পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
আফ্রিকায় রাষ্ট্রসঙ্ঘের স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের দায়িত্ব ছেড়ে ২০১১ সালে দেশে ফিরে এসেছিলেন। তারপর নির্বাচন কৌশলী হিসেবে কোচিং সেন্টার খুলে মিডিয়ায় প্রচার শুরু। রত্ন চিনতে ভুল করেননি মোদি। দ্রুত তাঁকে ডেকে পাঠান। তারপরেই তরুণ পেশাদারদের দল তৈরি করে গুজরাতে সুশাসনের প্রচার শুরু করেন। সেই দলের বেশিরভাগই আইআইটি-আইআইএমের স্নাতক। প্রশান্ত মোদিকে শেখান কীভাবে বিরোধীদের মোকাবিলা করতে হয়। কীভাবে হাসিমুখে না রেগে জবাব দিতে হয় অস্বস্তিকর প্রশ্নের। একেবারে ওয়ান টু ওয়ান কোচিং। মোদি ছিলেন খুবই সিরিয়াস অনুগত ছাত্র। ফলও পান হাতে হাতে। ২০১২-তে নরেন্দ্র মোদি যখন তৃতীয়বারের জন্য গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী হন, সেই সময়েই লাইমলাইটে আসেন প্রশান্ত। রাজনৈতিক মহলে শোনা যায়, সেই বছর গুজরাতের ক্ষমতায় মোদিকে নিয়ে আসার পিছনে কাণ্ডারী ছিলেন প্রশান্ত কিশোরই। এরপরে প্রশান্তের সেই দল নিয়েই জাতীয় স্তরে প্রচারের কাজ শুরু করে দেন নরেন্দ্র মোদি। ‘চায়ে পে চর্চা’র সাড়া জাগানো প্রচারের ডিজাইন করেছিলেন প্রশান্তের দলের সদস্যরাই। ২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে প্রশান্ত কিশোরকে সঙ্গে রাখেন মোদি, তবে তাঁর ছায়াসঙ্গীদের বলে দেন প্রশান্ত কিশোর কীভাবে কাজ করেন তার ফটোকপি করে রাখতে। প্রশান্ত যা যা বলেন, তা ছবিসহ অক্ষরে অক্ষরে টুকে রাখতে। বলে দেন, প্রশান্ত কিশোর না থাকলে যেন আমরা তাঁর অভাব অনুভব না করি। অমিত শাহ তাঁর দলবল নিয়ে সেই কাজটা করেন পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তার ফল হাতেনাতে পান মোদি। ঠিক এরপরেই মোদির হাত ছেড়ে দেন প্রশান্ত। বিজেপির এক সূত্রের খবর, প্রশান্ত নিজের আলাদা একটা দপ্তর খুলতে চেয়েছিলেন। এবং তা অনেকটা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের মতোই। কিন্তু তাঁর সেই পরিকল্পনাকে বাতিল করে দিয়েছিলেন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব।
বিজেপির সঙ্গে বিরোধের কথা জানার পরে ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে নীতীশ কুমার প্রশান্তের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ২০১৫ সালের মার্চে নীতীশের জন্য নির্বাচনী কৌশল তৈরির দায়িত্ব পান প্রশান্ত। জেডিইউয়ের সংবাদমাধ্যমের দায়িত্বে থাকা নেতারা ক্ষুব্ধ হন। কেউ কেউ দাবি করেন, নরেন্দ্র মোদির প্রচারের অন্ধ অনুকরণ করছেন প্রশান্ত! প্রথমে ‘পর্চা পে চর্চা’ বা ‘ঘর ঘর দস্তক’ প্রচার করে তৃণমূল স্তরের খবর তুলে আনেন। নীতীশ কুমারের জন্য এলাকাভিত্তিক প্রাধান্য দিয়ে বক্তৃতা তৈরি করে দিয়েছেন। যাতে প্রতিটি মানুষের মনে হয়, মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের কথাই ভাবছেন। নীতীশের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের জয়ের পথ তৈরিতে সেটা অনেকটাই সাহায্য করেছিল বলে মেনে নেন জেডিইউ নেতারাই। ২০১৫-র বিহার বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির জয়ের রথ থামিয়ে দিয়েছিল জেডিইউ, আরজেডি এবং কংগ্রেসের জোট। সূত্রের খবর, বিহারের মন্ত্রিসভা গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন প্রশান্ত। তাঁকে সেই মন্ত্রিসভাতেও রাখা হয়েছিল। কিন্তু কোনও দপ্তর দেওয়া হয়নি। এরপর থেকে নাকি দলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। জেডিইউ-এর এক সূত্রের দাবি, প্রশান্ত একসঙ্গে একাধিক দপ্তর সামলানোর পরিকল্পনা করছিলেন। কিন্তু দলের বেশ কয়েকজন শীর্ষ নেতৃত্বের বিরোধিতায় নাকি সেই পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
