কলকাতায় এসে অভিনয় করার মজাই আলাদা
কলকাতা কেমন লাগল?
এমনভাবে বললেন যেন কলকাতায় আমার এই প্রথম আসা। অভিনয়ের সূত্রে কতবার কলকাতায় এসেছি, এখন আর এই শহরটাকে নতুন লাগে না। তবে একটা কথা মানতেই হবে যে প্রতিবারই কলকাতা আমায় নতুনভাবে মুগ্ধ করে।
তাই নাকি? কীভাবে?
কলকাতার দর্শক অসম্ভব শার্প। সামান্য ভুলও যেমন তাঁদের নজর এড়ায় না, তেমনই আবার ভালো অভিনয়ের কদরও তাঁরা করতে জানেন। তাই কলকাতায় স্টেজ শো করতে হলে আমি বা আমরা ভীষণ সতর্ক থাকি। এতে অভিনয়ের মজা দ্বিগুণ হয়ে যায়। শুধু তাই নয়, কলকাতায় অভিনয় করতে গিয়ে দর্শকদের যেভাবে আমরা স্টেজে টেনে আনতে পারি, ততটা আর অন্য কোনও শহরে পারি না। আরে বাবা এটা তো আর অস্বীকার করা যায় না যে কলকাতা শিল্প ও সংস্কৃতির পীঠস্থান। এমন শহরে অভিনয়ের সুযোগ যে পেয়েছি বা এখনও পাচ্ছি এটাই তো ভাগ্যের কথা। আমার তো মনে হয় কলকাতার মঞ্চে নাটক করলে নাটকের এবং অভিনয়ের সঠিক মূল্যায়ণ করা যায়। আমি অভিনয়ের কোন পর্যায় রয়েছি তা একমাত্র কলকাতার দর্শকই তাঁদের হাবেভাবে বুঝিয়ে দিতে পারেন।
প্রথম কলকাতা আসার অভিজ্ঞতা কীরকম?
সেটা ছিল কেরিয়ারের গোড়ার দিক। তখনও দিল্লি থেকে মুম্বই পাড়ি জমাইনি। অভিনয় জগতে নেহাতই নবাগত। সালটা অবশ্য আজ আর মনে নেই। কোন নাটক তাও সঠিক মনে পড়ছে না। তবে এটুকু বলতে পারি প্রথম দর্শনেই কলকাতা আমায় মুগ্ধ করেছিল। অভিনয় করাই যথেষ্ট নয়, নিত্যনতুন ভঙ্গিতে তা উপস্থাপনা করার শিক্ষা আমি কলকাতার দর্শক মারফতই পেয়েছি। কলকাতার স্টেজে অভিনয় করতে এসে একটা উপলব্ধি হয়েছিল, বুঝেছিলাম অভিনয় যখন আলোচনার বিষয় হয়ে উঠবে তখনই তা শিল্পে পরিণত হবে, নচেৎ শত ভালো অভিনয় করেও কোনও লাভ নেই।
একটু পিছনে ফেরা যাক। অভিনয়ে আসা কি হঠাৎ করেই নাকি ছোট থেকেই অভিনয়ের প্রতি টান অনুভব করতেন?
না, না একেবারেই হঠাৎ নয়। ছোট থেকেই অভিনয়, মঞ্চ ইত্যাদির প্রতি একটা টান অনুভব করতাম। আমি তো এফ টি আই আই পুনের ছাত্র, কিন্তু তার বহু আগে থেকেই আমার অভিনয়জীবন শুরু হয়। এটা বললাম যাতে পাঠক বুঝতে পারেন যে অভিনয় জগতে প্রতিষ্ঠিত হতে, বা অভিনয় বিষয়ে শিখতে বিশেষ পাঠ্যক্রম নিয়ে পড়াশোনা করেছি বটে, কিন্তু তার আগে থেকেই আমি মঞ্চে অভিনয় করতাম। অর্থাৎ অভিনয় মোটামুটি আমার রক্তেই বলা যায়।
কতদিন হল আপনি অভিনয় করছেন?
৪২ বছর।
টিভি, থিয়েটার, সিনেমা এই যে এত রকম ক্ষেত্রে অভিনয় করেন কোনটা টানে?
