কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
আসলে আমরা যারা নিজেদের দারুণ পণ্ডিত বলে মনে করি, তারা একটা ঘটনা বা একজন ব্যক্তির সামনেটা শুধু দেখি। তাকেই বাস্তব ভেবে সেটাকে কাটাছেঁড়া করে নিজের মনের মতো একটা চেহারা খাড়া করে ফেলি। না দেখা বা না বোঝা অনেক কিছুই আড়ালে থেকে যায়। মোদির ক্ষেত্রেও কিন্তু বারবার এমনটাই হয়েছে। আর তাই বিরোধী বা মিডিয়ার প্রচার যে সুরেই বাঁধা থাক না কেন, জনমত পাশে থেকেছে নরেন্দ্র মোদির। এই লোকসভা নির্বাচনেও। এবার প্রশ্ন হল, নানাবিধ মিসাইল মার্কা বিরোধী আক্রমণ সত্ত্বেও অধিকাংশ ভোটার নরেন্দ্র মোদির উপরই কেন আস্থা রাখলেন?
প্রথমে দেখা যাক, বিজেপি তথা নরেন্দ্র মোদি কেন এত ভোট পেলেন। এই লোকসভা নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এমন মেরুকরণের ভোট স্বাধীনতার পর ভারত আর দেখেনি। ধর্মীয় মেরুকরণ, সামাজিক মেরুকরণ, ব্যক্তি মেরুকরণ... এবং মোদি তথা বিজেপি তাতে অবিশ্বাস্যভাবে সফল। গত এক বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপি যে ভয়ানক কৌশলে প্রচার চালিয়ে গিয়েছে, তা সমাজের সব স্তরে প্রভাব ফেলেছে। সঙ্গে রয়েছে বেনিফিশিয়ারি ভোট। উত্তরপ্রদেশ বা বিহারের প্রত্যন্ত গ্রামের যে মহিলাকে এতদিন রাত থাকতে ঘুমচোখে মাঠেঘাটে ছুটতে হতো... তাঁকে আর প্রাণ এবং সম্মান হাতে নিয়ে বেরতে হয় না। ‘টয়লেট’-এর জন্য মোদি সরকার যে কী আশীর্বাদ কুড়িয়েছে, তা শহরের মানুষের ধারণার বাইরে। কাঠ পুড়িয়ে আগুনে দগ্ধ হয়ে যাঁরা এতদিন রান্না করে এসেছেন, তাঁদের ঘরে পৌঁছেছে উজালা প্রকল্পের রান্নার গ্যাস।
এছাড়া রয়েছে তিন তালাক ইস্যু। বলা হয়েছিল, উত্তরপ্রদেশে এবার বিজেপি ধুয়েমুছে সাফ হয়ে যাবে। মহাজোটের জয় হবে। প্রিয়াঙ্কা গান্ধী বিশাল ফ্যাক্টর হয়ে বিজেপির ভোট কেটে নেবেন। সোনিয়া গান্ধী নিজে শুধু রায়বেরিলি কেন্দ্রে টিমটিম করে জ্বলছেন। আর সমাজবাদী পার্টি ও বহুজন সমাজ পার্টি মিলেজুলেও ২০ ছুঁতে পারল না। মাঝখান থেকে এই মহাজোটের ভোট কেটে নিয়ে প্রিয়াঙ্কা আসনের ডালি তুলে দিলেন মোদির হাতে। সব হিসেব উল্টে দিয়ে একাই ৬০ পেরিয়ে গেল বিজেপি। এবং দেখার মতো বিষয় হল, যে রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশে গত বিধানসভা ভোটে বিজেপি লেজেগোবরে হয়েছিল, সেই তিন রাজ্যই এবার জয়টীকা পরিয়েছে নরেন্দ্র মোদিকে। অর্থাৎ, গোটা দেশ মোদির বিরোধিতায় যা যা প্রচার চালিয়েছিল, তার সবগুলোই ফ্লপ। মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছে মোদির। বিশেষ করে ৪৫ কোটি তরুণ প্রজন্ম।
