পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
উত্তরে ‘না’য়ের পাল্লাই বেশি ভারী। কেন? ছ’-আটমাস আগে যখন ভোটের উনুনে আঁচ দেওয়া শুরু হচ্ছিল, তখন বিষয়টা ওই ‘আচ্ছে দিন’ বা ‘রাফাল’ বিতর্কেই সীমাবদ্ধ ছিল। নরেন্দ্র মোদি-রাহুল গান্ধীর তীব্র বাদানুবাদ, সংসদে আলিঙ্গনপর্ব এবং চৌকিদার। অদ্ভুত ব্যাপার, সময় যত গড়িয়েছে, ভোট চাওয়া-পাওয়ার লড়াইয়ের বিশ্রীভাবে মেরুকরণ ঘটেছে। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে যেভাবে বিভাজনের রাজনীতি প্রবেশ করেছে, তা আগে কখনও এদেশে হয়েছে বলে মনে হয় না। অর্থনৈতিক বিভাজন এদেশের জন্মলগ্ন থেকেই রয়েছে। তাতে নতুন কিছু নেই। বরং ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে ওই একটা দিনই ভারতবাসী ইভিএমে সাম্যবাদ খুঁজে পায়। মুকেশ আম্বানির একটি ভোটের যা দাম, বেলপাহাড়ীর এক সাধারণ দিনমজুরের ভোটও একই মূল্যের। অর্থনীতি দিয়ে নতুন করে এদেশে বিভাজনের ঘুঁটি খেলা যাবে না। কাজেই সবচেয়ে কার্যকর এবং জবরদস্ত অস্ত্র প্রয়োগ... ধর্ম। প্রশ্ন উঠতেই পারে বাবরি সৌধ ধ্বংস এবং লালকৃষ্ণ আদবানির রথযাত্রা কি ভোটে ধর্মীয় মেরুকরণের পথ দেখায়নি? নিশ্চয়ই দেখিয়েছে, কিন্তু তার জন্য গোটা দেশ ভোটযন্ত্রের সামনে এসে ধর্মের নামে ভাগ হয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখায়নি। সেটা হয়েছিল ভারতের একটা অংশে। কিন্তু এই নির্বাচন দেখিয়ে দিচ্ছে, ভোটারের পদবি জানলে সেই ভোট কোথায় পড়বে, তা আন্দাজ করাটা শক্ত নয়। এ অবশ্যই ভয়ানক ব্যাপার। আমার ধর্ম দেখে যদি বিচার হয়ে যায় আমি কোন দলের সমর্থক, গণতন্ত্রে তার থেকে বেশি লজ্জার কিছু হয় না।
এরপর আসা যাক সামাজিক মেরুকরণে। উত্তর ভারতে যার প্রকোপ প্রত্যেক ভোটেই থাকে, যদিও এবার একটু বেশির দিকে। বিশেষত উত্তরপ্রদেশে। কোনও উচ্চবর্ণের ভোটারকে যদি জিজ্ঞেস করা হয়, কাকে ভোট দেবেন, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উত্তর আসছে ‘কেন! বিজেপিকে!’ আবার কোনও পিছড়ে বর্গ বা সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষকে একই প্রশ্ন করলে নির্দ্বিধায় সমর্থন করছেন অখিলেশ-মায়াবতীর জোটকে। পাশাপাশি সংখ্যালঘু ভোটারদের একটা বড় অংশ কংগ্রেসের নামও করছেন। এবার আসা যাক ‘কেন ভোট দেবেন’ প্রশ্নে। বিজেপির সমর্থক একাংশ বলছে, ‘বিজেপি সরকার আমাদের বিদ্যুৎ দিয়েছে, রাস্তা করেছে, ঘরে ঘরে শৌচাগার বানিয়েছে... এই সরকারকেই তো ভোট দেব!’ আবার উত্তরপ্রদেশেরই অন্য অংশে শুধু জাতপাতের ভিন্নতায় এই পরিষেবার অনেক কিছুই পৌঁছয়নি। সেখানকার ভোটাররা তখন অবশ্যই প্রশ্ন তুলবেন, ‘এই সরকারকে ভোট দিয়ে আমাদের কী লাভ হবে?’
