রাজনীতিক ও পেশাদারদের ব্যস্ততা বাড়বে। বয়স্করা শরীর স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিন। ধনযোগ আছে। ... বিশদ
ফলে উত্তর-দক্ষিণ পূর্ব-পশ্চিম—বাংলার নানা জায়গায় একের পর এক ঘটনা ঘটেই চলেছে। এমনকী, দুষ্কৃতী তাণ্ডবে ইতিমধ্যে রাজনৈতিক কর্মীর মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। পুলিসের একাংশের এই ভূমিকায় বৃহস্পতিবার ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিসমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং! ঘরছাড়া দলীয় কর্মীদের ঘরে ফেরাতে এবং দখল হওয়া পার্টি অফিস পুনরুদ্ধারে তৃণমূল নেতাকর্মীদের মনোবল বাড়াতে মমতা বৃহস্পতিবার নৈহাটিতে সভা করেন। সেখানে নানান অনভিপ্রেত ঘটনা ও সেইসব ঘটনা নিয়ন্ত্রণে পুলিসি ব্যর্থতার অভিযোগ এনে তিনি কার্যত বাহিনীর সংশ্লিষ্ট অংশকে হুঁশিয়ারি দেন। নিজের মন্ত্রকের কাজ নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মমতার ক্ষোভ জানানো দেখে মমতা-বিরোধীরা কেউ কেউ হয়তো মজা পেয়েছেন, তা নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় টীকা-টিপ্পনীও কেটেছেন। কাটুন।
কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রাপথে ওইভাবে স্লোগান দেওয়া বা ভিড়জটলা কি পুলিসি নিরাপত্তার একটা চরম গাফিলতি নয়—আপনারাই বলুন? কে জয় শ্রীরাম বলবে, কে জয় হিন্দ বন্দেমাতরম্ বলবে সেটা নিশ্চয়ই ব্যক্তিগত অভিরুচির ব্যাপার। কিন্তু, মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের চারপাশে অপরিচিত জনতার ভিড়, হুড়োহুড়ি কি স্বাভাবিক? সেখানে পুলিসের নিরাপত্তা বেষ্টনী থাকবে না, গোয়েন্দা পুলিসের কাছে আগাম খবর থাকবে না যে তাঁর যাওয়ার পথে এমন অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে!? এবং সেই আগাম খবরের ভিত্তিতে মুখ্যমন্ত্রীর যাত্রাপথের নিরাপত্তা আরও জোরদার করা হবে না!? বিশেষ করে ভোটের পর যখন পরিস্থিতি মোটেই স্বাভাবিক নয়, মারামারি ভাঙাভাঙি খুনোখুনি চলছে এবং মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় যে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে তার দু’পাশের এলাকাতেই চলছে—তখন তাঁর নিরাপত্তা নিয়ে এমন হালকা মনোভাব, এমন গা-ছাড়া আচরণ কেন! মানেটা কী? বৃহস্পতিবার ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী মমতা যখন গাড়ি থেকে রাস্তায় নেমে এসেছিলেন তাঁর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ছাড়া খুব বেশি কাউকে, মানে পুলিসের কর্তা-কর্মীদের কাউকে তো আশপাশে দেখা যায়নি! বরং, স্থানীয় লোকজনের অনেককেই মোবাইলে ছবি তুলতে তুলতে মুখ্যমন্ত্রীর যথেষ্ট কাছে চলে এসেছে, তাদের কেউ বাধা তো দিলেন না! শুধু তাই নয়, আশপাশে জড়ো হওয়া জনতাকে সরানোর ব্যাপারেও তো স্থানীয় পুলিস বাহিনীকে তেমন সক্রিয় হতে দেখা গেল না!
