জিতে গেলেন শ্যামাপ্রসাদ
জিষ্ণু বসু
দিনটি ছিল ১১ মে, ১৯৫৩। পারমিট ছাড়া কাশ্মীরে প্রবেশের অপরাধে পাঠানকোটের মাধোপুর সীমান্তে গ্রেপ্তার হলেন শ্যামাপ্রসাদ। সেখান থেকে শ্রীনগর ৩০০ কিমির বেশি। এতটা পথ পুলিসের জিপে আনা হল তাঁকে। মাত্র কয়েক বছর আগে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাঁকে প্রথমে শ্রীনগরের সেন্ট্রাল জেলে রাখা হল। তার পর শহরের বাইরে একটা বাংলোয়। সেখানে না-ছিল ঠিকঠাক খাবার, না-দেওয়া হতো ওষুধপত্র। পুরনো শুকনো হাঁপানি আবার বেড়ে গেল, সঙ্গে পিঠে ব্যথা আর রাত্রে ধুম জ্বর। ২৩ জুন ভোট ৩টে ৪০ মিনিটে চলে গেলেন শ্যামাপ্রসাদ। কিন্তু, কেন অকালে এত কষ্ট সহ্য করে প্রাণ দিতে হল দেশবরেণ্য মানুষটিকে? কী চেয়েছিলেন তিনি? তিনি চেয়েছিলেন এক দেশে একজনই প্রধানমন্ত্রী থাকবেন। একটিই আইন হবে আর জাতীয় পতাকাও এক হবে। মানে, সংবিধানে কাশ্মীরের জন্য যে বিশেষ ব্যবস্থা দেওয়া হয়েছে ৩৭০ ধারাতে তা তিনি মানবেন না। স্বাধীন ভারতে প্রথম শহিদ হলেন তিনি।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট। ভারতের ইতিহাসে এক স্মরণীয় দিন। দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিলের কথা ঘোষণা করলেন। সেইসঙ্গে মাননীয় রাষ্ট্রপতি বিলোপ করলেন সংবিধানের ৩৫এ ধারা—যার বলে এতদিন কাশ্মীরে আলাদা করে স্থায়ী বাসিন্দার সংজ্ঞা দেওয়া হতো। ভারতের অন্যকোনও প্রদেশের নাগরিক সেখানে স্থাবর সম্পত্তির অধিকারী হতে পারতেন না। শ্যামাপ্রসাদ ঠিক যেমনটি চেয়েছিলেন ৬৬ বছর পর ঠিক তাই হল। কাশ্মীর ভারতের অন্যসব এলাকার মতোই সমান মর্যাদা পেল। দেশের সর্বস্তরের মানুষ এই বলিষ্ঠ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। সরকারের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বিজু জনতা দল, বহুজন সমাজ পার্টি, আম আদামি পার্টির মতো বিরোধীরাও।
সমর্থন করেছে মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ুর প্রায় সব ক’টি আঞ্চলিক দল। রাজ্যসভায় এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন তৃণমূল কংগ্রেসের ডেরেক ও’ ব্রায়েন। তাঁর মতে, এই ৩৭০ ধারা বিলোপের দিনটি হল ‘কালো সোমবার’! ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও ৩৫এ ধারা বিলোপের বিষয়ে গভীর আপত্তি জানিয়েছে। কারণ, ওই ধারা মতে, কেবল কাশ্মীরের ভূমিপুত্ররাই কাশ্মীরের জমির অধিকারী হবেন।
কিন্তু ভূমিপুত্র আসলে কারা? যে ছ’লক্ষের বেশি কাশ্মীরি পণ্ডিত মৌলবাদীদের অত্যাচারে নিজের দেশেই উদ্বাস্তু হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন তাঁরা কাশ্মীরের স্থায়ী বাসিন্দা নন? ১৯৮৯ সালের আগস্ট থেকেই উপত্যকায় জেহাদি দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকে। রাজ্যের ক্ষমতায় তখন শেখ আবদুল্লার ছেলে ফারুক আবদুল্লা। কাশ্মীরি পণ্ডিতদের জনপ্রিয় রাজনেতা ছিলেন টিকালাল টাপলু। প্রকাশ্যে খুন হলেন তিনি। ১৯৮৯ সালের ৪ নভেম্বর নির্মমভাবে হত্যা করা হল বিচারপতি নীলকণ্ঠ গঞ্জুকে। বিচারপতির দেহ প্রকাশ্য রাজপথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকল। কেউ স্পর্শ করতেও সাহস করল না! শিক্ষিকা গিরিরাজ টিপ্পুকে গণধর্ষণ করে হত্যা করা হল! ১৯৯০ সালের ১৯ জানুয়ারি জেহাদিরা মাইকে ঘোষণা করল—পণ্ডিতরা যেন কাশ্মীর উপত্যকা ছেড়ে চলে যান। ন্যাশনাল কনফারেন্সের সরকার কেবল দর্শকের ভূমিকায় ছিল। সেদিন কিন্তু কোনও বামপন্থী দল, কোনও লেফট লিবারাল স্তম্ভ লেখক প্রশ্ন তোলেননি কেন এই সভ্য যুগেও একটি এলাকার আদি বাসিন্দাদের এত নির্মম অত্যাচার করে বিতাড়িত করা হবে?