তাহলে গ্রাউন্ড রিয়েলিটিটা কী? এর উত্তর পরিষ্কারভাবে মেলা মুশকিল। এখনও... কাল শেষ দফার ভোটের দিনেও। ‘বিকাশ’ হয়েছে। কিন্তু সবার হয়নি। ‘আচ্ছে দিন’ আসা নিয়ে তো ধনী ব্যবসায়ী ছাড়া আর কেউ খুব একটা নিশ্চিত নন (তাঁরাও আবার মুখে বলছেন না)। অসমে নাগরিকপঞ্জি হল। তাতে বহু নাগরিক হঠাৎ ‘বিদেশি’ হয়ে গেলেন। তাঁদের সর্বনাশ। আবার সেই রাজ্যেরই কিছু মানুষের পৌষ মাস! ওই একই রাজ্যের ভিন্ন প্রান্তে আবার এনআরসি নিয়ে হেলদোল নেই। সেখানে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল। একটা কিছু তো থাকবে, যা হতে পারে ভোটের ইউনিভার্সাল ইস্যু! রাজনৈতিক দল যদি তার ভোটব্যাঙ্কের কথা ভেবে উন্নয়নের বরাত দেয়, প্রয়োজন অনুযায়ী জাত-ধর্ম দেখে ভোটার কার্ড বানায়... তাহলে বিভাজন আটকানো কি সম্ভব?
আর হল ব্যক্তি মেরুকরণ। মোদি ঝড় গত লোকসভা ভোটেও ছিল। কিন্তু বিজেপির মতো একটা পার্টি এভাবে মোদিত্ব নির্ভর হয়ে যায়নি। গেরুয়া শিবিরের প্রচারের অভিমুখই এবার একটা, মোদি সরকার (বিজেপি সরকার নয়)! অর্থাৎ একটা রাজনৈতিক দলকে দেখে ভোট দেওয়ার পাঠ চুকল। আঞ্চলিক দলের ক্ষেত্রে এই প্রবণতাটা নতুন নয়। বরং চিরকালের। জয়ললিতা, করুণানিধির প্রয়াণের পরও যে ধারা বজায় রেখে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, মায়াবতীরা। এবং এবারের মোদি-বিরোধী মহাজোটের ক্ষেত্রেও কিন্তু বিষয়টা ধীরে ধীরে সেই ব্যক্তিকেন্দ্রিকই হয়ে পড়ছে। কারণ, বিজেপিকে আক্রমণের ব্যাটনটা পুরোপুরি তুলে নিয়েছেন মমতা। রাহুল গান্ধী, অখিলেশ যাদব, মায়াবতী, তেজস্বী বা স্ট্যালিন... আগে কোনও লোকসভা ভোটে বিরোধী রাজনীতি কিন্তু এভাবে মমতাময়ী হয়ে ওঠেনি। আর তার প্রমাণ রাখছেন মোদি স্বয়ং। বারবার বাংলায় আসছেন, এবং তাঁর টার্গেট শুধুই তৃণমূল নেত্রী। আসলে বিজেপি বুঝে গিয়েছে, উত্তরপ্রদেশ থেকে খুব বেশি কিছু এবার পাওয়ার নেই। যতটুকু ঝুলিতে আসবে তাতেই আনন্দ করতে হবে। আর তা যদি ৩০-৩৫টা আসন হয়, তার জন্য অনেকটা ধন্যবাদ প্রাপ্য থাকবে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর। সোনিয়া কন্যা বহু প্রতীক্ষর পর রাজনীতিতে। এবং তাঁর আগমনেই কংগ্রেসের কর্মী-সমর্থক মহল মোটামুটি চাঙ্গা। উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের নিজস্ব যে ভোটব্যাঙ্ক আছে, একপ্রকার নিশ্চিত হয়ে বলা যায়, প্রিয়াঙ্কা তাতে ফাটল ধরতে দেবেন না। অর্থাৎ, অখিলেশ-মায়াবতী সব নিন্দুকের মুখে ছাই দিয়ে জোট করলেও এই একটা জায়গাতেই ফাঁক থেকে যাবে। বিজেপি ধর্ম এবং হিন্দুত্বের নামে ভোট চেয়ে উত্তরপ্রদেশের ভোটারদের একটা অংশ ধরে রেখে দেবে। বাকি অংশ একত্র হলে (অর্থাৎ কংগ্রেস+সমাজবাদী পার্টি+বহুজন সমাজ পার্টি), তাহলে নিশ্চিতভাবে মোদির বিজেপিকে ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু তা সম্ভব হচ্ছে না। ভোটকাটুয়া হয়ে প্রিয়াঙ্কা মোদিরই সুবিধা করে দেবেন। এভাবে যতটুকু সম্ভব উত্তরপ্রদেশ থেকে আদায় করে বাকি রসদের জন্য পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব ভারতের দিকে তাকিয়েছেন মোদি। এখানে তাঁর সবচেয়ে বড় অন্তরায়ের নাম মমতা। মোদির সাফল্য, মহাজোটের প্রচারে মমতাকে বাংলার বাইরে যাওয়া