পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের একটি দরিদ্র পরিবারে জিমের জন্ম। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন বেশ বুদ্ধিমান এবং কিছুটা অদ্ভুত স্বভাবের। কিশোর বয়স থেকেই ধর্মের প্রতি তাঁর টান ছিল প্রবল। পেনটেকোস্টালিজমের মতো সংস্কারবাদী খ্রিস্টান ধর্মীয় মতবাদগুলোর প্রতি ছিল তাঁর বিশেষ আকর্ষণ। তরুণ বয়স থেকেই তিনি রাস্তায় রাস্তায় ধর্ম প্রচার শুরু করেন। বর্ণবাদ প্রথার বিরুদ্ধে তখন থেকেই তাঁর ছিল বলিষ্ঠ কণ্ঠ। একসময় খ্রিস্টান ধর্মের সঙ্গে সোশ্যালিজম জুড়ে দিয়ে তিনি এক নতুন ধরনের ধর্ম প্রচার শুরু করেন। জিম জোন্সের স্বকীয় ধর্ম প্রচার কৌশল, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার কণ্ঠ, সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি এবং সর্বোপরি তাঁর তারুণ্যের উদ্যম খুব দ্রুতই তাঁকে জনপ্রিয় করে তোলে। বেশ কিছু ভক্ত জুটে যায় তাঁর। তিনি তাঁর নতুন প্রচারিত মতবাদের নাম দেন ‘পিপল’স টেম্পল’।
১৯৬৫ সালে জিম তাঁর অনুসারীদের ইন্ডিয়ানা থেকে ক্যালিফোর্নিয়াতে গিয়ে বসবাস করার নির্দেশ দেন। সেইসময় তাঁর বয়স ছিল ৩৫ বছরের আশপাশে। তিনি ধীরে ধীরে সনাতন খ্রিস্টান বিশ্বাস থেকে দূরে সরে যেতে থাকেন এবং নিজেকে একজন মসিহা বলে দাবি করা শুরু করেন। তিনি নিজেকে গৌতম বুদ্ধ ও যিশু খ্রিস্টের মতো মহাপুরুষ হিসেবে জোর প্রচার চালাতে থাকেন। ইতিমধ্যে জোন্স ও তাঁর অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়াতে পিপল’স টেম্পলের একটি চার্চ প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকার সময়েই জোন্স একবার দাবি করে বসেন যে, তিনি নাকি বিভিন্ন ধরনের অদ্ভুত ঘটনা দেখাতে পারেন। তার মধ্যে একটি ছিল ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীকে সারিয়ে তোলা। যদিও আদতেই তিনি কাউকে কখনও সারিয়ে তুলতে পেরেছিলেন কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট ধোঁয়াশা রয়েছে। অবশ্য তাঁর ভক্তকূল এই প্রচার বিশ্বাস করেছিল। ১৯৭০ সাল নাগাদ পিপল’স টেম্পল রাজনৈতিক দলগুলোর সহানুভূতি পাওয়া শুরু করে। এইসময় জোন্সের সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সখ্য গড়ে ওঠে। নির্যাতিত জনগোষ্ঠীর পক্ষে সবসময় সোচ্চার থাকার কারণে জিম জোন্স ও তাঁর পিপল’স টেম্পল অ্যাঞ্জেলা ডেভিস এবং হার্ভি মিল্ক-এর মতো বামপন্থী নেতার এবং ব্ল্যাক প্যান্থারের মতো বিপ্লবী কৃষ্ণাঙ্গ গেরিলা সংগঠনের সাহায্য পাওয়া শুরু করে। ব্ল্যাক প্যান্থারের জন্যই বিপুল সংখ্যক আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিক পিপল’স টেম্পলের প্রতি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
জীবনের বেশিরভাগ সময় আমেরিকায় কাটানো জিম জোন্স কোনও এক কারণে আমেরিকার নিরাপত্তা নিয়ে সব সময় শঙ্কিত থাকতেন। তাঁর ধারণা ছিল, খুব শীঘ্রই আমেরিকার উপর নিউক্লিয়ার হামলা হবে। কিন্তু কেন হবে বা কারা তা করবে, সেই সম্পর্কে তিনি কখনও সুস্পষ্ট করে কিছু বলেননি। বরং এই নিউক্লিয়ার হামলার ধারণা তিনি তাঁর অনুসারীদের মধ্যে সজোরে প্রচার করতে থাকেন। নিজের মতাদর্শ এবং অনুসারীদের রক্ষা করার জন্য তিনি সবাইকে নিয়ে আমেরিকা ত্যাগ করার পরিকল্পনা করেন। সেই মতো ভূখণ্ডের