সংবিধানের ৩৭০ ধারা কাশ্মীরের হিন্দু বা মুসলমান কারোরই কোনও উপকার করেনি। যেখানে সারা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ নিজেকে সম্পূর্ণরূপে ভারতীয় ভেবে উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছচ্ছেন, তৈরি হয়েছেন এ পি জে আব্দুল কালামের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব আর সেখানে কাশ্মীরে একটি ছেলে যুবক হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে বিচ্ছিন্নতাবাদের পাঠ পেয়েছেন। কখনও জয়েশ-ই-মহম্মদ, কখনও লস্কর-ই-তোইবা, হিজবুল মুজাহিদিনের মতো জঙ্গি সংস্থার হাতের পুতুল তৈরি হয়েছেন। কাশ্মীরে ৩৭০ বা ৩৫এ ধারা থাকার জন্যই আল কায়েদা বা আইএসআইএস উৎসাহ পেয়েছে কাশ্মীরকে জেহাদের লক্ষ্য বানাতে।
কিন্তু কাশ্মীর থেকে ভারতীয়ত্ব মুছে ফেলা অত সহজ ছিল না। কাশ্মীরের সংস্কৃতির হৃদপিণ্ডই হল ভারতবর্ষ। ইউরোপের অনেক ঐতিহাসিক কারকোটা বংশের রাজা ললিতাদিত্য মুক্তাপিড়কে ‘ভারতবর্ষের আলেকজান্দার’ বলেছেন। কাশ্মীরের এই রাজা আজকের আফগানিস্তান হয়ে মধ্যপ্রাচ্য পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলেন। সময়টা ৭৫০ খ্রিস্টাব্দের আশপাশে। ভারতবর্ষের সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ দার্শনিক অভিনব গুপ্ত দশম শতকে এই কাশ্মীরেই জন্মেছিলেন। জগদ্গুরু আদি শঙ্করাচার্য কাশ্মীরে এসে খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে এক মন্দির খুঁজে পান। সেই মন্দিরকে সংস্কার করেই তিনি তৈরি করেন জ্যোতিশ্বর শিবের মন্দির। সংস্কৃত সাহিত্যের যুগান্তকারী সৃষ্টি ‘রাজতরঙ্গিনী’ কবি কাশ্মীরে বসেই লিখেছিলেন। ১১৪৮ খ্রিস্টাব্দের কিছু আগে-পরে লোহার রাজহর্ষের রাজসভায় পরিবেশিত হয়েছিল রাজতরঙ্গিনী। স্বামী বিবেকানন্দ অমরনাথ দর্শনে গিয়েছিলেন, ক্ষীরভবানী মন্দিরে গিয়ে আকুল হয়ে কেঁদেছিলেন। কাশ্মীর উপত্যকার কোণায় কোণায় ভারতবর্ষের হাজার হাজার বছরের সভ্যতার স্পর্শ। বিদেশি মদতপুষ্ট জেহাদিরা শত চেষ্টা করেও যা নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। তাই আরও উগ্র আর হিংস্র হয়েছে তাদের আচরণ। হিন্দু কী মুসলমান—যে মানুষই ভারতের পক্ষ নিয়েছেন তাঁকেই তারা নির্দয়ভাবে হত্যা করেছে।
অবাক করার মতো বিষয় হল—এই নরঘাতক জঙ্গিদেরকে আগাগোড়া সমর্থন করে এসেছেন তথাকথিত বাম ‘মুক্তমনা’ বুদ্ধিজীবীরা। দিল্লি বা কলকাতার কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণ দেওয়ার জন্য আনা হয়েছে এমন কুখ্যাত জল্লাদদের। ধর্মান্ধ জেহাদি আর নাস্তিক বামপন্থীকে একমঞ্চে এনেছে একটাই স্লোগান—‘ভারত তেরে টুকরে হোঙ্গে’। দুই শিবিরের মূল লক্ষ্যই হল—ভারতকে টুকরো টুকরো করা। এই বোঝাপড়া তাদের কেবল বিচারের ক্ষেত্রে নয় লড়াইয়ের ময়দানেও এক করেছে। ২০১০ সালে কলকাতার সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরির অধিকর্তা এক সাংবাদিক বৈঠকে জানিয়েছিলেন, কীভাবে মাওবাদীরা কাশ্মীরের মুজাহিদিনদের সাহায্যে আফগানিস্তানের তালিবানদের কাছ থেকে দূর নিয়ন্ত্রিত বিস্ফোরণ প্রযুক্তি সর্বপ্রথম ভারতে এনেছিল।
