বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
অবশ্য, এনআরএসে দুষ্কৃতী হামলা ও হেনস্তার প্রতিবাদে জুনিয়র ডাক্তারদের লাগাতার আন্দোলন থামিয়ে রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বাভাবিক পরিষেবা ফিরিয়ে আনতে শেষ ভরসা ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতাই। কারণ, ডাক্তার আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি তখন এমন জটিল আকার নিয়েছে যে, সকলেই বুঝতে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া কারও পক্ষেই ওই সমস্যা মেটানো সম্ভব নয়। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী বা রাজ্যপাল উপদেশ দিতে পারেন, নানান জনের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেন, তবে কার্যক্ষেত্রে সমস্যা মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ ছাড়া মেটা মুশকিল। কিন্তু, অবস্থা যখন চরমে, রাজ্যের সীমা ছাড়িয়ে আন্দোলনের ঢেউ যখন ছড়িয়ে পড়েছে দিল্লি সমেত দেশের বিভিন্ন প্রান্তে, বাস্তব পরিস্থিতি সরজমিনে দেখতে-বুঝতে মূল ঘটনাকেন্দ্র এনআরএসে না গিয়ে পিজিতে যাওয়ায় আন্দোলনকারী জুনিয়র ডাক্তারদের ক্ষোভ অভিমানের মুখে তখন তিনিও!
তাহলে? কীভাবে মিটবে আন্দোলন! কে মেটাবেন? ডাক্তারের অভাবে সরকারি হাসপাতালগুলোতে স্বাস্থ্যপরিষেবা তলানিতে। চিকিৎসা না পেয়ে সাধারণ রোগীরা অথৈ জলে। বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর অভিযোগ উঠছে। বিজেপি সভাপতি দিলীপ ঘোষ বা তাঁর সমমনোভাবাপন্নেরা রোগীসেবা চালু রেখে আন্দোলনের অনুরোধ জানাচ্ছেন। তাতে আন্দোলনরত জুনিয়রেরা বা তাঁদের সমর্থনে এগিয়ে আসা সিনিয়রেরা কেউ কর্ণপাত করছেন না। আন্দোলনকারীদের সঙ্গে রাজ্যের শিক্ষাস্বাস্থ্য দপ্তর বা ডাক্তার সংগঠনের কর্তা-নেতাদের বৈঠক করার চেষ্টা দফায় দফায় ব্যর্থ হচ্ছে। উল্টে নির্মল মাজি শান্তনু সেনদের মতো ডাক্তার নেতারা আন্দোলনকারীদের অসন্তোষ ও কঠিন বিক্ষোভের মুখে পড়ছেন। আন্দোলনে বাড়তি ইন্ধন জোগাতে শুরু করেছে সরকারি হাসপাতালের বড় বড় ডাক্তারবাবুদের গণইস্তফা। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি এমন যে শাসক-বিরোধী থেকে আমজনতা—সব মহলেই একরকম অকূল পাথারে! রাজ্যের হাসপাতাল সমস্যা কবে মিটবে, কীভাবে মিটবে, কে মেটাবেন কেউই যেন বুঝেই উঠতে পারছেন না! সঙ্গত কারণেই দুশ্চিন্তা গভীরতর হচ্ছে বাংলার ঘরে ঘরে, বিশেষত, অসহায় সাধারণ রোগী ও তাঁদের আত্মীয় পরিজনেদের মধ্যে। দিল্লির এইমস সমেত দেশের বিভিন্ন নামজাদা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা পশ্চিমবঙ্গের জুনিয়র ডাক্তারদের সমর্থনে আন্দোলন প্রতিবাদে নামতে থাকায় স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যের সাধারণ মানুষজনের মধ্যে উদ্বেগ অনিবার্যভাবেই আরও বাড়ছিল। অনেককেই বলতে শোনা গেছে—এবার কী হবে? সব কিছু হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে না তো?!
