কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
এই পরিস্থিতিতে কোন দিকে যাবে সরকার? বহু মানুষের হৃদয়ে সঠিক সময়ে রক্ত পরিবহণের দায়িত্ব নেওয়া পরিবহ-রা যদি নিজের খুলি সামলাতে ব্যস্ত থাকেন তাহলে এ দেশে প্রায় ভেঙে পড়া অতি অপ্রতুল সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবার দায়িত্ব নেবেন কে? অবশ্য এক দলের বড় নেতা ভুলেই যাচ্ছেন পরিবহ-র নাম, আর তাঁর দল থেকে পাল্টে যাওয়া নেতারা সেই নাম মুখস্থ করে বার বার আওড়াচ্ছেন। সঙ্গে খবরে ততটা প্রচার না পেলেও পাঁজরে ব্যাপক চোট লেগেছে যশ-এর। বর্ধমানেও আহত হয়েছেন এক নবীন চিকিৎসক। কেউ জেদ দেখিয়ে দেরি করেছেন যশ কিংবা পরিবহকে দেখতে যেতে, কেউ বা লোক দেখিয়ে ভিড় জমিয়েছেন মল্লিকবাজারের মোড়ে, মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের হাসপাতালে। কেউ বলেছেন ভালো আছেন পরিবহ, কেউ বলছেন তাঁর একটা চোখ আর হয়তো ভালোভাবে দেখতে পাবে না এই রাজ্যের একচোখা রাজনীতি। সত্যি মিথ্যে জানতে চাইলে কোন নিরপেক্ষ সংবাদ খুঁজে পাওয়া শক্ত। সবেতেই মিশে আছে মনের মাধুরী। জনমানসে দু’অক্ষরের ‘চোখ’ দু অক্ষরের ‘আলো’ দেখবে এই আশা কম, অপ্রয়োজনীয় স্বর-বিহীন-বর্ণ গুলোকে এবঙ্গের তিন ‘আঁধারে’ মুছে দিয়ে। আর আমরা বাকি সবাই চার অক্ষরের ‘নাগরিক’। পাঁচ অক্ষরের ‘চিকিৎসক’দের পদত্যাগের গল্প শুনেছি টেলিভিশনের সাদা পর্দায়, সংবাদমাধ্যমের কালো অক্ষরে।
মিছিলে পথ হাঁটতে হাঁটতে গৌরচন্দ্রিকা ভুলে বিনায়ক সেন আসল কথাটা বলে দিয়েছেন। অন্য আরও অনেক কিছু পরিষেবার মতই স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও ধনী ব্যবসায়ীদের দখলদারি অব্যাহত। সমাজের সঙ্গে যেভাবে রাজনীতি আসে, তার একটা বিশেষ অংশে আলোচিত হয় চিকিৎসা পরিষেবার সঙ্গে অর্থনীতি এবং রাজনীতির সম্পর্ক। এই পুরো বিষয়টাতে দুটো দিক আছে। এক হল নিম্নবিত্ত মানুষের জন্যে পরিষেবা। যার ব্যয়ভার বহন করার জন্যে গৌরী সরকার সেন ছাড়া আর কেউ নেই। এবার ধরা যাক সরকারি হাসপাতালের অবস্থা বিপর্যস্ত। সেটা সামলাতে না পেরে সরকার সাধারণ মানুষের জন্যে স্বাস্থ্য বিমার বন্দোবস্ত করে দিল। বেসরকারি হাসপাতাল অনেক বেশি পরিষ্কার, কিন্তু চিকিৎসার স্বচ্ছতা সেখানে শুধু লেখা থাকে ঝকঝকে দেওয়ালে। ভেতরে পুরোটা ঘোলা। এই বিমা সঙ্গে নিয়ে সুচিকিৎসার কথা শুনতে খুব ভালো। সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ ধনতন্ত্রের এ এক অসাধারণ উদাহরণ। হয়তো অনেক বেশি প্রচার পায় রাফাল যুদ্ধবিমান নিয়ে সরকার এবং আম্বানিদের যোগাযোগের আলোচনা। কিন্তু যে মুহূর্তে সাধারণ মানুষ সরকারি স্বাস্থ্য বিমা নিয়ে যাবেন বেসরকারি হাসপাতালে, তখন অবশ্যই তার থেকে মুনাফা লুটবেন স্বাস্থ্য ব্যবসায়ীরা। মুনাফা মানেই যে দুর্নীতি এমন নয়। সমাজ সৃষ্টির মূলে তো আর সরকার ছিল না, তখন বিনিময়ের মাধ্যম ছিল বিভিন্ন পরিষেবা কিংবা সম্পদ। তারপর মুদ্রা এল, এল সরকার, দু’হাত আকাশে তুলে মাটিতে পা রাখল সংসদীয় গণতন্ত্র। সরকার যে সাধারণ দুঃখী মানুষকে উন্নত পরিষেবা দেবে এরকম সাম্যবাদী তত্ত্ব খাতায় কলমে লেখা হল। অবশেষে সরকার জনস্বার্থে বেশ কিছু মানুষের স্বাস্থ্যবিমা বানিয়ে ফেলল। হাতে যদি থাকে নিজের ছবি সাঁটা স্মার্টকার্ড, তাহলে মানুষ প্রথম ছোটে বেসরকারি হাসপাতালে। আর জনগণের টাকা হাতবদল হয় সরকার থেকে বেসরকারি ক্ষেত্রে। প্রজাতান্ত্রিক ভারতেও এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজম বিদ্যমান। এতে দুর্নীতি কিংবা সম্পদশালীদের দোষ খুঁজতে যাওয়া বৃথা। কারণ যারা সচ্ছল, আইনের সুরক্ষা তাদেরই থাকে। আর স্বাস্থ্যবিমার আওতার বাইরে আরও বহুকোটি মানুষ চমকে যাওয়া পিত্ত কিংবা ফেঁপে ওঠা বৃক্ক নিয়ে ভ্যাপসা গরমে শুয়ে থাকেন সরকারি হাসপাতালের লোহা-বাঁধানো সিংহ দুয়ারের আশেপাশে।
