কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
দীনবন্ধু মিত্র সেইসময় কর্মসূত্রে যশোরে বসবাস করেন। তাঁর বাড়ির খুব কাছেই এক কুলীন বৃদ্ধের বাড়ি। সদ্য সেই বৃদ্ধের তরুণী স্ত্রী কয়েকদিনের জ্বরে ভুগে গত হয়েছেন। তাঁদের একটি আট ন-বছরের কন্যা সন্তান রয়েছে। স্ত্রী রোগ শয্যায় শুয়ে বৃদ্ধ স্বামীর দুটি হাত ধরে অনুরোধ করে বলেছিলেন, তুমি খুকির মুখ চেয়ে আর বিয়ে করো না। তুমি যদি আবার বিয়ে কর সৎমা এসে খুকির ওপর খুব অত্যাচার করবে। যা আমি মরেও সহ্য করতে পারব না। বৃদ্ধ মৃত্যু পথযাত্রী স্ত্রীর মাথায় হাত রেখে বলেছিলেন, তুমি শান্তিতে যাও, আমি কথা দিলাম আর বিয়ে করব না। আর বিয়ে করবই বা কেন। আমি তো কুলীন ব্রাহ্মণ। তুমি আমার কত তম স্ত্রী— তাই তো আমার মনে নেই! অসহায়, মৃত্যুপথযাত্রিণী মহিলার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়েছিল কয়েক ফোঁটা অশ্রু।
স্ত্রী মারা গিয়েছেন প্রায় পাঁচ-ছ’বছর আগে। সংসারের হাল এখন খুকির হাতে। বৃদ্ধ পিতার সেবা-যত্ন, তামাক সেজে দেওয়া থেকে সংসারের সমস্ত কাজ সে নিজের হাতেই করে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই সে লেগে পড়ে কাজে।
একদিন সকালবেলায় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ কন্যাকে বললেন, শোনো, আজ দু’জন অতিথি আমার বাড়িতে আসবেন। তুমি তাঁদের সামনে কখনও আসবে না। পিতার এই কথা শুনে কিশোরী কন্যার কৌতূহল প্রবল ভাবে বেড়ে গেল। অতিথিরা আসার পর সে আড়িপেতে তাঁদের কথা শুনে বুঝল, তার বৃদ্ধ পিতা আবার বিয়ের পিঁড়িতে বসতে চলেছেন। মেয়েটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। দুপুরে বাবাকে খাইয়ে পাশের আমবাগানে গিয়ে বহুদিন বাদে মৃতা মায়ের জন্য অনেকক্ষণ কেঁদে বলল, মা, তুমি কোথায় আছ আমি জানি না। যদি আমার কথা শুনতে পাও তাহলে আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো।
একদিন সকালে তাঁর পিতা আবার বিয়ে করে নতুন বউ নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। সৎমা সতীন কন্যার থেকে এক বছরের ছোট। তা সত্ত্বেও মায়ের যে কোনও হুকুম তামিল করার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে থাকত। এইভাবে কেটে গেল মাস ছয়েক। এইবার সৎমা তার স্বরূপ প্রকাশ করল। শুরু হল প্রবল অত্যাচার ও স্বামীর কাছে অহরহ নালিশ— এ আপদকে যত তাড়াতাড়ি পারেন বিদেয় করুন। পাত্রের বয়েস যদি বেশি হয় তাতেও কোনও ক্ষতি নেই। আপনিও তো আমার থেকে কত বড়। আমার বাবা কী আপনার হাতে আমাকে সমর্পণ করতে কোনও দ্বিধা করেছেন। তাহলে আপনি কেন এতবড় মেয়েকে বাড়িতে বসিয়ে রেখেছেন। যত তাড়াতাড়ি পারেন একে বিদেয় করুন! সৎমায়ের কথা শুনে কিশোরী মেয়েটি কেঁপে উঠল। ছুটল তার শেষ ভরসাস্থল — সেই আমবাগানে। আবার মৃতা মায়ের কাছে তাঁর সেই প্রাত্যহিক নিবেদন পেশ করল— মা আমাকে তোমার কাছে নিয়ে চলো।
মনমরা মেয়েটি একসময় ফিরে এল বাড়িতে। দুপুর গড়িয়ে তখন ঢলছে বিকেলের কোলে। সৎমা মেয়েটিকে ডেকে বলল, আমার চুলটা কে বেঁধে দেবে আজ! তোমার মরা মা!