অবশ্যই থিয়েটার। থিয়েটার আমায় চুম্বকের মতো টানে। থিয়েটারের কয়েকটা কি-পয়েন্ট আছে। প্রথমত থিয়েটারে অভিনয় করলে ভালো বা খারাপ, দর্শর্কের যেমনই অভিব্যক্তি হোক না কেন, তা সঙ্গে সঙ্গে টের পাওয়া যায়। এটা অন্য কোনও অভিনয় মাধ্যমে সম্ভব নয়। সিনেমায় তো নয়ই, এমনকি সিরিয়ালেও দর্শকের ফিডব্যাক পাওয়ার জন্য বহু ভায়া মিডিয়ার প্রয়োজন পড়ে। থিয়েটারে ব্যাপারটা অনেক সরাসরি। ফলে অভিনয়ের পাল্স বুঝতে চাইলে থিয়েটার অনবদ্য। দ্বিতীয়ত থিয়েটারের সঙ্গে ঘোরার সুযোগ সবচেয়ে বেশি। আর নাটকের সঙ্গে যত ঘুরবেন ততই লোকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে, তাঁদের কথা শুনবেন, নিজে সমৃদ্ধ হবেন। একটা উদাহারণ দিই। কয়েক বছর আগে আমি একটা নাটক লিখেছিলাম ‘মেরা ও মতলব নেহি থা’। নাটকটি নিয়ে গোটা মার্কিন মুলুকে ঘুরে বেড়িয়েছি। আমেরিকার ২৩টি শহরে অভিনয় করেছি। দর্শক আমায় চিনেছেন, আমার অভিনয় দেখেছেন, তাঁদের মতামত জানিয়েছেন, আমি নিজেকে উন্নত করার সুযোগ পেয়েছি। কিন্তু সিনেমা বা সিরিয়ালে তো এটা অসম্ভব। সেখানে শুধুই লোকেশন শ্যুট আর সেট শ্যুট এই তো অভিনয়ের সুযোগ। আর তৃতীয় ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় থিয়েটার আপনাকে জীবন্ত রাখতে সাহায্য করে। আপনার অভিনয়কে প্রাণবন্ত করে। স্টেজে অভিনয় না করলে বোঝাই যায় না অভিনেতা হিসেবে আমি ঠিক কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, আমি রিফ্লেক্স কতটা সজাগ, আমি কতটা তীক্ষ্ণ ইত্যাদি। আর একটা কথা না বললেই নয়, নাটক অভিনেতাদের মাটির কাছাকাছি রাখে। সাধারণের সঙ্গে সরাসরি যোগযোগের সুযোগ ঘটায়। নাটকে অভিনয় করলে স্টারডম আসে না। ফলে মঞ্চাভিনয়ের আত্মসুখের সুযোগ কম। এই বিষয়টাও নাটকের প্রতি আমায় ভীষণ আকৃষ্ট করে।
আপনার একক অভিনয় ‘মাসাজ’ নাটকে, যেখানে আপনি একাই ২৩টি চরিত্রে অভিনয় করেছেন...
আরে সেটাই তো বলতে যাচ্ছিলাম। একক অভিনয় এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। আমার একক নাটক ‘মাসাজ’ নিয়ে মাত্র গত মাসেই দুবাই গিয়েছিলাম। এছাড়াও দেশে ও বিদেশে বহুবারই এই নাটকটি অভিনয় করেছি। যতবারই করেছি ততবারই নতুন নতুন উপলব্ধি হয়েছে। একক নাটকের একটা ভারী মজার দিক আছে। গতানুগতিক ধারায় রিহার্সাল দিতে হয় না। মঞ্চে আমি একাই রাজা। অন্য অভিনেতা নেই যাঁদের সঙ্গে স্টেজ শেয়ার করতে হবে। আবার একই সঙ্গে আমার অভিনয়ের দায়ভার বহন করার মতো আর একটা লোকও থাকে না। এটা হল ওই একক অভিনয়ের ভয়ের দিক। আমি হয়তো একটু ভুল করলাম, সঙ্গে সঙ্গে সেটা মেক আপ করার মতো কোনও অভিনেতা আমার পাশে নেই। ফলে একক অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রতি মুহূর্তে একশোগুণ বেশি সজাগ থাকতে হয়। নিজের ভুল নিজেকেই বুঝে মেক আপ দিতে হয়। তাই একটা ভীষণ মিশ্র প্রতিক্রিয়া হয় একক অভিনয় করতে গিয়ে। একই সঙ্গে ভয়, মজা আর রোমাঞ্চ মেশানো সেই অনুভূতি।
আপনার প্রিয় চরিত্র কোনটা?