সরকারি ব্যবস্থা যাতে ঠিকভাবে না চলে সেটা অবশ্যই নজর রাখেন সমাজের উচ্চবিত্ত এবং ক্ষমতাশালী মানুষ। সে শিক্ষাক্ষেত্রেই হোক, কিংবা স্বাস্থ্যে। বাসস্থানে হোক, কিংবা বিদ্যুতে। শুধুমাত্র নিম্নবিত্ত মানুষদের যদি সরকারি পরিষেবা নিতে বাধ্য করা যায়, তাহলে তার বাইরে থাকা বিশাল একটা অংশ বেসরকারি ক্ষেত্রে ছুটতে বাধ্য। তাইতো এত বেসরকারি স্কুল, কলেজ। সবাই জানেন সরকারি জায়গায় শিক্ষকেরা ভালো, চিকিৎসকেরাও ভালো। কিন্তু তা সত্ত্বেও সরকারি জায়গাগুলোকে যদি এমন খারাপভাবে সাজানো যায় যাতে আর্থিক কারণে বাধ্য না-হলে মানুষ সেখানে না যান, তাহলে একটা বড় অংশের মানুষ ছুটবেন তুলনায় বেসরকারি ক্ষেত্রে, শুধুমাত্র ঝকঝকে পরিষেবার স্বার্থে। এ দেশে একশো তিরিশ কোটির মধ্যে যে-কোনও সময়ে দশ বা কুড়ি কোটি মানুষ সচ্ছল। এই বিপুল বাজারকে ধরতে চায় বেসরকারি উদ্যোগ, আর তাতে বন্ধুত্বপূর্ণ সহায়তা দেয় কল্যাণকামী রাষ্ট্র, তার নেতা, নেত্রী, মন্ত্রীরা—দলমত নির্বিশেষে। কিন্তু অন্যদিকে এই সরকারি ক্ষেত্রগুলোই তৈরি করে অসংখ্য উচ্চমানের চিকিৎসক। আমাদের দেশে যত মেডিকেল কলেজ আছে তার বেশিরভাগই সরকারি আর সেখানে অনেক ভালোভাবে চিকিৎসাশাস্ত্র শেখেন পড়ুয়ারা। বেসরকারি কলেজে চিকিৎসক হতে খরচ কোটি টাকার বেশি, সেখানে সরকারি জায়গায় তা হয়তো লাখেও পৌঁছায় না। তাই আবার সরকারি কলেজে ভর্তি হওয়ার প্রতিযোগিতায় অসংখ্য বেসরকারি উদ্যোগ। কেন্দ্রীয় ‘নিট’ পরীক্ষায় সফল হওয়ার জন্যে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে কয়েক লক্ষ টাকা খরচ করেন পড়ুয়ার অভিভাবকেরা, এবং সেই অর্থ যায় বেসরকারি ক্ষেত্রে। চার অক্ষরের সরকারি ক্ষেত্রকে পাঁচ অক্ষরের বেসরকারির তুলনায় সঠিক গুণমানে পেশ করা সরকারের দায়িত্ব। কিন্তু সে সৎ উদ্দেশ্য একেবারে অনুপস্থিত।
সোমবার সন্ধ্যাবেলার মুখ্যমন্ত্রী-পড়ুয়া বৈঠক যদি আর ক’দিন আগে করা যেত তাহলে প্রায় এক সপ্তাহ এত কষ্ট ভোগ করতে হতো না সরকারি চিকিৎসার আশায় ঘুরে বেড়ানো বহিরাগত মানুষদের। সরকার একটু ভাবুন। লড়াইয়ের বর্ণমালায়, রাজনীতির অক্ষরে সব সমস্যার সমাধান হয় না। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আজ আবার এতগুলো ছাত্রছাত্রীর দিদি হতে পারলেন। তার কতটা রাজনীতি আর কতটা স্বতঃস্ফূর্ততা, কতটা ক্ষমতায় থাকার চেষ্টা আর কতটা মানুষের মঙ্গল করা, কতটা অবস্থা সামলানোর কৌশল আর কতটা মানুষের প্রতি মমত্ববোধ তা বোঝা যাবে আরও বেশ কিছিদিন পরে। তবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে টেলিভিশনের পর্দায় আলোচনার টেবিলে দেখে ভালো লাগল অনেক বেশি। কয়েকদিন আগে হাসপাতালে তিনি কেনই-বা গেলেন, আর কেনই-বা তরুণ চিকিৎসকদের স্লোগানে উত্তেজিত হলেন, কেনই-বা মাইকে ধমকালেন, সব উত্তরই অজানা। যাই হোক, সমস্যা মিটল আপাতত। দু-অক্ষরের ‘শান্তি’ এলে তবেই যুক্তাক্ষরে বাঁচবেন এই রাজ্যের মানুষ, মিলেমিশে।