পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
মহাশ্বেতার কোনও তাজা উপন্যাস নয়। আশাপূর্ণার কোনও দরদী ছোটগল্পও নয়। একটা চিঠি। মায়ের চিঠি। এই মা কোনও পাঁচতারা হোটেলের কোনও সেমিনারে বা কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনও বিতর্কসভায় বক্তিমে-টক্তিমে দেননি। এই মা খুব সহজ সরল ভাষায়, ঈষৎ অবিন্যস্ত কলমে, অথচ সোনার হস্তাক্ষরে একটা চিঠি লিখেছেন।
এই মা যখন ওই চিঠিটা লিখছেন, তখন কফির কাপে তুফান ওঠেনি, শঙ্খ বাজেনি, উলুধ্বনিও দেয়নি কেউ। বরং তার কিছু আগে সেনাবাহিনীর বিউগলে বেজে উঠেছে অন্তিম সুর। ছয় বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে পিয়াল তখন তার ওই মায়ের শাড়ির আঁচল ধরে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঠিক তখনই সদ্য স্বামীহারা ওই মা, ‘ক্ষুদিরামের মা আমার, কানাইলালের মা’ ওই চিঠিটা লিখলেন। আর অমনি এই সীমান্তহীন বসুন্ধরায় একটা নতুন আকাশের জন্ম হল। কোনও বোমারু বিমানের আকাশ নয়, কাঁটাতারের বেড়াহীন একটা আকাশ, ‘যেখানে নারীরা থাকবে জুড়ে পৃথিবীর অর্ধেক আকাশ’!
এই চিঠিটার নেপথ্যে একটা তরতাজা গল্প আছে। আর পাঁচটা জীবনের মতোই সেই গল্পে একটা আপাত নিস্তরঙ্গ নদী আছে। কেউ জানত না যে, তার অথই অন্তরে আছে এত ঢেউ! উলুবেড়িয়ার এক গণ্ডগ্রামে ছিল এক ডাকাবুকো জোয়ান ছেলে। নাম বাবলু সাঁতরা। অবশ্য জোয়ান হওয়ার আগেই তার বাবা মারা যান। তেরো বছরের বাবলু সংসারের জোয়াল টানতে পাড়াগাঁয়ের বাজারে মাছ বিক্রি শুরু করে। এভাবেই কালের নিয়মে সে জোয়ান হয় এবং ঘরগেরস্থির অনটন সামলাতে সে জওয়ানের চাকরিতে যোগ দেয়, কোনও জাতীয়তাবাদের আবেগে নয়।
দিন যায়। বাবলু আর মিতার বিয়ে হয়। ওদের একটা মেয়ে হয়, পিয়াল। এরপর তাদের জীবনের চিত্রনাট্য আমূল বদলে যায়, এই কিছুদিন আগে। কাশ্মীরের পুলওয়ামায় নিরাপত্তার গাফিলতিতে ঘটে যাওয়া জঙ্গি হানায় শহিদ হন বাবলু। নিজেদের ত্রুটি ঢাকতে সরকার বাহাদুর ফরমান জারি করে, ইটের বদলে পাটকেল ছোঁড়া হবে। রাজার পারিষদরা চেঁচিয়ে উঠল, যুদ্ধ হবে। জঙ্গিহানার বদলে হঠাৎ যুদ্ধ হবে কেন, তা ভাবার সময় নেই। যা করার তাড়াতাড়ি করতে হবে, কারণ ভোট আসছে! যুদ্ধের জিগিরের সাথে শহিদের রক্ত আর মায়ের অশ্রু মিশিয়ে দিতে পারলে নাটক জমে যাবে। সরকার আর সংবাদ মাধ্যম যৌথ অভিযান চালিয়ে একজন মা-কে জোগাড় করে ফেলে। এই সেই চিঠি-লেখা মা, মিতা সাঁতরা। শহিদের স্ত্রী, শহিদকন্যার মা। সবাই মিলে তাঁকে প্রশ্ন করে, স্বামীর মৃত্যুর বদলা হিসাবে আপনি নিশ্চয়ই যুদ্ধ চান? বলুন, একটিবার গর্বের সাথে বলুন যে, আপনি যুদ্ধ চান! তাহলে আমরা আমাদের বিবেককে বোঝাতে পারব যে, আমরা নই, মা যুদ্ধ চেয়েছেন!
কিন্তু কোনও মা যুদ্ধ চান না। কোনও মা চান না আর একজন মায়ের কোল শূন্য করতে। এমনকি নিজের সন্তানের মৃত্যুর প্রতিশোধেও না। মিতা মা-ও চাইলেন না। উনি বললেন, ‘আমার স্বামীর মৃত্যুর বদলায় যুদ্ধ হোক আমি চাই না। বরং আমি চাই, সীমান্তে শান্তি থাকুক যাতে আর কোনোদিনও কোনও যুদ্ধ না লাগতে পারে’! আর এরপরেই মা ওই চিঠি লিখলেন। আর অমনি বহুদিনের পুরনো এক শান্তি মিছিলে গানের সুরে স্লোগান বাজল, ‘যুদ্ধ নয় যুদ্ধ নয়, ফুল ফোটাও গন্ধরাজ’!
মিতা, আপনি বিদুষী। আধুনিক ইতিহাসে উচ্চ শিক্ষিতা। আপনি নিশ্চয়ই জানেন যে, ইতিহাস আর ভূগোল, এই দুই-ই বড় নির্মম। ইতিহাসকে সব সময় ভূগোলই নিয়ন্ত্রণ করে। কখনও ক্ষমতার ভূগোল, কখনও ভূখণ্ডের ভূগোল। দেশপ্রেম থেকে কেউ যুদ্ধ করে না। যুদ্ধ আসলে একটা রাজার খেয়াল, রাজার হুকুম। রাজাদের এই যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় শুধু উলুখাগড়ারই প্রাণ যায়। যুদ্ধের মধ্যে একটা ব্যবসা থাকে। যুদ্ধের বোমা আর বুলেটে জড়িয়ে থাকে ব্যালটের লোভ।
মিতা, আপনি শুধু শহিদের বউ নন, আপনি একজন মা-ও। আপনি জানেন যে, যুদ্ধ রক্ত এবং অশ্রু ছাড়া আর কিছুই দিতে পারে না। মানুষকে ভালোবাসলে কেউ কখনও যুদ্ধ করতে পারে না। আপনি এটা জানেন বলেই, সদ্য স্বামীকে হারিয়েও, বাঁ হাতে সদ্য পিতৃহারা শিশুকন্যার হাত ধরেও, ডান হাতে আপনি ওই চিঠিটা লিখতে পেরেছেন । আপনি লিখেছেন, ‘যুদ্ধ চাই না’! আপনি একজন নারীর মতো নারী। আপনি একজন সত্যিকারের স্বাধীন নারী।