পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
তরঙ্গহীন গঙ্গার বুকে তখন রঙের খেলা সবে শুরু হয়েছে। সূর্যদেব অস্তগামী। তাই লাল, কমলা, হলুদের বন্যায় আকাশ তরঙ্গময়। সেই তরঙ্গ যেন তরঙ্গহীন নদীতে রঙের ঢেউ তুলছে। বিশাল জাহাজের ডেকটি হয়ে উঠেছে ওপেন এয়ার অডিটোরিয়াম। ঊষা উত্থুপ এলেন মঞ্চে। গোধূলির রাঙা আলো শরীরে মেখে ঊষার প্রথম নিবেদন— আই বিলিভ ইন মিউজিক, আই বিলিভ ইন লাভ...। সুর আর ভালোবাসায় যিনি বিশ্বাস রাখেন তিনিই ঊষা, সঙ্গীতশিল্পী পদ্মশ্রী ঊষা উত্থুপ। তাঁর গানজীবনের পঞ্চাশ পূর্তিকে সম্মান জানাতে দি কলকাতা ফেস্টিভ্যাল শুরু হল এই বিশেষ অনুষ্ঠান দিয়ে। অনুষ্ঠানের আয়োজক রোটারি ক্লাব অব ক্যালকাটা অ্যাভিয়ানা, আর্ট অ্যান্ড হেরিটেজ ফাউন্ডেশন, কলকাতা পোর্ট ট্রাস্ট এবং পশ্চিমবঙ্গ পর্যটন দপ্তর।
অনুষ্ঠান শুরুর আগে আমাদের ফোটোগ্রাফারের অনুরোধে ডেকের ধারে দাঁড়িয়ে ছবি তুললেন ঊষা। কথা হচ্ছিল তাঁর দীর্ঘ গানজীবন নিয়ে। সহজ, সাবলীল, আন্তরিক তাঁর ব্যবহার। অযথা অহংকার নেই, নেই কোনও কপটতাও। বললেন, গান গাইতেন ছোটবেলা থেকেই। কিন্তু প্রফেশনালি পারফর্ম করতে শুরু করেন ১৯৬৯ সালে। চেন্নাইয়ের একটি নাইট ক্লাবে। তাই ২০১৯ তাঁর জীবনের একটা বিশেষ বছর। ছোটবেলা থেকেই তিনি গানকে ভালো বেসেছেন। গান নিয়ে নতুন কিছু করার তাগিদ অনুভব করেছেন। এর জন্য বাধাও এসেছে অনেকবার, অনেক রকম।
কীরকম বাধা? জিজ্ঞেস করায় ঊষা মুচকি হেসে বললেন, তাঁদের ছোটবেলায় মহিলা সঙ্গীতশিল্পী মানেই তার কণ্ঠ সুমিষ্ট সুরেলা হতে হবে এই রকম একটা ধারণা ছিল সবার। স্কুলে গানের ক্লাস থেকে শিক্ষিকা তাঁকে বের করে দিয়েছিলেন তাঁর ওই দৃপ্ত পুরুষালি কণ্ঠের জন্য। ছোট্ট ঊষা সেদিন কষ্ট পেলেও হাল ছেড়ে দেননি। বরং গানের প্রতি আকর্ষণ তাঁর আরও বেড়ে গিয়েছিল।
ঊষার তিন দিদিই সঙ্গীতশিল্পী ছিলেন। ঊষার যখন মাত্র নয় বছর বয়েস তখন তাঁর দিদিই তাঁকে মিউজিশিয়ান হামির সায়ানির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই অর্থে গানের প্রশিক্ষণ না থাকলেও ছোটবেলা থেকে গানের আবহে থাকতে থাকতে গান ছড়িয়ে গিয়েছিল ঊষার শিরায় শিরায়। আর ছিল গানের প্রতি অসম্ভব প্যাশন। মাত্র নয় বছরেই তাঁর গান শুনে হামির সায়ানি তাঁকে রেডিও সিলোনে ওভালটিন মিউজিক আওয়ারে গান গাওয়ার সুযোগ দিয়েছিলেন। এরপর আরও অনেক অনুষ্ঠানে ছোট্ট ঊষা গাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
ভারতীয় সঙ্গীত ঘরানার সঙ্গে পশ্চিমী পপ জ্যাজকে মিলিয়ে দেওয়ার ধারা ঊষা উত্থুপের কণ্ঠেই প্রথম ধ্বনিত হয়েছিল। একেবারে অন্যরকম তাঁর কণ্ঠ, অনন্য তাঁর গায়কী।
বলিউডে তাঁর প্রথম পা রাখার সুযোগ এসেছিল হঠাৎই। দিল্লির ওবেরয় হোটেলে তাঁর জমজমাট পারফরমেন্সে অভিভূত হয়েছিলেন মুম্বইয়ের এক মিউজিক পার্সন। তাঁরই তৎপরতায় ‘হরে রামা হরে কৃষ্ণা’ গানটি গাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলেন ঊষা। গানটি সুপারডুপার হিট। এরপর বলিউডের একের পর এক হিন্দি ফিল্মে অজস্র হিট গান উপহার দিয়েছেন তিনি।
ভারতের প্রায় সব বড় শহরে প্রায় সব নামী নাইট ক্লাব ও পাঁচতারা হোটেলে তিনি গান করেছেন সেই কুড়ি বছর বয়স থেকে। কিন্তু কলকাতায় এসে কেন জানি না ভালোবেসে ফেললাম শহরটাকে। বাংলার শিল্প সংস্কৃতি সঙ্গীতপ্রীতি আমাকে মুগ্ধ করেছিল— বলছিলেন ঊষা। আর গানজীবনের পঞ্চাশ বছর পূর্তির অনুষ্ঠান কলকাতার গঙ্গাবক্ষে এমন একটা পরিবেশে অনুষ্ঠিত হওয়া আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি— আবেগে ঊষার চোখে আনন্দাশ্রু।
শুধু বাংলা-হিন্দি নয়, পাঞ্জাবি, গুজরাতি, মারাঠী, ওড়িয়া, কন্নড়, তামিল, তেলুগু, মালয়ালি ইত্যাদি পনেরোটি ভারতীয় ভাষায় গান করেন তামিল-কন্যা ঊষা। শুধু ইংরেজি নয়, বিদেশি আরও পাঁচটি ভাষাতেও তিনি গান গেয়েছেন। সেদিনের অনুষ্ঠানে তাঁর নানান ভাষার গানের জাদুতে মন্ত্রমুগ্ধ হলেন দর্শক।
ঘন কালো জরি চেক দক্ষিণী সিল্ক শাড়ি, লাল মণিপুরী স্টোল আর বড় টিপের চিরকালীন সাজ ঊষাকে আরও বর্ণময় করে তুলেছিল।
সন্ধ্যা নামল। জাহাজ তখন হাওড়া ব্রিজের নীচে। তাঁর গানজীবনের সুবর্ণ জয়ন্তীতে হাওড়া ব্রিজ সোনালি আলোয় সেজেছে সেদিন। উদাত্ত গলায় ঊষা তখন গাইছেন— আন্ডার দ্য ব্রিজেস অফ হুগলি উইথ ইউ, উই উইল মেক ইওর ড্রিমস কাম ট্রু...।