উপস্থিত বুদ্ধি ও সময়োচিত সিদ্ধান্তে শত্রুদমন ও কর্মে সাফল্য। ব্যবসায় গোলযোগ। প্রিয়জনের শরীর-স্বাস্থ্যে অবনতি। উচ্চশিক্ষায় ... বিশদ
সরকারি পরীক্ষাতেও মাঝে মাঝে বিভিন্ন জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে, কিন্তু মোটের ওপর আমাদের দেশে উচ্চপদের সরকারি চাকরি অনৈতিকভাবে পাওয়া শক্ত। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রচুর প্রস্তুতি নিতে হয় এই ধরনের পরীক্ষায় সফলতা পেতে। আর শেষ পর্যন্ত অসাধারণ পরিশ্রম করে যাঁরা সফল হন, তাঁদের মধ্যে একটা বড় অংশকে কাজ করতে হয়ে এমন নেতাদের অধীনে যাঁদের জীবনে সফলতা অন্য পথে এসেছে। রাজনীতিবিদদের একটা বড় অংশের মধ্যে কৈশোর বা যৌবনে পড়াশোনা, খেলাধুলো, বা অন্য কোনও প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে সফলতার হার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারিদের থেকে অনেক অনেক কম। অন্তর্জালে রাজনীতিবিদ অনেকের বিদ্যালয় এবং স্নাতকস্তরের মার্কশিট থাকে না। কজন রাজনীতিবিদ তাঁর পড়াশোনার ফলগুলোকে জানাতে পারেন সবাইকে? পারেন না, তার কারণ সকলের পড়াশোনার ফলাফল সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, মনোহর পারিক্কার কিংবা অরবিন্দ কেজরিওয়ালের মত নয়। পড়াশোনার কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া গেল। কতজন রাজনীতিবিদ আছেন যাঁরা ইস্কুলে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় সফল হয়েছেন, কিংবা একটা আবৃত্তি করে বা ছবি এঁকে টিফিনবক্স বা জলের বোতল পেয়েছেন? সে সংখ্যাটাও সম্ভবত খুব কম।
বিষয়টাকে আর একটু নির্দিষ্টভাবে আলোচনা করা যাক। জীবনের প্রথম সরকারি পরীক্ষা সাধারণভাবে মাধ্যমিক স্তরে। এবার তুলনা করা যাক মাধ্যমিকে সাংসদদের গড় নম্বর আর আইএএস-আইপিএসদের। আমাদের রাজ্যের ক্ষেত্রে এই তুলনা হতে পারে বিধায়ক আর ডব্লুবিসিএস অফিসারদের মধ্যে। ফলাফল সকলেরই জানা। এটা কিন্তু অবশ্যই গড়ের প্রশ্ন। পড়াশোনা বা খেলাধুলো ভালো না করেও এমন এক-দুজন রাজনীতিবিদ থাকতেই পারেন যাঁর অবদান দেশের ক্ষেত্রে অনস্বীকার্য। তবে সেটা ভীষণ অল্প কিছু ক্ষেত্রের উদাহরণ। গড়ের বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ, তার কারণ এক-দুজন মনীষীকে নিয়ে রচনা লেখা যায়, কিন্তু দেশ চলে বিপুল সংখ্যক দক্ষ মানুষের দৈনন্দিন কাজের নিরিখে। তাই তো বারবার গড়ের কথাটা আসে। সূচক যাই ধরা হোক না কেন, সেই গড় আমাদের দেশের রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে খুব উচ্চস্তরের গুণগত মান প্রকাশ করতে পারে না। এর ওপর আছে শিক্ষাগত যোগ্যতায় সততার প্রশ্ন। শুধু আজকে নয়, স্বাধীনতার পর থেকেই রাজনীতিবিদদের একটা অংশ নিজেদের শিক্ষাগত যোগ্যতা সম্পর্কে যা দাবি করেছেন, পরে তা সত্য হিসেবে প্রমাণ করতে অসমর্থ হয়েছেন তাঁরা। অর্থাৎ তাঁরা বোঝেন যে ডিগ্রির দাম আছে, তাইতো নিজেদের মানোন্নয়নে একঝুড়ি মিথ্যে নম্বর বইতে হয় সেই বিশেষ বিশেষ নেতানেত্রীকে। তবে এতক্ষণ যা বলা হল সেকথা নতুন কিছু নয়, আমাদের দেশে এমনটাই চলছে সাতচল্লিশের পর থেকে।
