বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
শহরটি হিমাচলপ্রদেশ ও হরিয়ানার সীমান্তে হলেও এটি হরিয়ানার মধ্যেই পড়ে। এখানে থাকার জায়গাও অনেক আছে। তবে সেগুলি খুব একটা উন্নতমানের নয়।
প্রথমবার যখন এই দেবী কালিকাকে দর্শন করতে এসেছিলাম তখন এখানকার একজন সেবায়েত বলেছিলেন, ‘কলকাতার কালীঘাটে যে মাকালী আছেন তিনি কিন্তু ৫১ পীঠের অন্তর্গত নন। আসল পীঠস্থান হল এখানেই। বিষ্ণুচক্রে খণ্ডিত সতী অঙ্গ হিমাচলে ছাড়া কলকাতায় পড়তে যাবে কেন?’
কথায় কথা বাড়ালাম না। হতেও তো পারে। আমার কাছে অবশ্য দুই-ই সমান। তিনিও মা, ইনিও মা।
এর ঠিক তিন বছর পরে আর একবার কালিকা দর্শনে কালকায় গেলে তখনকার যিনি পুরোহিত তিনি আমার প্রশ্ন শুনে বলেছিলেন, ‘না না। কেউ আপনাকে মিসগাইড করেছে। কলকাতার কালীঘাটের মা কালীই হলেন ৫১ পীঠের অন্তর্গত সতীপীঠ। এখানকার যে কালিকা দেবী তা উপপীঠ হিসেবেই খ্যাত। এখানে সতীর কেশগুচ্ছের সামান্য কিছু অংশ পড়েছে মাত্র। সারা ভারতের মানুষ পীঠ দর্শনে কালীঘাটে যায়। আমি নিজেও বেশ কয়েকবার গিয়েছি। আর সতী অঙ্গ তো শুধু হিমালয়ে নয় সারা ভারতের নানা স্থানে ছড়িয়ে আছে। বেলুচিস্তানে করাচির কাছে হিঙ্গুলায় দেবীর ব্রহ্মরন্ধ্র পড়েনি?’
অকাট্য যুক্তি, তাই মনের সংশয় দূর হল।
বৈষ্ণোদেবীর মতো এখানেও দেবীর পিণ্ডিরূপ। তবে কিনা এই উপপীঠে বহিরাগত তীর্থযাত্রীদের গমনাগমন নেই বললেই চলে। শুধু স্থানীয় মানুষরাই আসেন দলে দলে পুজো দিতে। সবাই আম্বালা বা কালকায় এসে টয় ট্রেনে অথবা বাসে সিমলার দিকে রওনা হল। তাই কালিকাজির দর্শনার্থী খুবই কম।
তবুও প্রভাবশালিনী এই দেবীর মন্দির এলাকাটি বেশ জমজমাট। মন্দির খুব একটা সুরম্য না হলেও আরও সুন্দর করে গড়ে তোলার কাজ শুরু হয়েছে। বাজারের প্রধান রাজপথ ধরে কিছুটা গেলেই ডানদিকে সুবৃহৎ তোরণ। এরপর পূজা সামগ্রীর দোকানের পাশ দিয়ে আরও কিছুটা গেলে দেবীর মন্দির। মূল মন্দিরের পিছনে ভৈরব ও অন্যান্য অনেক দেবদেবীর মূর্তি আছে।
শোনা যায়, প্রাচীনকালে জয়সিংহদেব নামে এক রাজা ছিলেন। তিনিই এখানে কালিকা দেবীর একটি মূর্তি স্থাপন করে দেবীর পিণ্ডিরূপ ও প্রতিমার পূজা অর্চনা করতেন। একবার নবরাত্রের সময় রাজমহলের রমণীরা যখন একজোট হয়ে নেচে নেচে দেবীর স্তবগান করছিলেন দেবী কালিকাও তখন দিব্য রমণীরূপ ধারণ করে তাঁদের দলে যোগ দিয়ে নাচগান করতে লাগলেন।
