গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
প্রবীণ হয়েছি, অতীতের অনেকটাই দেখার সুযোগ হয়েছে। মস্তিষ্কের একটি কুঠুরীতে সে সব সঞ্চিত আছে। প্রশ্নও আছে অনেক। প্রথম প্রশ্ন— ভারতবর্ষের মতো ঐতিহ্যপূর্ণ, ইতিহাস সমৃদ্ধ এই বিশাল দেশটিকে কোন অবাঞ্চিত শক্তি টুকরো টুকরো করে দিয়ে গেল? আর সেটা মেনে নেওয়া হল কেন? আবার বলা হল, ভারতবর্ষ এই পৃথিবীর একটি বৃহৎ ‘গণতন্ত্র’। তন্ত্র শব্দটি তো বোঝা গেল, কিন্তু গণ বা জনগণেশের এই তন্ত্রে কতটা অধিকার বা সচেতন ভূমিকা স্বীকৃত?
আর এক বিখ্যাত কবি কোলরিজ জীবন-মৃত্যুর সঙ্গে দাবা খেলেছিলেন। সে যেন শকুনির পাশা খেলা। ১৯৪০ সালে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মৌলনা আবুল কালাম আজাদ একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘It was India’s historic destiny that many human races and cultures and religions should flow to her, finding a home in her hospitable soil, and that many a caravan should find rest here...’ তিনি এগারোশো বছরের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, আমাদের ভাষা, কবিতা, সাহিত্য-সংস্কৃতি, আমাদের ফ্যাশান, সাজপোশাক, আমাদের চালচলন এবং প্রথা—সবই কিন্তু বহন করছে ঐক্যের সুর। আমরা একসঙ্গে বেঁচে আছি এবং বেঁচে থাকার ধরন-ধারণ, আমাদের জাতীয়তা বোধ—সবকিছুকেই একটা ছাঁচে ঢালাই করে ফেলেছি। কোনও ভাবেই এই ঐক্যকে ভাঙা সম্ভব নয়। এ যেন সেই কবির কথা—‘শক-হুন-দল পাঠান-মোগল এক দেহে হল লীন।’
একই সময়ে (১৯৪০ সাল) মুসলিম লিগের প্রেসিডেন্ট জিন্নাহ বললেন, ‘it is a dream that the Hindus and Muslims can ever evolve a common nationality; and this misconception of one Indian nation has gone far beyond the limits and is the cause of more of our troubles and will lead India to destruction if we fail to revise our notions in time. The Hindus and Muslims belong to two different religious philosophies, social customs, and literature. They neither intermarry nor interdine together, and indeed they belong to two different civilisations which are based mainly on conflicting ideas and conceptions. Their aspects on life, and of life, are different.’
তাহলে দেখা যাচ্ছে প্রথম থেকেই দুই শিবিরের পরস্পর বিরোধী দুটি ধারণার সংঘাত। জিন্নাহ সাহেব তাঁর সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিভাজনে রাখার স্বপক্ষে যুক্তি খাড়া করছেন। হিন্দুর জীবন ও সংস্কৃতি এবং মুসলিমদের জীবন ও সংস্কৃতি সম্পূর্ণ আলাদা। দুটি জাতির দুই মেরুতে অবস্থান। ‘জাগে নব ভারতের জনতা/ এক জাতি এক প্রাণ একতা। এটি সঙ্গীতেই থাক। বাস্তব জীবনে এই একতা আসেনি, আসবেও না।
এই বিভাজনের অস্ত্রটি বিদেশি শাসকরা খুব সুচারুভাবে ব্যবহার করে প্রতিশোধ নিয়েছিলেন। তারই ফল চর্তুদিকে ফলছে। প্রয়োজনে, অপ্রয়োজনে সংঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করে দাঁড়াচ্ছে। ‘রোটি , কাপড়া অউর মকান’—এই যে চাহিদা যা ধর্ম, জাতি, ভাষা, বর্ণ—কোনও কিছুই মানে না। সবার ঊর্ধ্বে জনজীবনের বিকাশের যে ইস্যুটি বারেবারে হারিয়ে যায়, তা হারায় এই বিভাজনের ঘোলা জলে।
কারও মাথাতেই আসে না আসল সমস্যাটা কী? তৈরি করা সমস্যার মেঘের আড়ালে দাঁড়িয়ে কয়েকটি কথার বাণ ছুঁড়ে যাঁরা হিরো হতে চান তাঁদের বরাতে সব শেষে জোটে একটি সুন্দর ‘জিরো’। এই খেলাটিকে রপ্ত করার নামই কি রাজনীতি! কল্যাণ শব্দটির বিস্তার পরিধি কতটা। আদৌই কি আমরা কল্যাণ চাই? উত্তেজনা শূন্য শান্ত জীবন চাই, সুখী পরিবার চাই, সুন্দর নিরাপদ একটা দেশ চাই! সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, আমাদের ধর্মের কোনও সঠিক রূপ আমরা তৈরি করতে পেরেছি কি?
আজকের বাঁচাটা কালকের বেঁচে থাকাকে উদ্বুদ্ধ করবে কি? সাধারণ মানুষের অতি সাধারণ কিছু প্রশ্নের উত্তর কেউ কি দেবেন। কিছু দান, কিছু তোষণ, কিছু পিঠ চাপড়ানো, কিছু আলিঙ্গন ইত্যাদি যেসব দৃশ্য সংবাদ মাধ্যমে ভেসে ওঠে তার পেছনে কোনও জনদরদি স্থায়ী পরিকল্পনা আছে কি? গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলেই কি নেতা হওয়া যায়? চড় মেরে চুমু খেয়ে কে কবে কার মন জয় করতে পেরেছে! একটি গানের একটি লাইন চিরসমাদৃত হবে—কয়েকটি শব্দ—প্রেমিক লোকের স্বভাব স্বতন্ত্রর। গৌতম বুদ্ধ থেকে স্বামী বিবেকানন্দ, খ্রিস্ট হতে শ্রীচৈতন্য, কোরান থেকে বাইবেল, বেদান্ত থেকে বৈষ্ণব—একটি কথাই তো পতাকার মতো তুলে রেখেছেন—সবার ওপরে মানুষ সত্য। সেবাই তো ধর্ম।
সবশেষে একটি প্রশ্ন—তাহলে?