পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
কৃতিত্বের ক্রম অনুযায়ী অভিনন্দন প্রাপ্য মোদিজির, বিজেপি পার্টির, লক্ষ লক্ষ বিজেপি কর্মীর এবং তাদের জোটসঙ্গীদের। দ্বিতীয় বার দায়িত্বগ্রহণের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রীকে শুভেচ্ছা জানাই যে সরকার পরিচালনায় এবং দেশের সেবাকার্যে তিনি সফল হোন।
বুথ-ফেরত সমীক্ষা দু’দিন পরে ১৯ মে প্রকাশ করা হয়। অন্তত দু’টি সমীক্ষায় ধরা পড়েছিল যে বিজেপি ৩০০, সহযোগীদের নিয়ে তারা ৩৫০ এবং কংগ্রেস ৫০-এর মতো আসন পাবে। দুটি ভোট পরিসংখ্যানগত নমুনা সংগ্রহ এবং নির্বাচনী পূর্বাভাসের প্রতি কিছুটা আস্থা ফিরিয়ে আনল।
প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টি
আজ শুরু হচ্ছে নতুন যাত্রা। যাত্রা কখনও শেষ হবে না। পাঁচ বছর অন্তে একটা বিরাম আসে, এবং আরম্ভ হয় পুনর্যাত্রা। ভারতকে পরিচালনার অধিকারলাভের প্রশ্নে দলীয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের মধ্যে মতভেদ আছে এবং থাকবেও। এই মতপার্থক্যটাই হল বহুদলীয় গণতন্ত্রের একটি বৈশিষ্ট্য (হলমার্ক)। এটা বিশেষভাবে লক্ষণীয় বহু ও বিচিত্র মতের সমন্বয়ে প্রস্ফুটিত সমাজের প্রাণস্পন্দিত গণতন্ত্রে। একটি দল বৈচিত্রের সংস্কৃতি প্রত্যাখ্যান করেও জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হতে পারে, কিন্তু তার মানে এই নয় যে তাদের বৈচিত্রটা বাস্তব নয়।
ভারত সম্পর্কে বিজেপির একটা নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি আছে: এক জাতি, এক ইতিহাস, এক সংস্কৃতি, এক ঐতিহ্য, অভিন্ন দেওয়ানি বিধি, একটা জাতীয় ভাষা, এবং ‘একতা’র আরও অনেক দিক। কংগ্রেসের একটি পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি আছে: এক দেশ, ইতিহাসের নানাবিধ ভাষ্য, অনেক উপ-ইতিহাস, বহু সংস্কৃতি, বহু দেওয়ানি বিধি, অনেক ভাষা, এবং ঐক্যের সন্ধানী একজন মানুষের জন্য বৈচিত্রের আরও নানা দিক। আঞ্চলিক দলগুলিরও পৃথক পৃথক দৃষ্টিভঙ্গি আছে: প্রদেশ বিশেষে দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা হতে পারে, সেখানে তাদের রাজনৈতিক বিবৃতির ভিতর একটা সাধারণ যোগসূত্র রয়ে যায়: সেটা হল—প্রদেশের ইতিহাস, ভাষা এবং মানুষের সংস্কৃতির স্থান সবার উপরে এবং, বিশেষ করে, সেই প্রদেশের ভাষার পৃষ্ঠপোষণা করতে হবে এবং মুখ্য মানতে হবে তাকেই।
ভাষার মুখ্যতা
বিশেষ করে ভাষা একটি আবেগের নাম। সংস্কৃতি, সাহিত্য, শিল্পকলা, এবং মানুষের জীবনের অন্য প্রতিটি দিক আবর্তিত হয় ভাষাকে কেন্দ্র করে। এই কথাটি শুধু তামিল জনগোষ্ঠীর জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং যাঁরা তেলুগু, মালায়ালম, কন্নড়, ওড়িয়া, বাংলা প্রভৃতি ভাষায় যাঁরা কথা বলেন, আমি মনে করি, প্রতিটি প্রাচীন ভাষার ক্ষেত্রেই এটা সত্য। রাজনীতিতে ভাষার মুখ্যতা, বিশেষ করে রাজনৈতিক ভাবের আদান-প্রদানের ক্ষেত্রে এই সত্য অগ্রাহ্য করার উপায় নেই।