দৈবক্রমে মহারাজ জয়সিংহদেবও উপস্থিত ছিলেন সেখানে। দেবী ভগবতীর লীলা তিনি বুঝতে পারলেন না। দেবীর মধুর কণ্ঠস্বর ও দিব্যরূপ দেখে মোহিত হয়ে গেলেন। নাচগানের পর্ব শেষ হতেই রাজা কামাতুর হয়ে হাত ধরলেন দেবীর। দেবী বললেন, ‘আমি তোমার ওপর প্রসন্ন হয়েছি রাজা। বলো, কী বর চাও তুমি?’ রাজা চিনতে পারলেন না দেবীকে। তাই প্রেম নিবেদন করে বললেন, ‘আমি তোমাকে বিবাহ করতে চাই সুন্দরী।’
দেবী তখন ক্রুদ্ধা হয়ে শাপ দিলেন রাজাকে, ‘তোমার এতদূর স্পর্ধা যে আমাকে তুমি বিবাহ করতে চাও? যে রাজ্যের অধিকারে তোমার এত প্রতিপত্তি সেই রাজ্য-সহ অচিরেই তুমি ছারখার হয়ে যাবে।’ এই বলে দেবী অদৃশ্য হলেন।
দেবীর অন্তর্ধানের সঙ্গে সঙ্গেই মন্দিরের ভেতর থেকে ঘন ঘন সিংহগর্জন শোনা যেতে লাগল। রাজা জয়সিংহ’র কামনার ঘোর তখন কেটে গেলেও দেবীর অভিশাপ ফলবতী হতে শুরু করেছে। দুলে উঠেছে চারদিক, শুরু হয়ে ধ্বংসলীলা। কালিকা মূর্তিও ক্রমশ প্রবেশ করেছে পাহাড়ের মধ্যে। মন্দিরের পিছনদিকেই হিমগিরির অরণ্যে এক মহাত্মা থাকতেন। প্রমাদ বুঝে তিনি ছুটে এসে অনেক স্তবস্তুতি ও আরাধনা করে শান্ত করলেন দেবীকে। ততক্ষণে দেবীমূর্তির সারা শরীর পাহাড়ের মধ্যে লেপটে গিয়ে শুধু মুখখানি প্রকট হয়ে রয়েছে মাত্র। বর্তমানে যে মন্দির তা দেবীর অর্ধপ্রোথিত রূপকে কেন্দ্র করেই।
এই ঘটনার কিছু পরেই দেবীর শাপপ্রভাবে বহিঃশত্রুর আক্রমণে দুই পুত্রসহ জয়সিংহদেব নিহত হলেন। এছাড়াও শত্রুরা কালকা নগরীকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে বিদায় নিল। এমনভাবে ধ্বংস হল যে রাজধানীর আর কোনও চিহ্নই রইল না। এইভাবে বহুবছর কেটে যাওয়ার পর আধুনিক সভ্যতার সংস্পর্শে এলে কালকা আবার নতুন করে গড়ে উঠল, মাতৃমন্দির জেগে উঠল ভক্ত যাত্রীদের পূজা অর্চনাতে। আরতি বন্দনায় ও শঙ্খ ঘণ্টার ধ্বনিতে মা আবার শান্তরূপা হলেন।
চণ্ডীগড় অথবা সিমলায় এলে দেবী কালিকাকে দর্শন করা প্রত্যেকেরই উচিত। এছাড়াও কালকা থেকে সাড়ে চার কিমি দূরে পিঞ্জোর উদ্যানের আকর্ষণও নেহাত কম নয়। এই উদ্যান যে শুধুই পুরাণপ্রসিদ্ধ তা নয় মহাভারতীয় যুগে এর নাম ছিল পঞ্চপুর। পাণ্ডবদের দ্বাদশবর্ষ বনবাসের সময় তাঁরাও এসেছিলেন এখানে।