত্মগোপন করে আছে। জানতে পেরেই সমস্ত দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে সমুদ্রের ধারে এসে স্তব-স্তুতি করতে লাগলেন। দেবতাদের স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে সমুদ্র বলল, ‘হে দেবগণ! আমি আপনাদের বন্দনায় অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছি। এখন বলুন আপনারা কী চান? দেবতারা বললেন, ‘আমরা জানতে পেরেছি গিরিনারায়ণ তোমার অথৈ জলে আত্মগোপন করে আছে। আমরা তাকে মুক্ত করতে এসেছি। তুমি যদি এখান থেকে পাঁচ যোজন দূরে সরে যাও তাহলেই গিরি মুক্ত হতে পারে। সমুদ্র তাই করল। দেবতাদের অনুরোধে পাঁচ যোজন পিছিয়ে গেল। ইন্দ্রও গিরিনারায়ণকে আশ্বস্ত করলেন ডানা কাটবেন না বলে। শুধু বললেন, ‘প্রলয়ের সময়ে আমি তোমাকে কাজে লাগাব।’ পার্বতী ভাইকে ফিরে পেয়ে খুশি হলেন খুব এবং সেই দিন থেকেই তিনি এই পর্বত শিখরে বসে ভাইকে রক্ষা করে চলেছেন। দেবগণ এই পর্বতে অম্বিকা বা অম্বাজিকে প্রতিষ্ঠা করলেন। তাই সদা জাগ্রত এই দেবীতীর্থে সবাই আসে মায়ের আশীর্বাদ নিতে।
পাহাড়ের নীচে ভৈরব ভবনাথকে দর্শন করে যখন পর্বতারোহণ শুরু করছি, তখন ভাবতেও পারিনি এই পাহাড়ে ওঠা কতখানি কষ্টের ব্যাপার। আগেই জেনেছিলাম গিরনারে ওঠার জন্য একটি কম দশ হাজার সিঁড়ি আছে। ওই একটি সিঁড়ি নির্মাণের সময় নানারকম বাধা-বিপত্তি ও অলৌকিক ঘটনা হওয়ায় ওটি আজও অসমাপ্ত আছে। এই পর্বতে আরোহণ করা খুবই কষ্টকর। একই দিনে ওঠা-নামায় অধিক পরিশ্রম হয় বলে অনেকে রাতে পাহাড়ে উঠে বিশ্রাম নেন এবং পরদিন সকালে নেমে আসেন।
গিরনার পাহাড়ে অম্বাজি দর্শনে যাওয়ার জন্য ডান্ডি, কান্ডি, ডুলি সবেরই ব্যবস্থা আছে। আমি কিন্তু কোনও কিছুর সাহায্য না নিয়েই পাহাড়ে উঠেছিলাম। শুধু আমি নই, দলে দলে যাত্রীরা দর্শনে চলেছে। ধ্যানগম্ভীর গিরনারের সোপান বেয়ে উঠতে উঠতে দম যেন বন্ধ হয়ে গেল। তবু মায়ের নাম করে বিশ্রাম নিতে নিতে উঠতেই লাগলাম।
এক সময় পাহাড়ের উপর এক মন্দিরময় স্থানে এসে পড়লাম। এখানে রাজা সাম্প্রতের তৈরি নেমিনাথের মন্দির আছে। সে যে কী অপূর্ব শিল্পকলার বিকাশ ঘটেছে সেখানে, তা বলে বোঝাবার নয়। পাশেই আছে ঋষভদেবের মন্দির। এরপর আমিজারা পার্শ্বনাথের মন্দির, তারপর কুমার পালের। এর পরের মন্দির রাজা সাম্প্রতের। এটি রণকদেবীমহল নামে পরিচিত।
এইসব দেখে আরও উচ্চস্থানে গোমুখী গঙ্গা নামে এক কুণ্ডে এসে পৌঁছলাম। অনেকে এখানে স্নান করে অম্বাজিকে দর্শন করেন। এখানে আছেন গঙ্গেশ্বর মহাদেব, গঙ্গাদেবী ও বটুকভৈরব। আর আছে বিভিন্ন দেবতার চব্বিশটি চরণচিহ্ন।
গোমুখ থেকে আরও একটু উচ্চস্থানে ওঠার পরেই এসে পৌঁছলাম অম্বাজিতে। অম্বাজির মন্দির দর্শন মাত্রেই যাত্রীরা ধ্বনি দিয়ে উঠল, ‘বোল্ অম্বেমাতা কি জয়। বোলো গিরনার বাবা কি জয়। বোল্ গুরু দত্তা জয়।’
যাত্রীদের ধ্বনিতে এবং পরিবেশের রমণীয়তায় আনন্দে ভরে উঠল মন, পূজাপ্রাঙ্গণ থেকে ডালি নিয়ে লাইনে দাঁড়ালাম। বহু যাত্রীর ভিড় এখানে। ভিড় ঠেলে ভেতরে ঢুকে রক্তবস্ত্র পরিহিতা দেবীকে দর্শন করেই ভাবাবেগে আপ্লুত হলাম। দেবী দুর্গা যে পাষাণ প্রতিমা অম্বিকা মূর্তিতে আমার সম্মুখে বিরাজমান সে কথা স্মরণ হতেই নিজের মধ্যে নিজেকেই যেন হারিয়ে ফেললাম আমি।
(ক্রমশ)
অলংকরণ : সোমনাথ পাল