মেয়েটি দৌঁড়ে এসে চুল আঁচড়াতে বসল।
বেশ কাজ চলছিল, মেয়েটি তখন মায়ের খোঁপা বাঁধছে। হঠাৎ প্রবল ভাবে কেঁপে উঠল সেই শান্ত কন্যা। তারপর চিৎকার করে উঠে বলল— ‘এবার আমি সতীন খাব, সতীন খাব’। তারপর সৎমায়ের গলা দু হাত দিয়ে চেপে সে গালে বসাল এক জোরদার কামড়।
যন্ত্রণায় চিৎকার করে কেঁদে উঠল নতুন বউ। বউয়ের আর্ত চিৎকারে ছুটে এলেন বৃদ্ধ স্বামী। তিনি মেয়ের বজ্র কামড় থেকে বউকে ছাড়াবার চেষ্টা করতেই মেয়ে মাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। চোখ দুটো তার তখন লাল টকটকে। সে বাপকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দিয়ে তাঁর বুকে চেপে বসে দুহাত দিয়ে গলা টিপে ধরে বলল, কী রে তোকে বারণ করেছিলাম বিয়ে করতে, কথাটা তোর সেদিন কানে ঢোকেনি তা তো বেশ বুঝতে পারছি। আমার মেয়েটাকে তোরা দুজনে মিলে অনেক কষ্ট দিয়েছিস। আর নয়। আমার কথা না শোনার শাস্তি আজ তোরা পাবি। আমি আজ তোদের দুটোকেই আমার সঙ্গে নিয়ে যাব।
এলাকার জোয়ান, শক্তসমর্থ যুবকরা ছুটে এল বৃদ্ধকে বাঁচাতে। তারাও মেয়েটির শক্তির কাছে পরাস্ত হয়ে রনেভঙ্গ দিল। এরপর আর কেউ মেয়েটির কাছে আসার সাহস দেখালেন না। তখন কেউ ছুটলেন ডাক্তারের কাছে, কেউ গেলেন ওঝার বাড়িতে। আর দীনবন্ধু মিত্র পুরো ব্যাপারটা নিজের চোখে প্রত্যক্ষ করে পা চালালেন মহাত্মা শিশিরকুমারের বাড়ির দিকে।
মহাত্মাকে গিয়ে তিনি সবিস্তারে সব কথা বললেন। শিশিরকুমার বললেন, আপনি একটু দাঁড়ান । আমি নোটবইটা নিয়ে আসি। তারপর তিনি পুরোটাই নিজের নোট বুকে লিখে রাখলেন। পরবর্তীকালে তিনি এই ঘটনাটি নিয়ে একটা বড় প্রবন্ধ লিখেছিলেন ‘ইন্ডিয়ান ডেলি নিউজ’ পত্রিকায়।
এই ঘটনার দিন দুয়েক বাদেই মহাত্মার বাড়িতে বিষম বিপদে পড়লেন দীনবন্ধু মিত্র। সেদিন তাঁকে মিডিয়াম করে শুরু হল প্ল্যানচেট। বেশ কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর দীনবন্ধু কেমন যেন ছটফট করতে শুরু করলেন, টেবিলের ওপর ক্রমাগত পেন্সিল ঠুকতে থাকলেন।
সঞ্জীবচন্দ্র দীনবন্ধুবাবুর এইরূপ আচরণ দেখে হাসতে হাসতে বললেন, আপনি আমাদের সঙ্গে রসিকতা করছেন!
দীনবন্ধু মিত্র ভয়ঙ্কর চোখে তাঁর দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। সঞ্জীবচন্দ্রকে ইশারা করে চুপ করতে বলে শিশিরকুমার জানতে চাইলেন, আপনি কে?
দীনবন্ধুবাবু সামনে রাখা সাদা কাগজে লিখলেন— কুরন সরকার। তারপর অচেতন হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।
বেশ কিছুক্ষণ বাদে তিনি কিছুটা সুস্থ হওয়ার পর সকলে তাঁর কাছে কুরন সরকারের পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনারা তাঁকে চিনবেন না। কুরন সরকার আমার গোমস্তা ছিলেন। বহুদিন পূর্বেই তিনি মারা গিয়েছেন।
এই বাড়িতেই একবার এক প্ল্যানচেট সন্ধ্যায় গিরিশচন্দ্রকে মিডিয়াম করে তাঁরা এনেছিলেন কবি মিলটনকে। শোনা যায় কবি মিলটন তাঁদের অনুরোধে মিডিয়ামের মাধ্যমে কয়েক লাইনের কবিতাও লিখেছিলেন।
(ক্রমশ)
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে