কর্মপ্রার্থীদের ক্ষেত্রে শুভ। যোগাযোগ রক্ষা করে চললে কর্মলাভের সম্ভাবনা। ব্যবসা শুরু করলে ভালোই হবে। উচ্চতর ... বিশদ
একটা আলোচনাচক্রে ভাষণ দিচ্ছিলেন ‘দি নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সাংবাদিক রবার্ট লিনডসে। খুব বড়াই করে তিনি বলছিলেন, বিশ্বের সবচেয়ে স্বাধীন সংবাদমাধ্যম হল আমেরিকায়। এই মন্তব্যের আংশিক সত্যতা স্বীকার করে আমি বলেছিলাম, কিন্তু হলুদ সাংবাদিকতার জন্মও তো আমেরিকাতেই। কাজেই সীমাহীন স্বাধীনতা ভালো নয় মোটেই। একটুও আমতা আমতা না করে রবার্ট রায় দিয়েছিলেন, স্বাধীনতার সবচেয়ে বড় শত্রু হল ‘অপব্যবহার’!
পশ্চিম গোলার্ধের, বিশেষ করে আমেরিকার উদ্দাম কৈশোর সম্পর্কে এই শব্দটা বেশ মাননসই। আর কে না জানে, স্বাধীনতার অপব্যবহার আসলে স্বেচ্ছাচারের নামান্তর। অবশ্য এটা বলা উচিত হবে না যে, পৃথিবীর পূর্বভাগের কৈশোর একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা। স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে খানিক স্বেচ্ছাচারিতা সেখানেও আছে। কিন্তু তুল্যমূল্য বিচারে, পূর্ব-পশ্চিমের কৈশোরের মধ্যে ফারাকটা হল ‘মাত্রা’। পশ্চিমের ওই স্বেচ্ছাচার ‘সমাজ-স্বীকৃত’, পূর্বেরটা এখনও তেমন নয়! বাঙালি সমাজে আমরা জীবনের যে পর্যায়কে বয়ঃসন্ধি বা অ্যাডোলেসেন্স বলতে অভ্যস্ত, আমেরিকাতে সেটা ‘টিন এজ’! বয়সের পাল্লাতে যা কিনা ১৩ থেকে ১৮ বছর। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণী, অর্থাৎ কিনা, হাইস্কুল। আমেরিকাতে এই ‘টিন’ মানে বড়দের মাথা কিনে নেওয়া। বাংলাতে এই বয়সের ছেলেমেয়েরা তালেবর হয় বটে, কিন্তু ‘বড়’-র খেতাব পায় না।
আমেরিকাতে হাইস্কুলে উঠেছ কি, পোয়া বারো। পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন তো দূরের কথা, বাপ-মাও ছেলেমেয়েকে কিচ্ছুটি বলতে পারবে না। ‘টিন’-রা সব কফি বা কোকের গেলাস হাতে নিয়ে, ক্যাজুয়াল পোশাক পরে, ক্লাসে গিয়ে পায়ের ওপর পা তুলে বসবে। কেউ কিছু বললে, ঘাড় ঝাঁকিয়ে ‘টিন’-রা বলবে, ‘কাম অন, উই আর ইন হাইস্কুল’! ব্যাস, সাত খুন মাপ। আর টিচাররাও তেমনি, তারাও তথাকথিত স্বাধীনতা-সংগ্রামের পক্ষে। আমেরিকার হাইস্কুল যেমন মুক্তাঞ্চল, তেমনটা পূর্বের বিশ্ববিদ্যালয়েও দেখা যায় না। দুনিয়ার দুই অর্ধের এই ব্যবধানের কারণটা কিন্তু ‘সামাজিক’। মার্কিন সমাজে একটা অদৃশ্য বিচ্ছিন্নতা আছে। ‘প্রাইভেসি’-র নামে মার্কিন ঘরগেরস্থিতে একটা আইসোলেশন বিরাজ করে। ‘জেনারেশন গ্যাপ’ সংক্রান্ত কোনও তর্কবিতর্ক শুরু হলেই বাবা-মা আর ছেলেমেয়েরা পরস্পরকে বলবে, ‘মাই লাইফ ইজ মাই লাইফ, ইয়োর লাইফ ইজ ইয়োর লাইফ’! শত ভঙ্গ বঙ্গ দেশে একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে যাচ্ছে বটে, হয়ত তৈরি হচ্ছে অনু-পরমানুর সংসার, তবু সেথায় এখনও ব্যক্তিস্বাধীনতা এমন বিপজ্জনক রকম নির্জন হয়ে ওঠেনি। বঙ্গমুলুকে এখনও হাইস্কুলারদের বাবা-মায়েরাই আগলে রাখে। তাতে অনেকক্ষেত্রে একটা কূপমণ্ডূক পরনির্ভর প্রজন্ম জন্ম নেয় বটে। পক্ষান্তরে আমেরিকায় হাইস্কুল থেকেই ছেলেমেয়েরা বেশ স্বনির্ভর হয়ে ওঠে। যেটা দরকার, সেটা হল, এই দুই বিপরীত মেরুর মাঝে একটা মধ্যমমাত্রা, আর সেজন্য প্রয়োজন প্রকৃষ্ট মাত্রাজ্ঞান! স্বাধীনতা নামক মুদ্রাটির অন্য পিঠ তো দায়িত্বজ্ঞান বা কর্তব্যবোধ। স্বাধীন হওয়ার শিক্ষা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই যদি অর্ধশিক্ষিতদের হাতে অভিভাবকরা ‘পড়ে পাওয়া স্বাধীনতা’ বিলিয়ে দেয়, তাহলে তো নরক গুলজার। অথচ আমেরিকায় কৈশোরের এমন অকাল স্বাধীনতাটাই দস্তুর, মাত্রাজ্ঞানের বড় অভাব। এমন হাঁকডাক করে কিন্তু বাঙালি সমাজে বয়ঃসন্ধি আসে না। সেখানে ‘টিন এজ’ হাইস্কুলের প্রেমের মতো এমনি করে আসে, আর এমনি করেই যায়, ‘সে যে এসেছিল আকাশ তা বলেনি, হায় সেই রাতে দীপ মোর জ্বলেনি’! পক্ষান্তরে, আমেরিকাতে সেই অর্থে হাইস্কুল-ই হল যত নষ্টের গোঁড়া। টিন এজারদের হাতে মাত্রাতিরিক্ত স্বাধীনতা সঁপে দিতে পারলেই যেন অভিভাবকরা বাঁচে!
একটু ভেবে দেখলেই বোঝা যাবে, আপাতভাবে তথাকথিত উদারতা মনে হলেও, ব্যক্তি স্বাধীনতার দোহাই দিয়ে টিন এজারদের এমন মাথায় তোলার পিছনে অভিভাবকদের ফাঁকিবাজির মানসিকতাই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ছেলেমেয়েদের সামনে স্বাধীনতার খুড়োর কল ঝুলিয়ে দিয়ে, আসলে তাদের সমঝে দেওয়া হয় যে, ‘নিজের কাজ নিজে কর’। আর তার মানেই হল বাবা-মায়ের কাজ কমে যাবে। এবং সেই সুযোগে ছেলেমেয়েরা নিজেদের হাইস্কুল জীবনকে অভয়ারণ্য বানিয়ে ছাড়বে। এতদিনের নিষ্পাপ সরল পবিত্র সন্তানসন্ততিরা ক্রমশ বেপরোয়া কিশোরকিশোরী হয়ে উঠবে। সামাজিক অভিভাবক, শিক্ষকশিক্ষিকা, পুনর্বাসন কেন্দ্র, চিকিৎসক, এমনকি বাবা-মায়েরাও বলবে, ‘ইট হ্যাপেন্স, টেক ইট ইজি’! রাষ্ট্র আরও এক কাঠি ওপরে, তারা ১৬ বছরের ছেলেমেয়েদের হাতে গাড়ি চালানোর অনুমতিপত্র তুলে দেবে। এই চারচাকার অনুমতি পেয়ে টিন এজাররা যেন সাপের পাঁচ পা দেখে। অবশ্য সরকারি অনুমতির পরোয়া আর কতটুকুই বা করে টিন এজাররা! কৈশোরে পড়াশোনা শিল্পচর্চা খেলাধুলো সামাজিক স্বেচ্ছাসেবা নিশ্চয়ই হয়, কিন্তু তার সাথে পাল্লা দিয়েই হাইস্কুলে শুরু হয় অনেক নিষিদ্ধ বিধ্বংসী মাদকের চর্চা। সিগারেট, মদ, গাঁজা তো নস্যি। হাইস্কুলে বন্দুকবাজিও বিরল নয়। এমনকি হাইস্কুলেই শুরু হয় অবাধ যথেচ্ছ যৌনতা। আমেরিকাতে মিডিল স্কুলের শেষ দিকে (অষ্টম শ্রেণী) ছাত্রছাত্রীদের যৌনশিক্ষার পাঠ দেওয়া হয়, যে পাঠ্যক্রমে জন্মনিয়ন্ত্রণ শুধু নয়, অকাল যৌনতার কুপ্রভাব নিয়েও আলোচনা থাকে। কিন্তু অপরিণত মনের ছাত্রছাত্রীরা এর ভালো দিকটা ছেড়ে খারাপ দিকটার চাষ শুরু করে হাইস্কুলে। কাজেই মার্কিন হাইস্কুলে ‘সিঙ্গল মাদার’ বা ‘লাভ চাইল্ড’-এর ঘটনাও ঘটে। আর এই সঙ্গে আছে মহামারীর আকার নেওয়া ‘ডিপ্রেশন’! যাকে ‘মনগড়া মনোরোগ’ বলা যেতে পারে, কারণ আসলে সেটা ব্যারামের ছুতোয় একগাদা ঘুমের ওষুধে আচ্ছন্ন থাকার তাল। এতে যেমন অলসতার কৈফিয়ত খাড়া করা যায়, তেমনি সেই অজুহাতে পড়াশোনা জাতীয় কঠিন কাজগুলি থেকে সরে থাকা যায়, অর্থাৎ পলায়নবৃত্তি। সাইবার নেশার কথা আর তুললাম না। কারণ সে ব্যাধি শুধু পশ্চিমের নয়, সে অসুখে আক্রান্ত পূর্বও।
প্রসঙ্গত, সাইবার-মোহের কথা বাদ দিলেও, অন্য কিছু ক্ষেত্রেও যে বঙ্গসমাজের হাইস্কুলাররা ‘গোপাল অতি সুবোধ বালক’, তা মনে করার অবশ্য কোনও কারণ নেই। কিন্তু তারা যে নিষিদ্ধ বা অন্যায় কাজই করুক না কেন, তা ঘটে আড়ালে আবডালে, সমাজের কড়া নজরদারির সাথে লুকোচুরি খেলে। সর্বোপরি, বঙ্গ কৈশোরের এই বখে যাওয়া বা উচ্ছন্নে যাওয়ার প্রবণতা অনেকটাই চাপা পড়ে যায় বাবা-মায়ের সান্নিধ্য ও স্নেহের আশ্রয়ে। কিন্তু মার্কিন কৈশোরের নিষিদ্ধপনা ঘটে একেবারে খুল্লামখুল্লা। পারমিসিবল সোসাইটির ধোঁয়া তুলে পরোক্ষভাবে অপ্রস্তুত কৈশোরের সামনে মেলে ধরা হয় বেহিসেবি নিষিদ্ধপনার ছাড়পত্র। এই মর্মান্তিক কৈশোরে না থাকে মায়ের সোহাগের শাসন, না থাকে বাবার সুরক্ষার অনুশাসন। ফুর্তির প্রাণ গড়ের মাঠে বৃন্ত থেকে ছিঁড়ে নেওয়া আহত গোলাপের মতো পড়ে থাকে এক রিক্ত কৈশোর। তাদের নিঃস্ব হাহাকার চাপা পড়ে যায় বিলাসী বেলেল্লাপনার চিৎকারে।
একটু ইতিহাসে যাই। ভারতের দরজায় তখন কড়া নাড়ছে বহু প্রত্যাশিত স্বাধীনতা। আড়মোড়া ভাঙছে দুই শ’ বছরের পরাধীন একটা জাতি। আপনদেশে ফিরে যাওয়ার আগে তখন মাউন্টব্যাটেন সাহেব তাঁর ‘স্ত্রীর বন্ধু’ তথা ভারতের হবু প্রধানমন্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘জওহর, তোমাদের ভারত কি স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত’? মার্কিন সমাজ বা সংসারে, উদভ্রান্ত কৈশোরের সামনে এই প্রশ্নটা ঝুলিয়ে দেওয়ার রেওয়াজ নেই। কাজেই কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করে, কাউকে পাত্তা না দিয়ে, মার্কিন কৈশোর নিজগলে বেমানান এক অকাল স্বাধীনতার হার ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। কেউ তাদের বলে না, এই মণিহার তোমার নাহি সাজে!