বিদ্যার্থীদের বেশি শ্রম দিয়ে পঠন-পাঠন করা দরকার। কোনও সংস্থায় যুক্ত হলে বিদ্যায় বিস্তৃতি ঘটবে। কর্মপ্রার্থীরা ... বিশদ
এই পরিস্থিতিতেই সন্ত কবীরের জীবন ও তাঁর চিন্তাগুলি নিয়ে রচিত নাটক ‘কবীরা’ মঞ্চস্থ হল অজিতেশ মঞ্চে। হিন্দি নাট্যকার ভীষ্ম সাহনির রচনা ‘কবীরা খাড়া বাজারে মে’ অবলম্বনে রবীন্দ্রনগর নাট্যায়ুধ-এর প্রযোজনায় ও দানী কর্মকারের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হল নাটকটি।
কাশীতে এক মুসলমান দম্পতির কাছে মানুষ হন কবীর। আত্মভোলা এই মানুষটি ঘুরে ঘুরে বেড়ান। মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের বিপদে-আপদে ঝাপিয়ে পড়েন। উচ্চবর্ণের লোকেরা বিষয়টা ভালো চোখে দেখে না। প্রতি মুহূর্তে তাঁকে বিপদে ফেলে। কিন্তু কোনও বিপদ তাঁকে স্পর্শ করে না। তিনি অনায়াসেই সব বিপদ কাটিয়ে ওঠেন।
নাটকের শুরুতে দেখা যায় হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাধে। যেখানে কবীর এসে মানবধর্মের মূলমন্ত্রের কথা বলেন। এরপরই বড় মহান্তর দরবারিতে কিছু মানুষ নাচ-গান করতে যায়। সেই সময় হঠাৎ শোরগোল শোনা যায়। কয়েকজন সাধু একটি বাচ্চাকে চাবুক দিয়ে মারছিল। কবীর তাকে বাঁচাতে গিয়ে সাধুদের কোপে পরেন। জুলাহা এসে কবীরের অবস্থার কথা বলে। কবীরের মা-বাবা চিন্তায় পরে যায়। কবীরের অবস্থার জন্য তাঁর বাবা-মা’কে দায়ী করে। সে বাজারে কাপড় বিক্রি করতে যায়। কিন্তু ব্যবসা তাঁর দ্বারা হয় না। তাদের কথোপকথনে কবীর জানতে পারেন যে, তিনি পালিত সন্তান। কবীরের সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত দেখে কষ্ট পায় তাঁর মা। এই খবর তৎকালীন কাশীর কোতওয়ালের কানে বিষমন্ত্রের মতো ছড়িয়ে দেয় কট্টরপন্থী মৌলবী ও মহন্ত। এরফলে কবীরের দোহা যারা গাইত— এমন একজন ভিক্ষুককে মেরে চৌরাস্তায় ফেলে দেওয়া হয়। প্রতিবাদস্বরূপ ভিখারির অন্ধ মা বলে, এবার সে নিজে কবীরের গান গাইবে। ভিখারির লাশ নিয়ে যাওয়ার পর মৌলবীর সঙ্গে ঝামেলা বাঁধে কবীরের। বস্তির সামনে মহন্তর বড় ধরনের মন্দির তৈরি হয়, যার ফলে সূর্যের আলো ঢাকা পরে যায়। পুনরায় কোতওয়ালের কাছে যায় মৌলবী ও মহন্ত। দু’জনেই কবীরকে শেষ করে দেওয়ার কথা বলে। এরপর কবীরকে গঙ্গায় ডুবিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তিনি এসে দেখেন পুরো বস্তি পুড়ে গেছে। এরপর সবাইকে সৎসঙ্গ করতে বলেন। সকলে মিলে সৎসঙ্গ করে। কবীরকে ডুবিয়ে দেওয়ার সময় লুই তাঁকে বাঁচিয়েছিল, তার সঙ্গে কবীরের বিয়ে হয়। তাদের সংসার হতে না হতেই আবার কবীর আক্রান্ত হয়। কোতওয়াল বন্দী করে নিয়ে যায় কবীর ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের। এমন সময় বাদশাহ সিকন্দর লোদী কবীরের সঙ্গে দেখা করতে চায়। এই শুনে কবীরকে মুক্ত করতে আদেশ দেন এবং তাঁর সৎসঙ্গ সাজিয়ে দেন। বাদশাহ তাঁকে দিল্লিতে নিয়ে গিয়ে পূজা-অর্চনা করতে বলেন। কিন্তু সে বলে মানুষের মধ্যেই ঈশ্বর আছেন। মন্দির, মসজিদ, বা গীর্জায় নয়। সেই মানুষের সেবাই আসল ধর্ম। এই শুনে বাদশাহ তাঁকে শাস্তি দেওয়ার হুকুম দেন। চাবুকের আঘাতে কোতওয়াল ক্ষত-বিক্ষত করে কবীরকে। মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সে তাঁর নিজের যুক্তির জায়গা থেকে সরে আসেনি।
তাঁর জীবনের কিছু ঘটনা ও সেই সময়ের সীমাবদ্ধ সামাজিক অবস্থার সন্ধান দেয় এই নাটক। একটি যুগের কথা তুলে ধরে যখন ধর্মীয় সংগঠনগুলি সমাজকে তাদের নিজস্ব স্বার্থে এবং ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করে রেখেছিল. কবীরের কথা বলতে গিয়ে যেন আজকের সময় উঠে আসে মঞ্চে। বর্ণবাদ, দুর্নীতি, বৈষম্য, অস্পৃশ্যতা, সাম্প্রদায়িক শক্তি বৃদ্ধির বিষয়টির বর্ণনা দেয়। কবীরকে ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলি বাকরুদ্ধ করার এবং বার বার হত্যার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তিনি তাঁর মত, ভাবনা থেকে কখনও দূরে সরে যাননি। আজকের সময়ের ভিত্তিতে নাটকটি তুলে ধরেছে নাট্যায়ুধ। নাটকটি সমসাময়িক সমাজের সকল বিকৃতির সঙ্গে কবীরের সংগ্রামকে যুক্ত করে।
প্রত্যেকের সাবলীল, স্বচ্ছন্দ অভিনয় দর্শকদের নজর কাড়ে। বিশেষত ঈশান কর্মকার ও প্রদীপ মজুমদার তাঁদের অভিনীত চরিত্র দুটি প্রাণবন্ত করে তোলেন। কাজল শম্ভু, অমিত সরকার, বর্ণালী কর্মকার, সন্দীপ চট্টোপাধ্যায়, সুকান্ত দাস, অসমিত সিং, সজীব চক্রবর্তী, বিনায়ক কর্মকার, পিয়া মল্লিক, গোপা সাহা, পায়েল সাহু ও অন্যান্যরাও তাঁদের অভিনয়ে পেশাদারিত্বের ছাপ রাখেন। আলোর যথাযথ প্রয়োগে সমর পারুই, এবং আবহ ও মঞ্চসজ্জায় দানী কর্মকার বিষয়টির গভীরে প্রবেশ করতে সাহায্য করে। কোরিওগ্রাফি ও পোশাক ভাবনা বর্ণালী কর্মকার। মেকআপ সৌগত মিত্র।
কলি ঘোষ