তামিলদের আমি ভালো জানি। তামিল সভ্যতা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হল তার ভাষা। তামিলভাষী মানুষের কাছে তামিলটাই হল তাঁর পরিচয়, ‘তামিঝান’। কর্ণাটকী সঙ্গীতের তিনজন মহান গীতিকার তামিলনাড়ুতে জন্মগ্রহণ করেন কিন্তু তাঁরা গান রচনা করেন সংস্কৃত ও তেলুগু ভাষায়। তামিল ইসাই (সঙ্গীত) আন্দোলন জন্ম নিয়েছিল তামিলের মুখ্যতা ও গর্বকে উঁচুতে তুলে ধরার জন্য। বেশিরভাগ ‘অর্চনা’ অনুষ্ঠিত হতো সংস্কৃতে, তবু অধিকাংশ মন্দিরের অর্চক এবং পূজারিদের ভাষা বেছে নেওয়ার অবকাশ রয়েছে; তামিলে অর্চনা বিকল্প হিসেবে পালনের সরকারি অনুমোদন আছে এবং এই নীতি প্রত্যেকে মেনেও নিয়েছে। হিন্দুত্ব বলতে আজ আমরা যেটা বুঝি সেটা ছিল শৈব ও বৈষ্ণব এবং হিন্দুত্ব এইভাবেই নিবন্ধিত হয়ে আছে তামিল ইতিহাসে ও ধর্মীয় সংস্কৃতিতে। বস্তুত, তামিল ধ্রুপদী সাহিত্য একই সঙ্গে ধর্মীয় ভাব প্রচারের মাধ্যম এবং সুন্দর সাহিত্যচর্চার দৃষ্টান্ত হিসেবে গৃহীত হয়েছিল। তামিল ভাষাকে সমৃদ্ধ করতে, পাশাপাশি, খ্রিস্টান এবং মুসলিম পণ্ডিত ও লেখকরাও বিরাট অবদান রেখেছেন।
তামিলদের এবং তামিল ভাষা সম্পর্কে আমি যা যা বললাম, সেগুলি সমানভাবে সত্য কেরল, কর্ণাটক, তেলেঙ্গানা, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং পশ্চিমবঙ্গের মানুষ ও তাঁদের ভাষাগুলি সম্পর্কে।
এবার ফিরে আসা যাক বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিদ্বন্দ্বী দৃষ্টিভঙ্গি প্রসঙ্গে। ২০১৯ নির্বাচনের ফলাফল থেকে এটা সাব্যস্ত হয় না যে অন্যসব দৃষ্টিভঙ্গিকে হটিয়ে দিয়ে একটিমাত্র দৃষ্টিভঙ্গিকে বেছে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বরং এটাই সত্য যে, ধর্ম কখনও ভাষা অথবা সংস্কৃতিকে অতিক্রম করতে পারবে না।
একবিংশ শতকে সেকুলার
সেকুলার স্টেট বা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের ধারণাটি ভারতের নয়। এটা আধুনিক গণতন্ত্র এবং গণরাজ্যের বৈশিষ্ট্যগুলির অন্যতম, ইউরোপের দেশগুলির আদর্শস্থানীয় দৃষ্টান্ত। কেউ বলতে পারবেন না যে ইউরোপীয় দেশগুলির মানুষ ধর্মবিশ্বাসী নন, কিন্তু রাজনীতি এবং সরকারি ব্যবস্থাপনায় তাঁরা সেকুলার থাকার ব্যাপারে অনড় অবস্থান নিয়েছেন। সেকুলার বলতে সত্যি বোঝায়, মূলত, ‘ধর্মীয় অথবা আধ্যাত্মিক বিষয়ে যুক্ত নয়’ এমনটা। সময়ের পরিবর্তনে, বিশেষ করে ইউরোপে, এটার মানে দাঁড়াল চার্চ বা গির্জার নিয়ন্ত্রণ থেকে রাষ্ট্রকে আলাদা করে আনা। আধুনিক যুগে, বিশেষ করে যে সমাজে বহুত্ববাদ এবং সংস্কৃতির বৈচিত্র স্বীকৃত সেখানে সেকুলার কথার অর্থ হল—চূড়ান্ত অবস্থান বর্জন এবং অন্তর্ভুক্তির অনুমোদন। আমার আলোচনার কেন্দ্রে ভারত—এবং ভারতের সরকার এবং প্রশাসন পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত সমস্ত প্রতিষ্ঠান—অবশ্যই সর্বদা অন্তর্ভুক্তির (ইনক্লুসিভ) নীতিতে অবিচল থাকবে।
সদ্য-সমাপ্ত নির্বাচনে বিজেপি কি অন্তর্ভুক্তির নীতির উপর দাঁড়িয়ে লড়াইটা করেছিল? আমার সংশয় আছে। প্রকাশিত সংবাদ অনুসারে, বিজেপির ৩০২ জন এমপি-র মধ্যে মুসলিম সম্প্রদায় থেকে একজনও থাকছেন না। অন্য যারা নিজেদেরকে এই ব্যবস্থায় বিযুক্ত (এক্সক্লুডেড) বলে ভাববেন তাঁদের মধ্যে আছেন দলিত, জনজাতি, খ্রিস্টান, ভূমিহীন কৃষক এবং কৃষি-শ্রমিকরা। কয়েকটি শ্রেণী উন্নয়ন প্রক্রিয়া থেকে বাস্তবিকই বিযুক্ত থাকবেন জাতি, দারিদ্র, অশিক্ষা, বার্ধক্য, সংখ্যার লঘুত্ব এবং প্রান্তিক হয়ে যাওয়ার কারণে। সুতরাং, আজ প্রয়োজন প্রধানমন্ত্রীর মূল স্লোগান ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ’-এর পুনরাবৃত্তি।
আমার আশঙ্কা হয়, কিছু মানুষকে আলাদা করে রাখার মানসিকতা (এক্সক্লুশনারি অ্যাজেন্ডা) নিয়েই এই ভোটে বিজেপি লড়েছিল। আমি আশা করব, এবার দেশ পরিচালনার নীতি হবে সবার কল্যাণ (ইনক্লুশনারি)।