সংবিধানের ৩৭০ ধারা যে এমনই ভয়ানক বিপদ ডেকে আনবে তা সর্দার প্যাটেল, বাবা সাহেব আম্বেদকর, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়রা বুঝেছিলেন। কিন্তু পণ্ডিত নেহরুর অর্থহীন জেদ আর শেখ আব্দুল্লাকে খুশি করার আশ্চর্য বাসনা দেশের বুকে এত বড় বিপদ ডেকে এনেছিল। শেখ আব্দুল্লাকে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন বাবা সাহেব আম্বেদকর। সংবিধানের জনক এই প্রাজ্ঞ মানুষটি উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন, ভারতের সেনা জওয়ানরা বুকের রক্ত দিয়ে কাশ্মীরকে পাহারা দেবে আর ভারতের কোনও নাগরিকের সেই ভূখণ্ডে কোনও অধিকার থাকবে না—এরকম অন্যায় তিনি হতে দেবেন না। বেগতিক দেখে বাবা সাহেবকে এড়িয়ে জওহরলাল নেহরু এই ৩৭০ ধারা সংসদে এনেছিলেন। এ নিয়ে আলোচনার দিন আম্বেদকরজি একটিও প্রশ্নের উত্তর দেননি। আর প্রতিবাদ করেছিলেন ভারতকেশরী শ্যামাপ্রসাদ।
শ্যামাপ্রসাদ খুব কম বয়সে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন। উপাচার্য হিসেবে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি সমাবর্তন ভাষণ দেওয়ার আমন্ত্রণ জানান। পরাধীন ভারতে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো ঐতিহ্যমণ্ডিত শিক্ষাক্ষেত্রে গুরুদেব বাংলায় ভাষণ দিলেন! সে সাহস কেবল শ্যামাপ্রসাদেরই ছিল। আজকে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের প্রতিষ্ঠার সময় বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার সবচেয়ে বড় ভরসাস্থল ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কাজী নজরুল ইসলাম এক পত্রে লিখেছিলেন নতুন স্বাধীন ভারতের কাণ্ডারী হবেন সুভাষচন্দ্র বসু আর শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। এই কৃতী বঙ্গসন্তান দেশের জন্য সবকিছিু ছেড়ে সুদূর কাশ্মীরে গিয়ে প্রাণ দিলেন।
অথচ, আজ যখন শ্যামাপ্রসাদের আত্মবলিদান সার্থক হয়েছে তখন বাংলার মানুষ রাজনৈতিক বিভেদ ভুলতে পারলেন না। ৩৭০ ধারা বিলোপের পথে হাতে হাত ধরে বাধা দিচ্ছে তৃণমৃল কংগ্রেস আর ভারতের মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টি। সংসদের উচ্চ কক্ষে রাজ্যের তৃণমূল কংগ্রেসের প্রতিনিধি এর বিরোধিতা করেছেন। সংসদে বাংলা থেকে বামেদের কোনও প্রতিনিধি নেই। তাই তাঁরা বাইরে প্রতিবাদ করেছেন। গত সোমবার মহাজাতি সদনে সিপিএম দলের রাজ্য সম্পাদক সংবিধানের ৩৭০ ধারা ও ৩৫এ ধারা সংরক্ষণের জন্য লড়াই চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছেন। দলীয় মুখপত্র প্রথম পাতায় ‘সংবিধানে ছুরিকাঘাত’ বলে অভিহিত করেছে ৩৭০ ধারা বিলোপকে। পাকিস্তানও বিব্রত। ইসলামাদে নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনারকে ডেকে পাঠিয়ে সতর্ক করা হয়েছে। ৩৭০ ধারা খারিজের এই ‘বেআইনি’ এবং একতরফা সিদ্ধান্তের মোকাবিলা করবে বলে জানিয়েছে পাকিস্তান।
কিন্তু সারা ভারতের মহল্লায় মহল্লায় আজ উৎসবের চেহারা। শত শত মানুষ প্রাণ খুলে স্লোগান দিচ্ছেন—‘‘যাহা হুয়ে বলিদান মুখার্জি, ওহ কাশ্মীর হমারা হ্যায়।’’ সত্যিই জিতে গেলেন শ্যামাপ্রসাদ।
সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স-এ কর্মরত
07th August, 2019