গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
এখন সময় পাল্টেছে। নারী এখন শিক্ষার আলোকে আলোকিত— যুক্তিবাদী, প্রতিবাদী অনেকটাই। বাল্য বিবাহের বিরুদ্ধে সমাজ এখন সচেতন হয়েছে। মেয়েরা এখন সরকার থেকেও অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে স্বনির্ভর হচ্ছে। এরকম অবস্থায় বর্তমানকালের মেয়েরা নিজের অধিকার সম্পর্কে বিশেষভাবে সচেতন। অনেক মেয়েই নিজের জীবনসঙ্গী নিজেই খুঁজে নেয়। তবুও সব মেয়েকেই বিয়ের পর নতুন পরিবেশ, মানুষ, স্বামীর বাড়ির রীতিনীতির সঙ্গে মানাতে গিয়ে কিছুটা হলেও নিজেকে পালটাতে হয়। এখনও অনেক রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ আছেন যারা মেয়েদের থেকে ছেলেদের মতামত ও কার্যকলাপকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। এরূপ মানসিকতাসম্পন্ন স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকদের সঙ্গে মানাতে গিয়ে অনেক বিবাহিত নারীর মনে হয় সংসারে তার গুরুত্ব কতটা বা আদৌ কোনও গুরুত্ব আছে কি? বিয়ের আগে মা-বাবার সংসারে তার যে গুরুত্ব ছিল এখন বিয়ের পর তার গুরুত্ব অনেকটাই কমে গিয়েছে। আর এই মানসিকতার জন্য বিবাহিত নারীদের অনেককেই নানা সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়।
আমার মনে হয় বিবাহের পর নতুন সংসারে নানা বিষয়ে নিজেকে মানিয়ে নিতে গিয়ে যদি কোনও মেয়ে ভাবে তার গুরুত্ব কমে যাচ্ছে, স্বামী বা তার বাড়ির লোকরা তাকে ঠিকমতো গুরুত্ব দিচ্ছে না তাহলে বলব আত্মসম্মান বজায় রাখা যেমন প্রত্যেক নারীর কর্তব্য ঠিক সেইরকম মাথা ঠান্ডা রেখে পরিবেশ-পরিস্থিতি ভালো করে বুঝে সেই নারীকেই তার কথাবার্তা ও কাজের মধ্য দিয়ে নতুন পরিবারে নিজের গুরুত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। শুধু কি তাই, মা হওয়ার পর থেকে যে সন্তানকে শত আদর যত্ন করে বড় করে প্রতিষ্ঠিত করবার পর অনেক মা উপলব্ধি করেন সেই সন্তান তাকে আর বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না। সেই ভাবনা থেকেই নারী হীনম্মন্যতায় ভোগেন। একটা কথা মনে রাখতেই হবে কোনও মানুষকেই, বিশেষত নারীদের সম্মান, গুরুত্ব কেউ এমনি এমনি দেয় না। নিজেকে আপন কর্মের দ্বারাই গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে হয়।
মনস্তত্ত্ববিদের মতে—শিক্ষার অগ্রগতি, বিভিন্ন সরকারি প্রকল্পে মেয়েদের নানা সুযোগ-সুবিধা, স্বনির্ভর করে তোলার নানা প্রকল্প সর্বোপরি বাল্যবিবাহের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার এইসব কিছুর ফলে আগের থেকে মেয়েরা নিজেদের অধিকার সম্পর্কে অনেকটাই সচেতন হয়েছে। সচেতন হচ্ছে আমাদের সমাজও।
এটা যেমন সুখের কথা। তেমনই বাড়ির মেয়েদের মতো বাড়ির বউদেরও অধিকার ও মতামতের বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে অসুবিধাটা হল আমাদের সমাজের মানসিকতা পাল্টেছে তবে সম্পূর্ণ পাল্টাতে পারেনি। তাই সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য বউকে চাকরি করতে পাঠালেও তারা মনে করেন ঘরের বউ সব কাজ করবে কিন্তু তারও একটা গন্ডি থাকবে। কাজের প্রয়োজনে বেশি রাত করে বাড়ি ফিরলে মেয়েটিকে কৈফিয়ত দিতে হবে, সমালোচনা শুনতে হবে, শুধু ঘরে নয় প্রতিবেশীদের কাছেও। পুরুষ কলিগদের সঙ্গে বা বসের সঙ্গে পার্টিতে গেলে, ট্যুরে গেলে স্বামী থেকে শুরু করে অনেককেই কৈফিয়ত দিতে হয়। সমালোচনা শুনতে হয় মেয়েদেরই। অথচ স্বামীরা এসব করলে ছাড় পান অনেকটাই। সন্তানের দায়িত্ব মা-বাবার সমান হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাকেই সন্তানের সব দায়িত্বই সামলাতে হয়। অথচ সন্তানের অসুখ করলে, রেজাল্ট খারাপ করলে এমনকী বন্ধুদের সঙ্গে মারপিট করলেও বলা হয় কেমন মা, বাচ্চাকে সামলাতে পারে না, যত্ন করতে পারে না। পড়ার দিকে ভালো করে নজর দেয় না এইসব কিছু শুনতে হয় মাকেই। তাই সংসারে নারীর গুরুত্ব অপরিসীম। আগে বলা হতো—‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’ সেই সময় নারীর জগৎ ছিল চার দেওয়ালের ভিতর কিন্তু এখনকার মেয়েরা ঘরে-বাইরে দশভুজার মতো দু’হাতেই সবকিছু সামলাচ্ছেন। পরিবারের কারও অসুখ করলে আজকাল মেয়ে-বউরা রোগীকে ডাক্তার দেখানো হাসপাতালে ভর্তি থেকে শুরু করে প্রয়োজনে অনেক বড় সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধা করে না। আমি নিজের চোখে দেখেছি একজন তরুণী স্বামীর অনুপস্থিতিতে তার গুরুতর অসুস্থ শাশুড়িকে সুস্থ করবার জন্য নিজে রক্ত দিয়েছে। অপারেশনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আবার দু-রাত্রি হাসপাতালে কাটাবার পর অফিস গিয়েছে। আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে ঠান্ডা মাথায় আলোচনা করেছে। একা সেই মেয়ে তার মৃত্যুপথযাত্রী শাশুড়িকে সুস্থ করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে। এখন বলুন এই মেয়েটি সংসারে কতটা গুরুত্বশীলা।
তাই যাঁরা ভাবেন বিয়ের পর মেয়েদের গুরুত্ব কমে যায় তাঁরা সম্পূর্ণ ভুল ভাবছেন। আমি আমার কাজের মধ্য দিয়ে নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলব এটাই প্রত্যেক নারীর ভাবা উচিত। হ্যাঁ এই কথাও সত্যি যে, অনেক বিবাহিত নারী তার সংসারে বা কর্মক্ষেত্রে বিবাহ পরবর্তী জীবনে এমন অনেক সমস্যার সম্মুখীন হন তখন তাদের মনে হতেই পারে বিয়ের পর যখন অনেকেই আমাকে আগের মতো গুরুত্ব দিচ্ছে না তখন আর আমার কী হবে। এরূপ মানসিকতায় মেয়েরা অকারণে চেঁচামেচি করে, কেউ বা সামান্য কারণে রেগে যান। কেউ সংসার সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়েন, অকারণে টেনশন করেন এর ফলে তাদের শরীরের ওপরও এর প্রভাব পড়ে। এরকম ক্ষেত্রে মনোবিদের পরামর্শ নিলে মেয়েরা নিজেদের কনফিডেন্স ফিরে পান।
পরিশেষে বলব বিবাহের পর প্রত্যেক নারীকেই কিছুটা হলেও পরিস্থিতি ও পরিবেশের সঙ্গে তাল রেখে পাল্টাতে হয়। তাই ‘সুখী সংসার’ গড়তে প্রত্যেক বিবাহিত মেয়েই আত্মসম্মান বজায় রেখে অন্যায়ের সঙ্গে আপস না করে নিজের কর্ম সঠিকভাবে করতে পারলেই হয়ে উঠবেন তার পরিবার-প্রিয়জনের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। আর বিবাহিত নারীর এই রূপই কখনও দুর্গা, কখনও লক্ষ্মী আবার কখনও সরস্বতী।