কেন গেল না, কেন দেখা যায়নি—তার পিছনে কোন রাজনীতির কী খেলা আছে সে প্রসঙ্গে যাচ্ছি না— কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী মমতার ওই ঢিলেঢালা নিরাপত্তার ফাঁক দিয়ে সেদিন বড় কোনও ঘটনা যদি ঘটে যেত— কী হতো! কে দায় নিতেন? শুধু মুখ্যমন্ত্রীর কথা বলছি না, যে কোনও মন্ত্রী বা ভিআইপি’র জন্যই তো এমন ঢিলেঢালা নিরাপত্তা বিপজ্জনক। ভোটের সময় দেখা গেল জেড ক্যাটাগরি নিরাপত্তা পাওয়া বাবুল সুপ্রিয়’র গাড়ি অবলীলায় ভেঙে চলে গেল কিছু দুষ্কৃতী! কী করে পারল? বিশেষ নিরাপত্তার সেই আঁটোসাটো বেষ্টনী সেখানেই বা কোথায় ছিল! ভগবানের অশেষ করুণা যে, দুষ্কৃতীরা গাড়ি ভেঙেই ক্ষান্ত দিয়েছে। বাবুলকে শারীরিকভাবে হেনস্তা করার পথে যায়নি। কিন্তু, যেতেই পারত। সেদিন নিরাপত্তাকর্মী কেন্দ্রীয় বাহিনীর যা হাবভাব দেখা গিয়েছিল তাতে দুষ্কৃতীরা অনায়াসে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে হেনস্তা করে যে যার ঘরে ফিরে যেতে পারত বলেই মনে করছেন তথ্যভিজ্ঞজনেদের অনেকেই। এবং তাঁদের এই আশঙ্কা যে একেবারেই অমূলক, টিভিতে সেই দৃশ্য দেখার পর এমনটা জোর দিয়ে বলা যাবে কি? কী ভয়ানক ভাবুন! আমাদের সৌভাগ্য সেই ভয়ানকের পুরো চেহারাটা শেষ অবধি আমাদের দেখতে হয়নি।
এ তো গেল একদিক। অন্যদিকে এই প্রশ্নটাও তো উঠছে যে—ভোটফল প্রকাশের পর রাজ্যে এত হিংসা কেন! কী হয়েছে যে হঠাৎ করে হিংসার এমন বাড়াবাড়ি? সন্দেহ নেই এবার ভোটের হাওয়া প্রথম থেকেই বেশ গরম ছিল। বিজেপি এ রাজ্যের ওপর বিশেষ নজর দেওয়ায় লোকসভা ভোটকে কেন্দ্র করে একটা জোরালো রাজনৈতিক লড়াইয়ের পরিস্থিতিও তৈরি হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর প্রধান সেনাপতি অমিত শাহ দফায় দফায় এ রাজ্যে এসেছেন, প্রচার করেছেন এবং রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে রাজনৈতিক তরজায় উত্তপ্ত বাগযুদ্ধে তাঁদের টক্করও চলেছে প্রায় সমানে সমানে। ভোটের ফলেও তার আভাস ভালোই মিলেছে। বিজেপি’র আসন একলাফে ২ থেকে ১৮-তে উঠে গেছে। হ্যাঁ, সেই ২০০৯ সালের পর এই প্রথম মমতার একচ্ছত্র আধিপত্যের বাংলায় তাঁর দল তৃণমূল আসন সংখ্যার বিচারে হয়তো একটু ধাক্কা খেয়েছে। তাতেই বা হয়েছেটা কী? খেলার মতো রাজনৈতিক লড়াইতে এমনটা তো হতেই পারে। তবে, আসন কমলেও মোট ভোটের শতাংশে তো মমতার তৃণমূল এগিয়েছে ৪ শতাংশ!