এরপরে পাঁচ রাজ্যের নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে নামেন প্রশান্ত কিশোর। উত্তরপ্রদেশ ও উত্তরাখণ্ডে সফল হননি। তিনি ডাক পান পাঞ্জাব থেকে। পাঞ্জাবের কংগ্রেসপ্রধান অমরেন্দ্র সিং তাঁকে বিহার থেকে নিয়ে যান নির্বাচনী উপদেষ্টা হিসেবে। কোচিং সেন্টার নিয়ে চলে যান প্রশান্ত। তাঁর রণনীতিতে বিপুল জয় পান ক্যাপ্টেন অমরেন্দ্র সিংহের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস। দেশজুড়ে মোদির দাপট এবং পাঞ্জাবে প্রবল প্রতিপক্ষ বিজেপি এবং আম আদমি পার্টিকে রুখে দিয়েছিলেন প্রশান্ত। ২০১৭ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ১১৭টি আসনের মধ্যে ৭৭টিতে জিতে নেয় কংগ্রেস। অনেক অনেক বছর পর পাঞ্জাবে কংগ্রেস ফের ক্ষমতার মুখ দেখে। এই সময় উত্তরপ্রদেশের নির্বাচনী রাজনৈতিক কৌশলেরও দায়িত্বে ছিলেন প্রশান্ত। কিন্তু উত্তরপ্রদেশের কংগ্রেস নেতারা তাঁর কথা শুনতে রাজি ছিলেন না। প্রিয়াঙ্কাকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে প্রজেক্ট করে প্রচার কৌশল তৈরি করতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত। তা শুনে রাজ্যের এক কংগ্রেস নেতা নাকি বলেছিলেন, ‘প্রশান্ত কিশোরকে দলের কৌশল নির্ধারণ এবং প্রচারের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। দলের সংগঠন এবং টিকিট বণ্টনের দায়িত্ব তাঁর নয়।’ কেউ কেউ এ কথাও বলেছিলেন যে, প্রশান্তের কাছ থেকে তাঁকে যদি রাজনীতি শিখতে হয়, তাহলে তিনি রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন। এককথায় মোদি এবং নীতীশের সঙ্গে কাজের সময় প্রশান্ত যে স্বাধীনতা পেয়েছিলেন, উত্তরপ্রদেশ কংগ্রেসে সেই সুযোগ পাননি। কংগ্রেসও উত্তরপ্রদেশে আর ফিরতে পারেনি। এটাই ছিল প্রশান্ত কিশোরের প্রথম ব্যর্থতা। এর পর বেশ কিছু সময়ের জন্য আড়ালে চলে যান প্রশান্ত। তবে বসে থাকেননি। এরপর ডাক পেয়েছেন দক্ষিণের রাজ্য অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুতে। একের পর এক মাস্টারস্ট্রোকে সেখানেও কাজে সফল হয়েছেন।
মনে রাখবেন, বিজেপির সঙ্গে মিলেমিশে নির্বাচন আবার বিজেপি ছেড়ে লালুকে নিয়ে বিধানসভা নির্বাচনে বিপুল জয়— সবই প্রশান্তের পরামর্শে আর কৌশলে। সময় নষ্ট করেননি নীতীশ কুমার। প্রশান্তকে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়ে দেন। নীতীশ কুমারের হাত ধরে বিহারের রাজনীতিতে যোগ দেন নির্বাচনী-কৌশলকার। পরে এক সাক্ষাৎকারে বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার স্বীকার করেছেন, প্রশান্ত কিশোরকে জেডিইউতে নিতে বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ তাঁকে দু’বার টেলিফোনে অনুরোধ করেছিলেন। ২০১৮-র অক্টোবরে দলের সহ সভাপতি হিসেবে কাজ শুরু করেন প্রশান্ত। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেন তিনি। আরএসএস প্রভাবিত ছাত্র সংগঠন এবিভিপিকে দীর্ঘদিন পরে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে হারিয়ে ছাত্র সংসদ সভাপতি পদে জেডিইউকে জেতান। এই প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ে জেতে জেডিইউ। লোকসভা নির্বাচনের বছরে দলের সঙ্গে যুবকদের জুড়তে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তিনি। আর নীতীশ কুমার বলছেন, ‘আমি বলছি শুনুন, প্রশান্তই ভবিষ্যৎ।’ বিহারের মাটি তাঁর হাতের তালুর মতো চেনা। এই বিহারেই ১৯৭৭ সালে জন্ম। পড়াশোনা বক্সার জেলায়।