কিন্তু বিপদ এখন অনেক বেশি। ধরা যাক আপনি ভারতের সবথেকে ভালো সরকারি প্রযুক্তিবিদ্যার কেন্দ্র আইআইটি থেকে প্রচুর নম্বর পেয়ে পাশ করেছেন। তারপর কোনও কারণে গবেষণার কাজে না গিয়ে দেশসেবা করতে আইএএস বা আইপিএস হয়েছেন। দেশ বা রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ কোনও পদে আছেন। ভালোবাসেন অঙ্ক করতে। হয়তো ইংরেজি বা ইতিহাস জানেন দারুণ। প্রযুক্তির অত্যন্ত উন্নত তত্ত্ব সম্পর্কে আপনার সম্যক জ্ঞান। দেশটা কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় সেকথা আপনার থেকে ভালো জানে খুব কম লোক। আপনাদের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ পেয়ে ঋদ্ধ হন সাধারণ মানুষ। আপনাদের জ্ঞানের পরিধি এতটাই প্রসারিত যে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গিয়ে অসাধারণ ভালো পড়াতে পারেন আপনারা। কিন্তু সেই আপনাদের জড়িয়ে পড়তে হয়েছে দুই নেতানেত্রী বা একাধিক রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্বের মধ্যে। রাজনীতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকা যে দুর্নীতি, তা সামাল দিতে বারবার বিপদে পড়ছেন আপনারা।
এ অবস্থা কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে অনেক কম ছিল আগের সহস্রাব্দেও। নিশ্চিন্তে কোথায় অফিসের কাজ শেষে নিজের ছেলেমেয়েদের একটু পড়াশোনা করাবেন, তার বদলে ভোটের সময় প্রতিদিন এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় সরিয়ে দেওয়া হচ্ছে আপনাদের। দেশের জন্যে লড়তে গিয়ে প্রাণ দিয়েছেন আপনারা। আর আপনার উৎসর্গীকৃত সেই জীবন নাকি সীমানা পেরিয়েছে ভোটপ্রার্থী নেতানেত্রীর অভিশাপে! শুধু প্রশাসনেই বা কেন? বিচার ব্যবস্থায় অত্যন্ত সৎ ভাবে কাজ করা মানুষদের অবস্থাও অনেকসময় সুবিধের নয়। কখনও বা উচ্চতর এবং উচ্চতম ন্যায়ালয়ের সম্মানীয় বিচারপতিদের কারও কারও বিরুদ্ধে উদ্ভট অপবাদ বা অভিযোগ আসছে বারবার। সাম্প্রতিক একটি ঘটনায় অনেকেই মনে করছেন যে এসমস্ত ষড়যন্ত্রের পেছনে আছে রাজনৈতিক নেতারা।
তবু মুখ বুজে সবটুকু সহ্য করে নিয়ে সরকারি কর্মচারীরা চালিয়ে যাবেন প্রশাসন বা বিচার ব্যবস্থার কাজ। জেতার আশায় ভোটপ্রচারে নেতানেত্রী কথায় কথায় হেয় করবেন তাঁদের থেকে অনেক অনেকগুণ যোগ্য মানুষদের। জেলাপুলিসের ঊর্দ্ধতন কর্মচারিদের অপমানজনক কথা বারবার শোনানো হবে অমায়িক ভঙ্গীতে। এবং তারপর সেই নেতাদের মধ্যেই একজন ভোটে জিতবেন। তাঁরাই আবার সবাই মিলে দুশো বাহাত্তর পেরিয়ে সরকার গড়বেন। তাঁদের শপথ নেওয়াতে আসতে হবে দেশের উচ্চতম ন্যায়ালয়ের প্রধান বিচারপতিকে। তাঁদের নির্ধারিত নীতিকে প্রয়োগ করতে হবে দেশের শিক্ষিত সরকারি কর্মচারিদের। সেটুকু তো ঠিকই ছিল। কিন্তু তাঁদের কারও দুর্নীতি, তাঁদের হিংসা, তাঁদের অনেকের ক্ষমতার প্রতি তীব্র লোভ, এসবের দায়ভার যদি সরকারি কর্মীদের নিতে হয় তাহলে কিন্তু ভীষণ বিপদ। একটু ঘাড় বেঁকিয়ে তাকালেই দেখতে পাবেন এমন ঘটনা বাড়ছে আমাদের দেশে। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মীদের ভয় দেখিয়ে কাজ করানো এবং তাঁদের ফাঁসিয়ে দেওয়ার ঘটনা উঠে আসছে বারবার। স্বাধীন সংস্থাগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। বিচার ব্যবস্থা থেকে মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা, নির্বাচন কমিশন থেকে প্রশাসন, সব কিছুকেই আপন করে নেওয়ার যে রাজনৈতিক প্রচেষ্টা কেন্দ্র, বিভিন্ন রাজ্য এবং সর্বোপরি কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের নীতি নির্ধারকদের মধ্যে ঢুকে পড়েছে, তার থেকে সরকারি কর্মীদের আশু মুক্তির প্রয়োজন। একদিকে তাঁদের কাজ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে, অন্যদিকে সেই সব দলের সঙ্গে সঠিক দূরত্ব না রাখলে পরবর্তীকালে বিপদ বাড়তে পারে অনেকটা। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মীদের চাকরির সুরক্ষা তাই কাদাগোলা বিশবাঁও জলের তলায়।