ঝগড়া এড়িয়ে চলার প্রয়োজন। শরীর স্বাস্থ্য বিষয়ে অহেতুক চিন্তা করা নিষ্প্রয়োজন। আজ আশাহত হবেন না ... বিশদ
জ্যাঠামশাইয়ের হাত ধরে যে বালকটি একদা ঢুকেছিল থিয়েটার পাড়ায়, পরবর্তীকালে সেই বালকই হয়ে উঠল এক স্বনামধন্য অভিনেতা। থিয়েটার পাড়ার সেই শিল্পী তুলসী চক্রবর্তীর কথা শোনাব আজ।
তুলসী চক্রবর্তী নামটা শুনলেই আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে দুটি সিনেমা। তার একটি সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’, অপরটি নির্মল দে পরিচালিত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’। অথচ বহু বহু ছবিতে তিনি ছোট বড় মাঝারি নানা চরিত্রে কত বিচিত্র রকমের অভিনয় করে গিয়েছেন। এই মানুষটি কিন্তু স্টেজ পাগল মানুষ ছিলেন। ১৯৫৫ সাল থেকে টানা জীবদ্দশায় স্টার থিয়েটারেই ছিলেন। তবে ছোটবেলা থেকেই বহু স্টেজে কাজ করেছেন। অভিনয় জীবনের শুরুতেই গোল বাঁধালেন। তখন ‘দুর্গেশনন্দিনী’ স্টেজ হচ্ছে। হকিমের চরিত্রাভিনেতা অনুপস্থিত থাকায় থিয়েটারের কর্তা-ব্যক্তিরা তুলসীকে বললেন, ‘কি হে ছোকরা! খুব তো উইংস-এর ধারে বসে মন দিয়ে অভিনয় দেখো, হকিমের পার্টটা করতে পারবে?’ তুলসী সাহসের সঙ্গে বললেন ‘পারব’। সেদিন নবাব ও দলনী বেগমের ভূমিকায় অভিনয় করছিলেন পালিতসাহেব ও তারাসুন্দরী। হকিমের মুখের সংলাপ ছিল, ‘আর চিন্তা নাই বেগম সাহেবা, নবাব সাহেব এ যাত্রায় রক্ষা পেয়েছেন।’ কিন্তু তুলসী চক্রবর্তী বললেন, ‘আর রক্ষা নাই বেগম সাহেবা, নবাব সাহেব এ যাত্রায় চিন্তা পেয়েছেন।’ সংলাপ শেষ হতে না হতেই দর্শকদের সে কী হাসির রোল। তারাসুন্দরী সিন-থেকে বেরিয়ে এসেই বললেন, ‘দুটো কথাই যদি গোছ করে বলতে পারবে না, তো এখানে এসেছ কী জন্যে?’
ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে নিজেকে গড়ে তুললেন তুলসী চক্রবর্তী। শেষ জীবনে হাওড়ায় ছোটখাট একটা বাড়ি কিনেছিলেন। ছিলেন নিঃসন্তান। স্ত্রী এবং বড় ভাইয়ের বিধবা স্ত্রী এই নিয়ে তাঁর ছোট সংসার। আর বাড়িতে রয়েছে নারায়ণ শিলা। এই গৃহদেবতার নিত্য পূজা হতো সাড়ম্বরে। নিজে নিয়মিত বাজার করতেন। একদিন তুলসী চক্রবর্তী যথারীতি স্টার থিয়েটারের লবিতে আসর জমিয়ে বসেছেন। সেখানে তখন হাজির হলেন বাংলা রঙ্গমঞ্চের বিখ্যাত নাট্যকার ও নাট্যনির্দেশক দেবনারায়ণ গুপ্ত। তিনি তুলসীবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী বাজার করলেন তুলসীদা?’ তুলসী চক্রবর্তী বললেন, ‘আর বোল না ভাই। বড্ড হয়রানি হতে হয়েছে ফুল কিনতে গিয়ে। কোনও ফুলের দোকানেই আজ কর্তাপাতা নেই।’ দেবনারায়ণ বিস্ময়ের সঙ্গে বললেন, ‘কর্তাপাতা? এমন নাম তো শুনিনি।’ তুলসী চক্রবর্তী বলেই চলেছেন, ‘কর্তাপাতা না হলে কি নারায়ণের পূজা হয়?’ সবাই যখন মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে তখন তুলসী চক্রবর্তীর পাশে বসা আরেক স্বনামধন্য নট জহর গঙ্গোপাধ্যায় এই রহস্যের সমাধান করলেন। বললেন, ‘ওর বউ তো তুলসী কথাটা উচ্চারণ করতে পারে না, তাই বলে কর্তাপাতা। আমাদের কাছে সেই কথাটা কেমন কায়দা করে জানিয়ে দিলে দেখছেন তো?’ এমন রসিক মানুষ ছিলেন তুলসী চক্রবর্তী।