এই তো মুশকিলে ফেললেন। প্রিয় চরিত্র ওইভাবে বলা যায় নাকি! অভিনেতার কাছে প্রতিটি চরিত্রই তাঁর সন্তান। আর সন্তানের প্রতি বাবা-মা কি পারে পক্ষপাতিত্ব করতে? ফলে কোনও একটা চরিত্র বেছে নিয়ে তাকেই প্রিয় করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। তবে এত বছরের অভিনয় জীবনে উল্লেখযোগ্য বহু চরিত্রেই অভিনয় করেছি। তার মধ্যে একটা সিনেমা ছিল ‘আধা রাম আধা রাবণ’। সেখানে একজন অভিনেতার চরিত্রে অভিনয় করেছিলাম। আমার সঙ্গে অন্য আর একজনই অভিনেতা ছিলেন, ওম পুরি। ওম সাব এক খুনির চরিত্রে। গল্পটা এইরকম যে ওই অভিনেতা একদিন স্টেজে অভিনয় করে ঈষৎ মদ্যপ অবস্থায় বাড়ি ফিরে দেখেন তিনি তাঁর নিজের বাড়িতেই বন্দি! তাঁর বাড়িতে আস্তানা গেড়েছে এক অপরাধী যে কি না নিজের স্ত্রীকে খুন করার পরিকল্পনা করছে। স্ত্রীটি আবার ওই অভিনেতার মুখোমুখি প্রতিবেশি। ফলে অভিনেতার বাড়ির জানালা দিয়ে অপরাধী নিজের স্ত্রীকে খুনের পরিকল্পনা করেছে। এবং এই গোটা পরিকল্পনার সাক্ষী হয়ে পড়েছেন ওই অভিনেতা। সিনেমার গল্প এগোচ্ছে অভিনেতা ও অপরাধীর সংলাপের মাধ্যমে। অন্য কোনও চরিত্র নেই। এইভাবেই ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছয় গল্প। এই চরিত্রটার জন্য আমি ভীষণ খেটেছিলাম। আমার মনে হয়েছিল চরিত্রটার মধ্যে অভিনয়ের অনেক সুযোগ আছে। কিন্তু দর্শক নিল না। ছবিটা ভয়ঙ্কর ফ্লপ করল। পরে আর ওই চরিত্র নিয়ে কারও সঙ্গে কথাই বলার সুযোগ ঘটল না।
অভিনয় করেন, নাটকও লেখেন আবার এই নাটকের টাইটেল মিউজিকটাও শুনলাম আপনিই করেছেন। এতরকম কাজ করতে গিয়ে কখনও কোনও একটার প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে ফেলেন কি?
অভিনয়ের প্রতিই পক্ষপাত সবচেয়ে বেশি তা তো বলাই বাহুল্য। বাকিগুলো তো অভিনয় করার জন্যই করি। এই যেমন নাটক করতে গিয়ে হয়তো মনে হল কোনও একটা রোলে অভিনয় করলে ভালো লাগবে। তখন সেই চরিত্রটা তৈরি করার জন্য নিজেই একটা নাটক লিখে ফেললাম, এইরকম আর কি। আর টাইটেল মিউজিকটা নিতান্তই একটা শখ। গান শুনে কোনও সুর মনে ধরলে তখন সেটা নিয়েই কাজ করতে শুরু করি। এইভাবেই একটা থিম মিউজিক হয়ে যায়।
‘রং নাম্বারই বলুন’ বা ‘মেরা ও মতলব নেহি থা’ সবই তো সামাজিক গল্প। এই ধরনের নাটকই কি আপনাকে বেশি টানে।
মোটেও না। অভিনয়ের ক্ষেত্রে আমি সারাক্ষণ এক্সপেরিমেন্ট করি। একক নাটক, সামাজিক নাটক, কমিক চরিত্র, গম্ভীর চরিত্র সবেতেই আমি সমানভাবে অভিনয় করেছি। তবে আমরা তো সমাজের বাইরে নই। সমাজে যেমন দেখি তেমনই নাটকের গল্প লিখি। ফলে সব নাটকই কোনও না কোনওভাবে সামাজিক। শেক্সপিয়ার যখন ঐতিহাসিক নাটকও লিখেছেন তখনও সামাজিক প্রভাব সেই নাটকের ওপর পড়েছে। আমি মনে করি সমাজের বাইরে গিয়ে কোনও কিছুই হয় না।
ঐতিহাসিক চরিত্রে অভিনয় করার কথা ভাবেন?
আলাদা করে ঐতিহাসিক চরিত্র আমায় টানে না। আমার মনে হয় একটা সাধারণ চরিত্রে অভিনয় করলে সেই চরিত্রে যতটা রং ফুটিয়ে তোলা যায় ঐতিহাসিক চরিত্রে ততটা যায় না। তার কারণ ঐতিহাসিক হিরোদের বা ভিলেনদের নিয়ে আমাদের মনে একটা ধারণা রয়েছে। তার থেকে খুব বাইরে বেরিয়ে সেই চরিত্রটা আঁকলে দর্শক একটু ধাক্কা খায়। তখন সেই অভিনয় যতই ভালো হোক না কেন নজর কাড়তে পারে না। কিন্তু সামাজিক নাটকে পাশের বাড়ির লোকটা হয়তো ভীষণ ভালো আবার ঠিক এতটাই ভালো কি? নাকি একটু খারাপও বটে? কিন্তু কই ততটা খারাপও তো বোঝা যাচ্ছে না.. এই যে দর্শককে সারাক্ষণ ভাবনার অবকাশ দেওয়া এটা একটা বিশেষ দক্ষতার পরিচয়। আমি অভিনয়ের মাধ্যমে সেই জায়গায় পৌঁছতে চাই, যেখানে নাটকের শেষ দৃশ্যে এসেও দর্শক ভাববেন চরিত্রটা কি ভালো না মন্দ। ছবি: ভাস্কর মুখোপাধ্যায়
14th January, 2019