খোঁজও চলতে থাকে। অবশেষে গায়ানার এক গহীন জঙ্গলের পরিত্যক্ত বিশাল একটি এলাকা পছন্দ হয় জোন্সের। ১৯৭৭ সালে তিনি ও তার অনুসারীরা ক্যালিফোর্নিয়া থেকে দল বেঁধে রওনা হন গায়ানার উদ্দেশে। সেখানে তারা পিপল’স টেম্পলের নতুন চার্চ স্থাপন করেন। গায়ানার ওই জঙ্গলে এক নতুন শ্রেণীহীন সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন জোন্স। তবে সরকার এবং গণমাধ্যমবিহীন ওই সমাজের প্রধান সমস্যা ছিল বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশ। অবশ্য জোন্সের অনুসারীরা আশপাশের বনজঙ্গল কেটে সেগুলোকে কৃষি জমিতে রূপান্তরিত করেন। শুরু হয় কৃষিভিত্তিক এক সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা, যা পরবর্তীতে জোন্সটাউন নামে খ্যাতি লাভ করে। জোন্সটাউনের সদস্যদের দিনের বেলায় বাধ্যতামূলক ১০ ঘণ্টা কাজ করতে হতো। সন্ধ্যার পর থাকত জিম জোন্সের বক্তৃতা শোনার পর্ব। সপ্তাহের কিছু কিছু রাতে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা হতো। অবশ্য চলচ্চিত্রের পরিবর্তে বাইরের পৃথিবী সম্পর্কে ভীতিমূলক বিভিন্ন তথ্যচিত্রই বেশি প্রদর্শিত হতো। বাইরের সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকায় জোন্সটাউনে খাদ্যের অভাব ছিল প্রবল। তার উপর যেকোনও ভুল কাজের জন্য শাস্তির ব্যবস্থা তো ছিলই। জোন্সটাউনে থাকা অবস্থায় স্বঘোষিত ধর্মগুরু জোন্সের স্বাস্থ্যের অবনতি হতে থাকে। তিনি ধীরে ধীরে বাস্তব জগৎ এবং কাল্পনিক জগৎ-এর মধ্যে পার্থক্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করেন। অবশ্য এসবের পিছনে উচ্চমাত্রার ড্রাগ গ্রহণ অন্যতম কারণ ছিল। একসময় তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে বাইরের শত্রুর আক্রমণের ভয় দেখাতে শুরু করেন। সেটাই হল কাল!
জোন্স প্রায়ই বলতেন যে, আমেরিকায় আফ্রো-আমেরিকানদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সেখানে তাদের উপর ভয়ঙ্কর অত্যাচার চালানো হচ্ছে। আমেরিকানরা এই গায়ানাকেও রেহাই দেবে না, কারণ আমরা নতুন এক সমাজ গঠন করেছি। তারা এখানে এসে আমাদের হত্যা করবে। জোন্সটাউনে আমেরিকানদের এই কাল্পনিক আক্রমণের একটি সমাধানও বের করে ফেলেন জোন্স। আর তা হল, গণ-আত্মহত্যা! অবশ্য জোন্স এর নামকরণ করেছিলেন ‘বিপ্লবী মৃত্যু’। তিনি তাঁর অনুসারীদের বলেন যে, যদি কখনও শত্রুপক্ষ জোন্সটাউন আক্রমণ করে, তবে সবাই যেন এই বিপ্লবী মৃত্যু স্বেচ্ছায় বরণ করে নেয়।
১৯৭৮ সালে যখন বর্ণবাদ এবং দারিদ্র্যমুক্ত জোন্সটাউনের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে, তখন একজন মার্কিন কংগ্রেসম্যান লিও রায়ান জোন্সটাউন প্রকল্প পরিদর্শনের সিদ্ধান্ত নেন। তিনি ১৮ জন সদস্যের একটি পরিদর্শক দল নিয়ে গায়ানার উদ্দেশে রওনা হন এবং ১৭ নভেম্বর, ১৯৭৮-এ জোন্সটাউনে জিম জোন্স এবং তার অনুসারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। জোন্সটাউনের পরিস্থিতি রায়ানের কাছে বেশ স্বাভাবিকই মনে হয়েছিল। জোন্সের অনুসারীরা যে স্বেচ্ছায় নিজেদের ঘরবাড়ি ত্যাগ করে গায়ানায় এসেছেন, তা-ও তিনি বুঝতে পেরেছিলেন। ফলে গায়ানা ত্যাগের পূর্বে জোন্সের কাছে নিজের সন্তুষ্টির কথা অকপটে প্রকাশ করেন তিনি। কিন্তু এরপরও কংগ্রেসম্যানের এই সফর নিয়ে জোন্সের