প্রশ্ন উঠেছিল, সরাসরি রাজনীতিতে নেমে পড়ায় কি প্রশান্ত কিশোরের কোচিং সেন্টার বন্ধ হতে চলেছে? ভুল ভাঙিয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশ। সদ্য সমাপ্ত নির্বাচনে অন্য এক খেলা দেখিয়েছেন প্রশান্ত। সারা দেশ যখন মোদি মোদি করছে, তখন অন্ধ্রপ্রদেশে অন্য ভাও। জগনমোহনের উত্যুঙ্গ সাফল্যের অন্তরালে চাণক্যের ভূমিকায় সেই প্রশান্ত কিশোরই। এরজন্য হয়তো মনে মনে নীতীশ কুমারকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন জগন। কারণ, লোকসভা ভোটের হাওয়া উঠতেই জেডিইউতে প্রশান্তের সঙ্গে শুরু হয়েছিল টানাপোড়েন। নীতীশের দল জেডিইউ বিজেপি তথা এনডিএ জোটে শামিল হওয়া নিয়ে দু’জনের মধ্যে মতবিরোধ কার্যত চরমে উঠেছিল। জোটে শামিল করে বিজেপি যে ধীরে ধীরে জেডিইউকেই গ্রাস করতে চাইছে, এমন মতবাদ নীতীশকে বোঝাতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। কিন্তু নীতীশ এই মতের সঙ্গে সহমত ছিলেন না। তার জেরে শেষ পর্যন্ত প্রশান্ত কিশোরকেই সরে যেতে হয়। এই সুযোগটাই নিয়েছিলেন অন্ধ্রের জগনমোহন।
প্রশান্তের বুথভিত্তিক সংগঠন তৈরি আর জুতসই স্লোগান দিয়ে মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়ার কৌশল হাতে হাতে ফল দিয়েছে। তাঁর প্রশিক্ষণেই অন্ধ্রের ওয়াইএসআর কংগ্রেসের প্রধান জগনমোহন রেড্ডি রাজ্যের ১৭৫টি বিধানসভা আসনের ১৫২টি আসনেই জয় পেয়েছেন। ২৫টি লোকসভা আসনের সব ক’টি তাঁর দখলে। ওয়াইএসআর জগন রেড্ডির সাফল্য নজর কেড়েছে গোটা দেশের। জগন-ঢেউয়ে ভেসে গিয়েছেন জাতীয় রাজনীতিতে উদিত হতে চাওয়া চন্দ্রবাবু নাইডু। গোটা অন্ধ্রপ্রদেশে কার্যত ধুয়ে মুছে সাফ তেলুগু দেশম পার্টি। দেশে নতুন শক্তি হিসেবে উঠে এসেছে ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি। মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে অন্ধ্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ওয়াইএস রাজশেখর রেড্ডির ছেলে জগনমোহন রেড্ডি।
শুধু অন্ধ্রের এই জয়ই নয়, সংসদেও এখন তৃতীয় বৃহত্তম দল (বিজেপি এবং কংগ্রেসের পরেই) জগনমোহনের ওয়াইএসআরসিপি। এই বিপুল জয়ের পরই প্রশান্ত কিশোর ধন্যবাদ জানিয়ে ট্যুইট করেছেন, ‘এই জয়ের জন্য অন্ধ্র এবং ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল অ্যাকশন বা আই-পিএসির (প্রশান্ত কিশোরের সংস্থা) সহকর্মীদের ধন্যবাদ। নতুন মুখ্যমন্ত্রীকে অভিনন্দন ও আন্তরিক শুভেচ্ছা।’ শুনলে অবাক হবেন, অন্ধ্রপ্রদেশে এবার ১৫ মাসের পরিকল্পনা নিয়ে নেমেছিলেন প্রশান্ত-জগন। তাঁদের মূল কৌশল ছিল সরাসরি মানুষ বা ভোটারদের সঙ্গে কথা বলা। প্রচারের স্লোগান ছিল ‘রাভালি জগন, কাভালি জগন’ (আমরা জগনকে চাই, জগনকে জিততেই হবে)। চন্দ্রবাবুকে আর বিশ্বাস নয়, এই দাবিও ছিল প্রচারের সুরে তালে। তাঁর নির্বাচনী থিম সং সংক্রামিত হয় দাবানলের মতো। পেজ ভিউয়ার ছিল ২.২৫ কোটি। আসলে, প্রশান্ত কিশোরের ক্ষুরধার রাজনৈতিক মস্তিষ্ককে পুরোদমে কাজে লাগান জগন। আর তাতেই বাজিমাত।
রাজনীতির রণকুশলী হিসেবে বিজেপি, কংগ্রেস, জেডিইউ, এসপি-র মতো বেশ কয়েকটি দলের হয়ে কাজ করেছেন প্রশান্ত। ফলে কোন রাজনৈতিক দলের বা রাজনীতিকের শক্তি বা দুর্বলতা কোথায় সবই তাঁর নখদর্পণে! দেশের মূল দলগুলি এবং তাদের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কাজ করার সুবাদে তাঁদের শক্তি, খামতি— কোনও কিছুই তাঁর অজানা নয়। বিজেপির শক্তিশালী-আধুনিক ‘ব্যাক অফিস’-এর ভাবনা এই প্রশান্তেরই। এখনও যাঁরা প্রশান্ত কিশোরদের ক্ষুরধার রাজনৈতিক মস্তিষ্ককে পাত্তা দেবেন না, তাঁদের চন্দ্রবাবুর মতোই ভরাডুবি নিশ্চিত!