তখনই অবশ্য এই কলমে লেখা হয়েছিল, সমাধান একটা হবেই। হতেই হবে। স্বাস্থ্যপরিষেবার মতো এমন অত্যাবশ্যক গুরুত্বের ক্ষেত্র আন্দোলনের জেরে দিনের পর দিন কিছুতেই বন্ধ হয়ে থাকতে পারে না। হাজার হাজার মরণাপন্ন রোগী কিছুতেই এভাবে সম্পূর্ণ বিনা দোষে পরোক্ষ লাঞ্ছনার শিকার হতে পারেন না। গত রবিবার এই লেখা প্রকাশের পরদিনই সেই ‘চমৎকার’ ঘটল এবং অনিবার্যভাবেই তা ঘটালেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের দাবিদাওয়ার প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে এবং হাসপাতালের অন্দর-বাহিরের নিরাপত্তা সমেত যাবতীয় সমস্যা সমাধানে সরকারি সক্রিয়তার পূর্ণ আশ্বাস দিয়ে নবান্নে এক মিটিংয়েই বাজিমাত করলেন মমতা। জুনিয়র সিনিয়র নির্বিশেষে সমস্ত চিকিৎসক মুখ্যমন্ত্রী মমতার ভূমিকা ও সদর্থকতায় অভিভূত হয়ে একবাক্যে তুলে নিলেন আন্দোলন। আর তার ফলে দিনের পর দিন অচল হয়ে থাকা রাজ্যের হাসপাতাল স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রাতারাতি সচল হল পরিষেবা, দূরদূরান্ত থেকে চিকিৎসা করাতে আসা শিশু, বৃদ্ধ নারীপুরুষ গরিবগুর্বো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, টিভিতে তাঁদের চোখ-মুখই বলে দিচ্ছিল— দুঃখের আঁধার রাত্রি কেটে গেছে।
কিন্তু, মজার ব্যাপার—মুখ্যমন্ত্রীর মাস্টার স্ট্রোকে হাসপাতালের অচলাবস্থা দূর হতেই দেখলাম রাজনীতি ও তৎসংলগ্ন বিভিন্ন মহলে একশ্রেণীর লোক ওই টানাপোড়েনের নিষ্পত্তিতে কার জয় হল, কে ‘নতিস্বীকার’ করল তাই নিয়ে তরজায় মেতেছেন! এবং অনেক ক্ষেত্রেই বলতে শুনলাম, চাপে পড়ে মুখ্যমন্ত্রী নাকি ‘নতিস্বীকার’ করলেন আর নৈতিক জয় হল জুনিয়র ডাক্তারদের। সিপিএমের মুখপত্র ‘গণশক্তি’ বিরাট বড় টাইপে প্রথম পাতায় লিখল—‘মাথা নোয়ালো নবান্ন’! কেন? না, আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের শর্ত মেনে (মানে মিটিংটার লাইভ টেলিকাস্টের ব্যবস্থা করা, ডাক্তারদের ১২ দফা দাবি মেনে নেওয়া ইত্যাদি!) মুখ্যমন্ত্রীকে সব ব্যবস্থা করতে হল! হাসপাতালের নানান সমস্যার কথা শুনতে হল— আশ্বাস দিতে হল দ্রুত সমাধানের! ভাবুন কাণ্ড! যেন ওদের ওইসব সাধারণ দাবি না মেনে, সমস্যার কথা না শুনে হাজার হাজার অসহায় অসুস্থ মরণাপন্ন মানুষকে আরও অসহায়তার দিকে ঠেলে দিয়ে গোঁ-ধরে বসে থাকলেই মুখ্যমন্ত্রী ভালো করতেন! সেটাই যেন প্রত্যাশা করেছিলেন কেউ কেউ! আহাম্মক আর কাকে বলে! হাজার হাজার রোগীর চরম ভোগান্তি দেখেও মুখ্যমন্ত্রী চুপ করে
বসে থাকবেন আর ধান্দাবাজেরা আন্দোলনরত জুনিয়র ডাক্তারদের শিখণ্ডী করে ঘোলা জলে মাছ ধরে বেড়াবেন, রাজনৈতিক ফায়দা লোটায় মত্ত হবেন! কী মজা!