উৎকণ্ঠা কাটলো না। তার ভয় হচ্ছিল, যদি রায়ান আমেরিকায় গিয়ে জোন্সটাউনের নামে কোনও বৈরী মন্তব্য করেন, তাহলে সরকার হয়তো তার গোটা জোন্সটাউন প্রজেক্টই বন্ধ করে দিতে পারে। তা যাতে না হয়, সেজন্য জোন্স তার সিকিউরিটি ফোর্সকে পরিদর্শক দলের উপর হামলা করার জন্য পাঠান। পরিদর্শক দল যখন গায়ানার বিমানবন্দরে পৌঁছয়, তখন তাদের উপর হামলে পড়ে জোন্সের বাহিনী। তাদের হামলায় চারজন পরিদর্শক নিহত হন। নিহতদের মধ্যে কংগ্রেসম্যান লিও রায়ানও ছিলেন। তাঁকে ২০ বার গুলি করা হয়েছিলেন।
আমেরিকান কংগ্রেসম্যান নিহত হয়েছেন। এখন তো জোন্স ও তাঁর পিপল’স টেম্পল-এর বাঁচার কোনও রাস্তা নেই। মার্কিন প্রশাসন অবশ্যই তাদের গ্রেপ্তারের জন্য সেনাবাহিনী পাঠাবে। তাই এই গ্রেপ্তার এবং গ্রেপ্তার পরবর্তী নির্যাতন এড়াতে জোন্স তার অনুসারীদের গণ-আত্মহত্যার নির্দেশ দেন। জোন্সের নির্দেশে সায়ানাইড মিশ্রিত একধরনের পানীয় ভর্তি ড্রাম নিয়ে আসা হয় চার্চ প্রাঙ্গণে। একে একে সবাই সেই পানীয় পান করে এবং ইঞ্জেকশনে করে নিজের শরীরে প্রবেশ করিয়ে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ে। সেদিন শিশুরাও বাদ যায়নি। তাদের শরীরেও ইঞ্জেক্ট করা হয় সায়ানাইড। অবশ্য জোন্স নিজে সায়ানাইডের মাধ্যমে আত্মহত্যা করেননি। সায়ানাইড গ্রহণের পর তাঁর অনুসারীদের যে প্রচণ্ড যন্ত্রণার মাধ্যমে মৃত্যু হচ্ছিল, তা দেখে তিনি ওই পথ ছেড়ে দেন। তার বদলে তিনি মাথায় গুলি করে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।
গায়ানার সেনাবাহিনী যখন কংগ্রেসম্যানের হত্যাকারীদের ধরতে জোন্সটাউনে যান, তাঁরা ভেবেছিলেন হয়তো জিম জোন্সের অনুসারীরা তাঁদের উপর আক্রমণ করবে। কিন্তু কোথায় তারা! জোন্সটাউনে পৌঁছনোর পর তারা অবাক। যত দূর চোখ যায়, শুধু লাশ আর লাশ। একজন আরেকজনের উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। যুবক, বৃদ্ধ, নারী, শিশু- কেউ বাদ যায়নি। সেদিনের সেই লাশের মিছিলের মধ্যে শিশু ছিল ৩০০ জন, যাদের বাবা-মা হত্যা করেছিল। বৃদ্ধ নাগরিকের সংখ্যাও ছিল ৩০০ জনের মতো। জোন্সটাউনের নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় তাদের শরীরে সায়ানাইড প্রবেশ করানো হয়। বাকিরা স্বেচ্ছায় বরণ করে নিয়েছিল মৃত্যুকে।
জোন্সটাউনের ঘটনাকে গণহত্যা বা গণ-আত্মহত্যা যাই বলা হোক না কেন, তা আমেরিকার ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়। ওইদিন যাঁরা মৃত্যুবরণ করেছিলেন, এমন নয় যে তাঁরা সবাই নিরক্ষর এবং নাগরিক জীবনযাত্রা সম্পর্কে অজ্ঞ। বরং জিম জোন্সের অনেক অনুসারীই ছিলেন উচ্চশিক্ষিত এবং সমাজে প্রতিষ্ঠিত। তাহলে কেনই বা এত বিপুল সংখ্যক মানুষ শুধুমাত্র একজনের কথায় স্বেচ্ছায় মৃত্যুর পথে পা বাড়িয়ে নিজেকে ধ্বংস করে দিলেন, সে প্রশ্নের উত্তর আজও অজানাই রয়ে গিয়েছে।
এই ঘটনাকে বিশ্ব মিডিয়া গণ-আত্মহত্যার পরিবর্তে গণহত্যা হিসেবেই প্রচার করে এবং এটি ‘জোন্সটাউন ম্যাসাকার’ হিসেবে ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পায়। ৯/১১-র আগে এটিই ছিল আমেরিকার ইতিহাসে একসঙ্গে সবচেয়ে বেশি নাগরিকের মৃত্যুর ঘটনা। ৯০০ জনের বেশি মানুষ মারা যায় ওই গণহত্যায়। আর তা একজন ক্যারিশম্যাটিক আমেরিকান ধর্মগুরুর বিশ্বাসে ভর করে!