মানেটা কী দাঁড়ায়? কংগ্রেস, সিপিএমের শক্তিহীনতার পথ ধরে বিজেপি এ রাজ্যে শাসক তৃণমূলের প্রধান বিরোধী হিসেবে যেমন আত্মপ্রকাশ করেছে, আসন বাড়িয়েছে, ঠিক তেমনি কিছু আসন কমলেও তৃণমূল একলপ্তে ৪ শতাংশ ভোট বাড়িয়েছে। হ্যাঁ, লোকসভা ভোটযুদ্ধের এই ফলাফল থেকে এটুকু বলা যায় যে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর এই প্রথম রাজ্য রাজনীতিতে খানিকটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পড়েছে। সেটা তো ইতিবাচকই বলতে হবে। সিপিএমের মতো ভয়ঙ্কর শক্তির সঙ্গে জীবন পণ করে লাগাতার যুদ্ধের মধ্য দিয়েই তো মমতা ক্ষমতার শিখরে এসেছেন। তিনি নতুন প্রতিপক্ষের সঙ্গে আজ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিচলিত হবেন কেন? ভোটফলেই তো দেখা যাচ্ছে জনসমর্থনের নিরিখে আগামী লড়াইয়ের জন্য শক্তির বাড়তি রসদও তিনি জোগাড় করে নিয়েছেন। বরং, রাজ্যে কোনও বিরোধী নেই তাই মমতার এত বাড়বাড়ন্ত বলে যাঁরা (পড়ুন সিপিএম কংগ্রেস) এতদিন হাহুতাশ করছিলেন, ভোটফলের এই চেহারা তাদেরকে কিছু স্বস্তি শান্তি দেবে। তাহলে, মোটের ওপর সকলেরই এই ভোটফলে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা। কিন্তু, বাস্তব পরিস্থিতি তো তা বলছে না। চারদিকে গোলমাল হই-হাঙ্গামা মারপিট পার্টি অফিস দখল ইত্যাদি চলেই চলেছে! এবং অভিযোগের তির বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ছুটছে রাজ্যের নতুন বিরোধী শক্তি হিসেবে জেগে ওঠা বিজেপি’র দিকে! শাসক তৃণমূলের নামও যে তিরের ফলায় উঠে আসছে না এমন নয়—তবে পরিমাণে তা কিন্তু আশ্চর্যজনক হলেও সত্যি, বিজেপি’র চেয়ে অনেক কম! তাই নয় কি?
অস্বীকার করার উপায় নেই—বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সহিষ্ণুতা সংযম সৌজন্যের স্থান আজ রীতিমতো দুর্বল সংকুচিত। এই দুর্বলতার সূত্রপাত সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম আমলের শেষপর্বে কয়েকজন নেতার সৌজন্যে। পরবর্তীতে উগ্র মমতা বিরোধিতার পথে কয়েকজন নেতানেত্রী তো রাজনৈতিক পরিসরে সহিষ্ণুতার প্রায় গঙ্গাযাত্রা করিয়ে ছেড়েছেন। আজ তারই নিদারুণ ফলভোগ করছেন নৈহাটি-কাঁচরাপাড়া, বারাকপুর থেকে কোচবিহার, জলপাইগুড়ি, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া— এমনকী এই কলকাতা মহানগরীও! ভোটফল প্রকাশের পর যেসব হাঙ্গামা হচ্ছে তাতে কতটা রাজনৈতিক বিদ্বেষ বা দখলদারি মানসিকতা ক্রিয়াশীল আর কতটা ব্যক্তিগত রাগ মেটানোর সুযোগ ইন্ধন হিসেবে কাজ করছে তা নিয়ে গবেষণা চলতে পারে, কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার— মানুষ এই ভোট পরবর্তী সন্ত্রাস হিংসায় আতঙ্কিত বিরক্ত এবং একই সঙ্গে হতাশ। এই হতাশা আসন্ন ভোটগুলিতে বিশেষ প্রভাব ফেলতে পারে। অন্তত তেমনটাই মনে করছে রাজ্যের রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞ মহলের একাংশ। তাঁরা খুব ভুল মনে করছেন— এমন বলা যাচ্ছে কি? সুতরাং, সাধু সাবধান।