১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি ভোটাররা এখনও মনে করে, নরেন্দ্র মোদির হাতেই দেশ নিরাপদ। পাকিস্তান একটা মারলে মোদি ওদের ঘরে ঢুকে পাল্টা মেরে আসবে। একটা জঙ্গি হানা পাকিস্তানি জঙ্গিরা করলে, মোদি সরকার সার্জিকাল স্ট্রাইক করবে। আবার বালাকোট হবে। এটা ঠিক, পাঁচ বছর আগে কিন্তু বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, প্রতি বছর ২ কোটি কর্মসংস্থানের। মোদি আরও বলেছিলেন, বিদেশ থেকে সব কালো টাকা এনে সাধারণ মানুষের প্রত্যেকের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে ভরে দেবেন। এর কোনওটাই পূরণ হয়নি। তা সত্ত্বেও তরুণ ভোটাররা ঢেলে সমর্থন দিয়েছেন মোদিকে। কারণ এই প্রজন্ম বিলক্ষণ জানে, বিরোধী যে দলগুলি মোদির বিরুদ্ধে লড়ছে, তারা কেউ দেশে একটা স্থিতিশীল সরকার দেওয়ার মতো জায়গায় নেই। তাই জনমত একজনের পক্ষেই যেতে পারে, নরেন্দ্র মোদি।
এবার বিরোধীরা কেন হালে পানি পেল না, তার সম্ভাব্য কারণ। সবার আগে রাহুল গান্ধী। রাফাল দুর্নীতি নিয়ে দিনের পর দিন নরেন্দ্র মোদিকে আক্রমণ করে গিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি। ভোটের এই পরীক্ষায় প্রথম দিকে সাধারণ মানুষের থেকে কিছুটা নম্বরও পেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু দিন যত গড়িয়েছে, ততই পিছনের সারিতে চলে গিয়েছেন রাহুল। মানুষ ভেবে নিয়েছে, রাহুল গান্ধী প্রধানমন্ত্রী মেটেরিয়াল নন। বরং মোদি বিরোধিতায় গোটা দেশে তখন দেখা গিয়েছিল একটাই মুখ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজ্যের ৪২টি আসন সম্বল করেও প্রধানমন্ত্রীকে চ্যালেঞ্জ ছোঁড়ার ক্ষমতা দেখিয়েছিলেন তিনি। চেয়েছিলেন আঞ্চলিক দলগুলিকে একজোট করে মোদিকে হটিয়ে দেবেন। তিনি বুঝেছিলেন, মোদিকে যদি হারাতে হয়, তাহলে হাতের পাঁচটা আঙুল আলাদা থাকলে কাজের কাজ কিছু হবে না। বরং প্রয়োজন মুষ্টিবদ্ধ হাতের। একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী—এই ছিল তাঁর ফর্মুলা। কিন্তু ভোটের আগে তাঁর সেই উদ্যোগে বাকি আঞ্চলিক দলগুলি কার্যত জলই ঢেলে দিল। প্রাক-নির্বাচন জোট হল না। প্রত্যেকটি আঞ্চলিক দল নিজের নিজের এজেন্ডায় ব্যস্ত।
ইভিএমের বোতামে প্রথম চাপ পড়ার আগেই মায়াবতীর মতো নেত্রীরা লাফাতে শুরু করলেন, প্রধানমন্ত্রী হতে তাঁর আপত্তি নেই। একজন ভোটার কখনও এই প্রবণতাকে ভালোভাবে নেয়নি, নিতে পারে না। পরিস্থিতি অনুকূল হলে এমন দাবিদার যে আরও তৈরি হবে, সে নিয়ে রাস্তার মোড়ে মোড়ে চর্চা হয়েছে। তার উপর কংগ্রেসের নামে বহু আঞ্চলিক দলের অ্যালার্জি। এও একটা বড় কারণ। কংগ্রেস বা কোনও বড় জাতীয় দলের সঙ্গ ছাড়া যে মহাজোট সম্ভব হতে পারে, তা দেশের ভোটাররা এখনও বিশ্বাস করে না। এই এতগুলো সমীকরণ ইউপিএ এবং প্রস্তাবিত মহাজোটের বিপক্ষে গিয়েছে। দিনের শেষে লাভ হয়েছে শুধুই মোদির। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল, পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির এমন উত্থান। প্রায় ৪০ শতাংশ ভোট দখল করে এই রাজ্যে প্রধান বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল গেরুয়া শিবির। সেই অর্থে কোনও মুখ না থাকা সত্ত্বেও। ২০১৪ সালের লোকসভা ভোটে মাত্র দু’টি আসনকে ১৮টিতে নিয়ে যাওয়া কম কথা নয়! এর নেপথ্য কারণ নিয়ে এখন প্রচুর কাটাছেঁড়া চলবে। বিশ্লেষণও হবে। কিন্তু দু’বছর পর বাংলার বিধানসভা নির্বাচন যে তৃণমূলের কাছে খুব সহজ হবে না, তা এখন দিনের আলোর মতো পরিষ্কার।
এবং সর্বোপরি বৃহস্পতিবার প্রমাণ হয়ে গেল, এই মুহূর্তে নরেন্দ্র মোদিই দেশের যোগ্যতম প্রধানমন্ত্রী। এক্সিট পোলের অনুমান অক্ষরে অক্ষরে মিলিয়ে তিনিই ফিরছেন... আবার। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে। অন্তরায় তো অনেক কিছুই ছিল... নোট বাতিল, জিএসটি, ধর্মের মেরুকরণ...। তা সত্ত্বেও মানুষের রায় গেল মোদিরই পক্ষে। ফল ঘোষণার দিন দুয়েক আগে এক দোকানদার বলছিলেন, ‘মোদি আবার এলে কিন্তু ভালো হবে না দাদা... র্যাঁদা দিয়ে যেভাবে কাঠের টুকরো অল্প অল্প করে চেঁছে তোলে, ঠিক সেই অবস্থা হবে দেশের।’ এটাও একটা মত। কিন্তু গোটা দেশের নয়। আর একটি ঘটনা... লাঠি হাতে হেঁটে যাওয়া ষাটোর্ধ্ব এক বৃদ্ধের প্রায় গা ঘেঁষে এগিয়ে গেল একটি রিকশ। বৃদ্ধ মানুষটি ভয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন।
তারপর লাঠি উঁচিয়ে বললেন, ‘২৩ তারিখ মোদি আসছে... তারপর তোদের দেখে নেব।’ এ তাহলে কোন মেরুকরণ? সামাজিক, ধর্মীয়, নাকি ব্যক্তি? হয়তো কোনওটাই নয়। নরেন্দ্র মোদি মানুষের মধ্যে একটা সাহস ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন। কোনও কিছুর ভয় বা স্বার্থের জন্য চুপ থাকার দিন শেষ। ছোবল না দিলেও ফোঁসটা করতেই হবে। আর একটা সমীকরণও আছে। যে পরিমাণ ভোট দেশজুড়ে বিজেপি এবারও পেয়েছে, তাতে আর বলা যাবে না ‘ওরা’ সাম্প্রদায়িক দল। প্রচুর মুসলিম ভোট এবার নির্ণায়ক শক্তি হয়ে মোদিকে দিল্লির কুর্সির দিকে আরও একবার ঠেলে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু প্রভাবিত বেশ কিছু আসনও তার বড় প্রমাণ।
মওত কা সওদাগর, দাঙ্গাবাজ, মুসলিম বিরোধী... প্রচার যাই হোক না কেন, ভারত কিন্তু দেখিয়ে দিল, এসবের কোনও ভিত্তি নেই। তাই আবার মোদি সরকার... ভারতীয় জনতা পার্টি নয়, মোদি জনতা পার্টি। এমজেপি... এভাবেই ফিরে আসতে হয়। ‘অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে?’