কিন্তু তাই কি হয়! হতে পারে!? হতে যে পারে না সেটা তো মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছা সক্রিয়তা শেষ পর্যন্ত প্রমাণ করে দিয়েছে। তাতেও নাছোড় আহাম্মকরা। রাজ্যের স্বাস্থ্যব্যবস্থা কতটা বেহাল, ডাক্তার নিরাপত্তা কতটা শিথিল ইত্যাদি প্রভৃতি নানান কিছু ঠারেঠোরে দেশ-রাজ্যের জনতাকে বোঝাবার চেষ্টা করে চলেছেন তাঁরা। অথচ তাঁরা এটা বলছেন না যে, জুনিয়র ডাক্তারেরাও সদিচ্ছার পরিচয় রেখে বৈঠকের স্থান নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রীর ইচ্ছেটা মেনে নিয়েছেন। ডাক্তারেরা তো নবান্নের নাম শুনে প্রথমে অন্য কোনও ‘নিরপেক্ষ’ জায়গার দাবি তুলেছিলেন। কিন্তু শেষ অবধি নবান্ন তো তাঁরাও মেনেছেন? তাহলে কি এটা সরকারের সামনে তাঁদের ‘নতিস্বীকার’ হল? মাথা নোয়ানো হল, হার হল! নাকি এতদ্বারা প্রমাণিত হল যে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো আন্দোলনরত জুনিয়র সিনিয়র ডাক্তারবাবুদেরও রোগীসেবার স্বার্থে আন্দোলন শেষ করে কাজে নামার একটা তাগিদ ছিল, সদিচ্ছা ছিল। আপনারাই বলুন।
বলতে কী, এ রাজ্যে জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলন নতুন নয়। রোগীর আত্মীয়পরিজন বা বহিরাগত দুষ্কৃতীদের হাতে ডাক্তার নিগ্রহও নতুন না। এবং তা নিয়ে ক্ষোভ বিক্ষোভ আন্দোলনও কম দেখেনি এই বাংলা। জ্যোতিবাবুর আমল থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের জমানা—জুনিয়র ডাক্তার আন্দোলনের ট্র্যাডিশন যে বহাল আছে সাম্প্রতিক ঘটনা তারই প্রমাণ। সেইসঙ্গে এটাও বলতে হয় অতীতেও আন্দোলন শেষ হয়েছে সমস্যা সমাধানের সরকারি আশ্বাসে কিন্তু কাল ঘুরতেই বোঝা গেছে সেই আশ্বাসে কাজের কাজ খুব কিছু হয়নি। এবারও হবে কি না সেটা সময়ই বলবে। তবে, এবারের বৈঠকের একটা বৈশিষ্ট্য আছে। মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং অন ক্যামেরা এই বৈঠক করেছেন। এমনটা জ্যোতি বসুই হোন কি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য— বাম জমানায় যতদূর মনে পড়ছে একটি ব্যতিক্রম ছাড়া দেখা যায়নি। দ্বিতীয়ত, সিপিএমের আমলে হাসপাতাল পরিষেবার পরিকাঠামো পরিধি, হাসপাতালের সংখ্যা, অত্যাধুনিক চিকিৎসার যন্ত্রপাতির পরিমাণ ও রোগীদের কাছে তার সহজলভ্যতা, বিনামূল্যের চিকিৎসা, ওষুধপত্র ইত্যাদি আজকের মতো এত ছিল কি? বলছি না যে বাম আমলে সরকারি হাসপাতালে মানুষ চিকিৎসা পেতেন না, নিশ্চয়ই পেতেন। কিন্তু, গত সাত-আট বছরে সেই চিকিৎসার সুযোগ যে মুখ্যমন্ত্রী তথা স্বাস্থ্যমন্ত্রী মমতা গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষজনের কাছে অনেক বেশি সহজপ্রাপ্য করে তুলতে পেরেছেন— সেই সত্য অস্বীকার করা যাবে কি?
তার মানে অবশ্যই এই নয় যে, রাজ্যের সরকারি হাসপাতালগুলোতে তেমন কোনও সমস্যা নেই। সাম্প্রতিকে ডাক্তার নিগ্রহের বেশ কয়েকটি ঘটনা প্রমাণ করেছে— সরকারি হাসপাতালের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় যথেষ্ট গলদ আছে। সংশ্লিষ্ট পুলিসের ভূমিকাও অনেক ক্ষেত্রে সন্তোষজনক নয়। পুলিসি নিষ্ক্রিয়তায় কোনও কোনও ক্ষেত্রে হাসপাতাল কার্যত এক শ্রেণীর গুন্ডাপ্রকৃতির মুক্তাঞ্চল হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ। সেইসঙ্গে রোগীর বিপুল চাপ সামলাতে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ডাক্তারের অভাব, ওষুধপত্রের জোগানের অভাব, দালালদের দাদাগিরি রোগী ও তাঁর আত্মীয়দের সঙ্গে হাসপাতালের ডাক্তার কর্মী কর্তাদের একাংশের দুর্ব্যবহার ইত্যাদি হরেক সমস্যা তো আছেই। মুখ্যমন্ত্রী গত সোমবারের বৈঠকে কোনও সমস্যাই কিন্তু এড়িয়ে যাননি। নিরাপত্তা জোরালো করতে তো ইতিমধ্যেই কড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে শুনেছি। বাকিগুলোর সমাধান হতেও দেরি হবে না— অন্তত স্বাস্থ্যশিক্ষা দপ্তরের তথ্যভিজ্ঞরা তেমনই মনে করছেন।
এই অবস্থায় রাজ্যবাসী সাধারণের মতো
আমাদেরও বক্তব্য একটাই, ডাক্তার আন্দোলনে জয় পরাজয়ের হিসেব কষা নয়, রাজনীতি নয়। রাজ্যের হাসপাতাল সমস্যা সমাধানই লক্ষ্য হোক। মানুষ আধুনিক চিকিৎসার যাবতীয় সুযোগ পাক। তাই না?