তুলসী চক্রবর্তী সবাইকে আপন করতে পারতেন বলে, কম বয়সিরা প্রায়ই তাঁকে সম্বোধন করত ‘দাদু’ বলে। দেবনারায়ণ গুপ্ত একদিন জিজ্ঞাসা করলেন, ‘ওরা আপনার কীরকম নাতি?’ তুলসী চক্রবর্তীর উত্তর, ‘ভাইপো ভাইঝি ভাগ্নে ভাগ্নী এদেরই ছেলেপুলে হবে বোধহয়।’ দেবনারায়ণবাবু বললেন, ‘বোধহয়’? তুলসী চক্রবর্তী বুঝিয়ে দিলেন, ‘ওদের মা-বাপকে কোনওদিন দেখিনি। জানিনেও। ওরা দাদু বললে আমিও ওদের নাতি পাতালাম।’ পাশেই বসা ছিলেন বিখ্যাত কৌতুক অভিনেতা শ্যাম লাহা। তাঁর বিরাট বপুর জন্য দর্শকেরা তাঁকে এক নামে চেনে। শ্যাম লাহা বললেন, ‘আমাকেই দেখুন না। জাত নয়, জ্ঞাত নয়, অথচ আমার ওপর ওঁর কী টান।’ তুলসী চক্রবর্তী বাধা দিয়ে বললেন, ‘স্নেহ তো দূরের কথা, ওকে আমি এড়িয়ে চলতে চাই। সব জায়গায় বলে বেড়াচ্ছে ওকে নাকি আমি পুষ্যি নেব বলেছি।’ একটু থেমে আবার বললেন, ‘ওকে পুষ্যি নেওয়া মানে ডাইনির কোলে পুত্র সমর্পণ করা। ওকে পুষ্যি নিয়ে বশে আনতে হলে ভীম ভবানীর মতো লোকের দরকার।’ তুলসী চক্রবর্তীর কথায় সবাই সম্মিলিত হাসিতে যোগ দিলেন। এখানেই শেষ নয়।
তুলসী চক্রবর্তী শ্যাম লাহার বিরুদ্ধে বলেই চলেছেন, ‘হাওড়া থেকে বাসে যাতায়াত করি, শীতকালে বড় কষ্ট হয়। তাই ভাবলাম একটা ভালো কাপড়ের লং কোট তৈরি করাই। সেই কথা শুনে হুয়া (শ্যাম লাহার ডাক নাম) বললে, আমার ওপর ভার দিন, সব ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। সে কথায় কান দিইনি। কারণ আমার কোট তৈরি করার নামে এমন একটা কোট বানিয়ে আনত যা হুয়ার গায়ের জন্য ঠিক, আমার জন্য নয়। তাই সাত-পাঁচ ভেবে অন্য ব্যবস্থা করেছি।’
এই সব কথাবার্তার ফাঁকে এলেন অনুপকুমার। বললেন, ‘জ্যাঠামশাই আসুন।’ অনুপকুমারের বাবা বিখ্যাত গায়ক অভিনেতা ধীরেন দাসের সঙ্গে তুলসী চক্রবর্তী যেহেতু মঞ্চে ও পর্দায় অনেকদিন কাজ করেছেন বলে অনুপকুমার জ্যাঠামশাই বলে ডাকতেন তুলসী চক্রবর্তীকে। তুলসী চক্রবর্তীকে নিয়ে অনুপকুমার ওয়েটিং রুমে গেলেন। তুলসী চক্রবর্তীর গায়ে পরিয়ে দিলেন নতুন গরম কাপড়ের লং কোট। লবিতে এসে সবাইকে তুলসী চক্রবর্তী দেখালেন অনুপকুমারের দেওয়া লং কোট। বললেন, ‘অনুপ আমার ভাইপো। আমার বাপধন। কাপড়ের নমুনা এনে, দর্জি ডেকে, সব ব্যবস্থা করে দিল, ভগবান ওর ভালো করুন। ওর বাড়বাড়ন্ত হোক। ও শুধু লোক দেখিয়ে জ্যাঠা বলে ডাকে না। সত্যি ও ছেলের কাজ করেছে। অনুপ থাকতে আবার আমার ছেলের ভাবনা।’
এই কথাগুলি বলার মধ্য দিয়ে নিঃসন্তান তুলসী চক্রবর্তীর চোখেমুখে যে পরিতৃপ্তি ছড়িয়ে পড়েছিল, উইংস-এর আড়ালে লবিতে উপস্থিত সকলের চোখেই তা ধরা পড়েছিল। তুলসী চক্রবর্তী স্টারের লবিতে যখন জমিয়ে রাখতেন আসর, তখন কেউ কেউ তাঁর কাছে জানতে চাইতেন যে তিনি কেন সস্ত্রীক তীর্থ ভ্রমণে বছরে একবার করে বেরিয়ে পড়েন না। তার উত্তরে তাঁর নির্মল হাসিভরা মুখে বলতেন, ‘যে থিয়েটারে একদা ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের পায়ের ধুলো পড়েছিল, এই স্টারে স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, বেলুড় মঠের প্রণম্য সন্ন্যাসীরা, গিরিশচন্দ্র ঘোষ এসে গেছেন, তার থেকে বড় তীর্থ আর কিছু হতে পারে? এই স্টেজই আমার পুণ্য তীর্থ। তুলসী চক্রবর্তীর ভক্তি মিশ্রিত কণ্ঠস্বর উপস্থিত সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল, তা বলাই বাহুল্য।
ছবি : সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে