উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
ঘটনা দুই: রেশমি আর রণিত দুজনেই আইটি প্রফেশনাল। ফুটফুটে একটা তিন বছরের কন্যাসন্তান রয়েছে তাঁদের। রণিত আর রেশমির সংসারের কাজ একদম ভাগ করা আছে। রণিত মেয়েকে সামলালে রেশমি সে সময় রান্না সেরে নেয়। ছুটির দিনে রণিত ঘর ডাস্টিং সহ মেশিনে কাচাকুচি করে। রেশমির দায়িত্ব তখন মেয়ের। রেশমি অফিস ট্যুর গেলে বাচ্চা রণিতের জিম্মায়। প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজনদের কাছে অবশ্য এ নিয়ে রেশমিকে নানা টিকাটিপ্পনী শুনতে হয়। রেশমি এই নিয়ে একটু লজ্জিত আর কুণ্ঠিত।
ঘটনা তিন: প্রতিবেশী মহিলা বন্ধুরা সবাই মিলে ঠিক করেছে বেড়াতে যাওয়া হবে শহর ছেড়ে দূরে। অমনি গেল গেল রব বাকিদের। ওমা! তোমরা একা একা যাবে? যা দিনকাল পড়েছে। পাড়ার আহ্লাদী বউদি হয়তো বলে ওঠেন, ‘আমার কর্তামশাই আমায় ছাড়বেনই না। আর মেয়েদের এত সাহসও ভালো না বাবা।’
আমরা আজকের প্রযুক্তি অধ্যুষিত সময়ে দাঁড়িয়ে অত্যাধুনিক শপিংমল আর মাল্টিপ্লেক্সে ঘুরে বেড়িয়ে সেজেগুজে মৌখিকভাবে যতই নারী স্বাধীনতার বুলি আওড়াই আসলে এই উত্তর আধুনিক সময়েও মেয়েদের সম্পর্কে একঘেয়ে বস্তাপচা মনোভাব থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি। একজন পুরুষের সঙ্গে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই একজন মহিলার ধ্যানধারণা হাত ধরাধরি করেই চলে এই সব বিষয়ে। একজন নারী, সে স্বনির্ভর, আত্মপ্রত্যয়ী। নিজের সুরক্ষা সম্বন্ধে সচেতন তবু তার বিয়ে না হলে একটা বয়েসের পর অভিভাবকেরা চিন্তায় জেরবার হয়ে পড়েন। মেয়েটিকে উপযুক্ত পাত্রের হাতে তুলে দিতে পারলেই দায়িত্ব শেষ। যেন কেল্লাফতে। বিয়ের পরে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরিরতা হলেও সংসারের মূল দায়িত্ব যেন কেবল একজন পুরুষেরই। নাহলে পাত্রপাত্রী বিজ্ঞাপনে এই একবিংশ শতাব্দীতেও আমরা দেখি একজন উচ্চশিক্ষিতা, নামীদামি পেশায় কর্মরতা নারী হলেও সে খোঁজ করে সুউপায়ী পাত্রের। আবার পুরুষটির কর্মরতা নারীটিও সংসারে সামান্য ত্রুটিবিচ্যুতি হলে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করান বেশিরভাগ সময়ে। সংসারের কাজ হয়তো দুজনে ভাগাভাগি করেই করছে তবু কাজের তাড়ায় পাউরুটি সামান্য পুড়লে মেয়েটি অপরাধ বোধে কুণ্ঠিত থাকে। আর বাড়ির পুরুষটি সামান্য গৃহকর্ম করে গর্বিত হন। ফলে আমরা নারী স্বাধীনতার বক্তৃতা যতই দিই, সেমিনার করি তাতে কিছু লাভ হয় না। গতানুগতিক মনোভাব থেকে বেরতে না পারলে মেয়েরা আর স্বাধীন হল কই?
সবার আগে প্রয়োজন এই বাঁধাধরা মনোভাব থেকে বেরিয়ে এসে মানসিকভাবে স্বাধীন হওয়া। মেয়েদের পেশার ক্ষেত্রেও একই মনোভাব সমাজ আর সংসারের। আজও আইটি, সাংবাদিকতা, পাবলিক রিলেশন পেশা হলে নানা মন্দ কথা, আলোচনা, সমালোচনার ঝড় ওঠে। যদিও অনেক মেয়েই এই ঝড়কে তুচ্ছ করে একলা লড়াইয়ের সাহস দেখাচ্ছে তবু আজকের এই গতির যুগেও দেখার চোখ আর খুঁত ধরবার ছল আর বদলালো কই? দেখা যাক এ বিষয়টা সমাজতত্ত্ববিদ আর মনরোগের চিকিৎসকেরা কীভাবে দেখেছেন?
ক্যালকাটা উইমেন্স কলেজের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক উজ্জ্বলকুমার দাসের মতে, ভারতবর্ষের সমাজ সংস্কারকের ভূমিকা যাঁরা পালন করেছিলেন তাঁরা বেশিরভাগই ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত। ধীরে ধীরে আধুনিকতার প্রকাশ ঘটেছে। তবে এখানে আরও একটা বিষয় রয়েছে লক্ষ করার মতো, শুধু ভারতবর্ষেই নয়, গোটা বিশ্বের বেশিরভাগ সমাজ ব্যবস্থাই মূলত পুরুষতান্ত্রিক। এই পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে মেয়েদের একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিল। স্বাধীনতার জন্য, সমানাধিকারের জন্য। ভারতবর্ষেও শুরু হয়েছিল এই আন্দোলন। তবে ভারতবর্ষের যে আধুনিকতা তা ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনের হাত ধরেই আসে। যদিও সেটা খুব স্বাভাবিকভাবে হয়নি। ফলত যে সমস্যাটা মূলে রয়ে গেল তা হল বস্তুগত সংস্কৃতির যত তাড়াতাড়ি উন্নতি ঘটেছে, শিক্ষার উন্নতি ও প্রসার যত দ্রুত হয়েছে মানসিকতার বদল কিন্তু সেভাবে ঘটেনি। সেই কারণেই আমরা যতই বাহ্যিকভাবে আধুনিকতার প্রকাশ করি দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু মধ্যযুগীয়ই রয়ে গিয়েছে।
কলকাতার সুপ্রসিদ্ধ মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রথমা চৌধুরির মতে, নারীমুক্তি ও শিক্ষা অনেকটা এগলেও এখনও অনেকটা পথ বাকি। নারী পুরুষ নির্বিশেষে এ সমাজের মানসিক দৈন্যতা রয়ে গিয়েছে। সমাজ তো ভাববেই, সমালোচনাও চলবে কিন্তু সব থেকে আশ্চর্যের মেয়েরাও সেভাবে সচেতন নন। নতুন প্রজন্মের মেয়েরা রোজগার করলেও তারা ধরেই নেয় তাদের টাকাটা সেকেন্ডারি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তারা মনে করে সংসারের ব্রেড আর্নার একজন পুরুষই হবেন। ফলত সমাজেও এই দৃষ্টিভঙ্গি চালু রয়েছে। বাড়ির কাজ সুন্দরভাবে সামলানো পুরুষটিকে যখন পরিজন বা প্রতিবেশীরা মেয়েলি বলে বিদ্রূপ করে তখন মেয়েটিও কিন্তু মনে মনে লজ্জিত হয়। এর থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সর্বপ্রথম মহিলাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে মানসিকতার সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ভীষণ জরুরি। সেখানে পরিবর্তন না হলে সমাজ বদলাবে না কোনও দিন। তাই সমাজ বদলানোর জন্য পুরুষের পাশাপাশি মেয়েদের মানসিকতারও বদল দরকার।
তনুশ্রী কাঞ্জিলাল মাশ্চরক