বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
যখন থেকে আমি থিয়েটার নিয়ে জেগে উঠছি তার বহু আগে থেকেই আমাদের নাট্যগুরুরা সক্রিয় ছিলেন। থিয়েটারকে সামনে রেখেই তাঁরা নিজেদের বাসভূমির আর পরমায়ুর বরাদ্দ বাকি দিনগুলোর কর্মভূমির রূপরেখা তৈরি করছিলেন। তাঁদের অনেকেই আজও অচেনা, অনেকের কথাই আর স্মৃতিতে নেই। প্রচার শূন্য নৈঃশব্দ্যে তাঁরা কাজ করে গেছেন মহড়াকক্ষে। দর্শক ঠাসা প্রেক্ষাগৃহে তাঁদের নেপথ্য ভূমিকারও বিশেষ স্বীকৃতি ছিল না। বছরের পর বছর নাট্যচর্চার পর, অসাধারণ সব কীর্তি স্থাপনের পর এইভাবে ধীরে ধীরে জায়গা ছেড়ে দিতে হয়েছে তাঁদের, তাঁরা হারিয়ে গিয়েছেন। শুরুতে আমি বুঝে নিয়েছিলাম যে আমার ভাগ্যও ওঁদের পদাঙ্ক অনুসরণের পথনির্ভর। স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বাঁচার কিংবা থিয়েটার নিয়ে বেঁচে থাকার এসব অতুলনীয় ঐতিহ্যকে অনুসরণের উত্তরাধিকার এখন আমার কাঁধেও। কোনও প্রত্যাশা ছিল না, থিয়েটারে যে অভিনয় মুহূর্তগুলোর পুনর্জন্ম হয় না, সেই মুহূর্তগুলোর অনুধাবন ছাড়া আমার প্রাপ্য কিংবা প্রত্যাশা কিছুই ছিল না। মঞ্চের অন্ধকারে অভিনয় মুহূর্তগুলোর মুখোমুখি হওয়া, ভঙ্গিমা বা সংলাপী সত্যগুলির অনুসৃতি ছাড়া কাঙ্ক্ষিত আর কিছুই ছিল না।
আমার থিয়েটারের নিবাসী ঠিকানা ছড়িয়ে গেল এইভাবে রাতের পর রাত জাগা, নানা বিচিত্র জায়গা থেকে নাটক দেখতে সমবেত হওয়া অসংখ্য দর্শকের মধ্যে। বহুবর্ণী দর্শকদের সামনে ওই অতুলনীয় মুহূর্তগুলো, নিজেকে হারিয়ে ফেলার মুহূর্তগুলো, কষ্ট পাওয়ার আর যাপন থেকে যাপনে পুনর্জন্মের মুহূর্তগুলোর মধ্যেই আমার এখনকার বাসভূমি। ওই মুহূর্তগুলোই তো নাট্যচর্চাকে সনিষ্ঠ পেশাদারি দৃষ্টিতে দেখার প্রেরণা দেয়। তুলে ধরে কিছু সাময়িক সত্যকে, যার সূত্রে আমরা বুঝতে পারি মঞ্চের আলোর নীচে যা বলছি যা করছি, তা আমাদের কখনও গভীর ভাবনার কখনও বা সবচেয়ে ব্যক্তিগত অনুভবের অংশী করে তোলে। আমার দেশটা, মানে আমার আর আমার সহশিল্পীদের থিয়েটারের দেশটা ওইসব মুহূর্তগুলোর সমবায়েই গড়ে ওঠে। সেখানে একান্তে অভিনেতার মুখোশ, সংলাপের ছন্দ, অভিনয় করতে গিয়ে শিল্পী কী হয়ে উঠছে, কীভাবেই বা এতক্ষণ অন্ধকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে থাকছে— সেইসব মোহনমায়া কাটিয়ে অভিনেতা নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কার করে।
বছরের পর বছর ধরে নাটকের ঐতিহ্য তো আনুভূমিকভাবে দিগন্তচারী। পৃথিবীর কোনও একটা ভৌগলিক কেন্দ্রে, শহরে নগরে কিংবা মহামূল্যবান অট্টালিকার অভ্যন্তরে থিয়েটারের ঠিকানা আছে এমন নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে না। আমার কাছে থিয়েটার আসে অদৃশ্য এক ভূগোল থেকে, যেখানে নাট্যজনের জীবনের সঙ্গে থিয়েটারি শিল্পকৌশলের একীভূত হওয়ার মিলনভূমি তৈরি হয়ে যায়।
সব নাট্যগুরুরাই পুনরাবৃত্তিহীন অভিনয়-স্বচ্ছতার আর নান্দনিকতার দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করতে করতেই মৃত্যুবরণ করেন। উত্তর প্রজন্মের স্মৃতি থেকে হারিয়েও যান।
বাণীটির বাংলা তর্জমা করেছেন নাট্যকার চন্দন সেন।