থেকে আটকে দিতে পেরেছেন তিনি। আর তৃণমূল নেত্রীর সাফল্য, বিরোধী রাজনীতির অভিমুখটাকেই তিনি ঘুরিয়ে দিতে পেরেছেন নিজের দিকে। ২৩ তারিখ যদি কেন্দ্রে সরকার গড়ার ক্ষেত্রে বিরোধী মহাজোটের পথ প্রশস্ত হয়, মমতাই কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে অনেকটা এগিয়ে থাকবেন। রাহুল গান্ধী কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার এতদিন পরও সেই গ্রহণযোগ্যতায় জায়গায় পৌঁছতে পারেননি। ভোটাররা কতটা তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য নম্বর দেবে, তা নিয়ে তর্ক হতে পারে, বিরোধী তথা আঞ্চলিক দলগুলি যে মোটেই একবাক্যে রাহুলকে মেনে নেবে না, সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই। তবে হ্যাঁ, প্রথম ইউপিএ সরকারের জমানায় সোনিয়া গান্ধী যেভাবে গোটা দুনিয়াকে হতচকিত করে সবচেয়ে লোভনীয় পদটি ছেড়ে দিয়েছিলেন, ঠিক একইভাবে যদি এবার তিনি বিরোধী মহাজোটের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন, তাহলে পুরো সমীকরণটাই বদলে যেতে পারে। তাঁর প্রচণ্ড অসুস্থতা সত্ত্বেও। ইতিমধ্যেই ভোটের ফলের দিন মহাজোটের বৈঠক আয়োজনের সব দায়িত্ব তিনি কাঁধে তুলে নিয়েছেন। আর সোনিয়া প্রধানমন্ত্রিত্বের দৌড়ে চলে এলে সেটা সত্যিই হবে আর একটা মাস্টারস্ট্রোক। সেই বহুদলীয় সরকার তখন টেকসইও হবে।
সে অবশ্য পরের ব্যাপার। আপাতত প্রতিশ্রুতির প্রচার থেকে মুখ ফিরিয়েছে সব শিবিরই। গত কয়েক দফার ভোটের প্রচার শুধুই আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণে সীমাবদ্ধ। তাই মোদির প্রচারে না আছে কর্মসংস্থানের কথা, না প্রত্যেকের অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা করে দেওয়ার বার্তা। কৃষকদের দানছত্র দেওয়ার প্রচার অনেক দলের মুখেই শোনা যাচ্ছে। তাতেও কি চাষিদের আত্মহত্যা ঠেকানো গিয়েছে? গত বছর ৬ মার্চ থেকে ১২ মার্চ নাসিক থেকে মুম্বই স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কৃষক লং মার্চে। প্রায় ৫০ হাজার মানুষের পদযাত্রা। দাবি, নিঃশর্ত কৃষিঋণ মকুব। বাণিজ্যনগরীর রাজপথ রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছিল বাম পতাকায়। ফল? ছয় সদস্যের কমিটি গঠিত। তারা ঠিক করবে, বিষয়টি নিয়ে কী করা যায়। সরকারি ভাষায়, প্রক্রিয়া শুরু হয়ে গিয়েছে। ঋণ মকুব এবার সময়ের অপেক্ষা...। সত্যি কি তাই? ভোটের গুঁতো যে ভয়ানক! মহারাষ্ট্র সরকার তথা বিজেপি তখনই প্রমাদ গুনেছিল, সামনের বছর ভোট। কিছু তো একটা করতে হবে! কমিটি হল। পর্যালোচনা হল। ভোটও চলে এল। কিন্তু যে লোকসভা কেন্দ্র থেকে এই কৃষক লং মার্চের জন্ম, সেই দিন্দোরি আসনের ছবি তো এক বছরেও বদলায়নি! এখানে গ্রামে গ্রামে... ঘরে ঘরে এখনও পরিবারের লোকজন রাত জাগে বাবা বা স্বামীর পাহারায়। আত্মহত্যার আশঙ্কায়। কোথায় গেল বছরে দু’কোটি চাকরির প্রতিশ্রুতি? সবই ফিকে... আর তাই অস্ত্র তো করতেই হবে মেরুকরণকে। সেটাই করছে কমবেশি সব দল। পকে কী উন্নয়ন করেছে, তা আজ আর বিবেচ্য নয়। বরং কার কী দুর্নীতি, সেটাই প্রচারের দাবার ছক। যেখানে ধর্ম যদি রাজা হয়, মন্ত্রী তাহলে পিছড়ে বর্গ। ঘুঁটি সাজানো চলছে। নিরন্তর...। ভোটটা যদি সত্যিই দেশের নামে হতো!