বিদ্যার্থীদের ক্ষেত্রে ভাবনা-চিন্তা করে বিষয় নির্বাচন করলে ভালো হবে। প্রেম-প্রণয়ে বাধাবিঘ্ন থাকবে। কারও সঙ্গে মতবিরোধ ... বিশদ
তবুও ইতিহাসের পাতা উল্টে বলতেই হয়, ১৯৮৪ লোকসভা ভোটের ২ থেকে বিজেপি–কে ১৯৮৯ সালে ৮০–এ তুলে এনেছিলেন প্রধানত তিনিই। যাঁরা এখন বিজেপির বড় নেতা, বড় মন্ত্রী, সকলেই তাঁর প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ। অটলবিহারী বাজপেয়ি বলতেন, অনুজপ্রতিম লালকৃষ্ণ ‘সংগঠনের প্রাণকেন্দ্র’। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে ক্ষমতায় আসার পিছনেও সেই আদবানির বিশাল অবদান। তাঁর অভিজ্ঞতা যেকোনও নির্বাচনে বিজেপির জন্য অমূল্য সম্পদ হতে পারে। আজও। বিজেপি ক্ষমতায় এলে কে হবেন প্রধানমন্ত্রী? লালকৃষ্ণ আদবানি বলেছিলেন, ‘কোনও প্রশ্নের অবকাশ নেই। আমাদের সিনিয়র নেতা বাজপেয়িজি। সংসদীয় রাজনীতিতে তুলনাহীন। মানুষের কাছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। তিনিই হবেন প্রধানমন্ত্রী।’ আদবানির বদলে ‘মডারেট’ বাজপেয়ি প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন অনেকেই। তখন বাজপেয়িই সর্বংসহা। আদবানি উগ্র হিন্দু নেতা। লৌহপুরুষ। আজ সেই আদবানিই নরমপন্থী। এনডিএ জমানায় বিভিন্ন ইস্যুতে তাঁদের মধ্যে মতপার্থক্য হলেও দু’জনের সম্পর্ক এতই নিবিড় ছিল যে, সরকার ও দলের মধ্যে একাধিক শক্তিকেন্দ্র গড়ে ওঠেনি।
২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেই সেই বাজপেয়ি, যোশিদের সঙ্গে আদবানিকেও ‘মার্গ দর্শক মণ্ডলী’–তে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন নরেন্দ্র মোদি। ক্ষমতা ও দায়িত্ব থেকে বহু যোজন দূরে। গত পাঁচ বছর সেই উপদেষ্টা মণ্ডলীর একটিও বৈঠক হয়নি। লালকৃষ্ণ আদবানির নীরবতা এতটাই গভীর ছিল যে, তাঁর দলের নিরঙ্কুশ আধিপত্যের গত পাঁচ বছরে সংসদের ভিতরে ‘সরকারি ভাবে’ তিনি মুখ ফুটে বলেছেন মাত্র ৩৬৫টি শব্দ। অথচ, সংসদের অধিবেশনের দিনগুলিতে ৯২ শতাংশ হাজিরার মালিক নবতিপর প্রাক্তন উপপ্রধানমন্ত্রী। সংসদ ভবনের কোনও অনুষ্ঠানে যদি একজন সাংসদও উপস্থিত থাকেন, তাঁর নাম এল কে আদবানি। কষ্ট পেয়েছেন, কিন্তু প্রকাশ্যে কিছু বলেননি। সাংগঠনিক শৃঙ্খলা যে তাঁর কাছে সবচেয়ে বড়।
গান্ধীনগরে গত আঠাশ বছর সংসদ সদস্য ছিলেন আদবানি। এবার তাঁকে সরিয়ে প্রার্থী করা হয়েছে অমিত শাহকে। কারণ বয়স? হ্যাঁ, ৯১। কিন্তু এখনও সচল। তিনি সংসদ সদস্য ছিলেন উনপঞ্চাশ বছর। কখনও লোকসভার, কখনও রাজ্যসভার। এবার তিনি আর সাংসদ থাকছেন না। সংসদ থেকে রাজনৈতিক সন্ন্যাসের পথে লালকৃষ্ণ আদবানি। বিজেপিতে আদবানি যুগের অবসান। উত্থান অমিত শাহের। বিজেপিতে যে প্রশ্নটা উঠেছে তা হল, মোদি কি এবার তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে অমিত শাহকে স্বীকৃতি দিচ্ছেন? যদি আবার বিজেপি সরকার হয় এবং যদি অমিত শাহ জিতে আসেন এবং মন্ত্রী হন, তা হলে তিনিই হবেন সরকারের দু-নম্বর ব্যক্তি। অটলবিহারী বাজপেয়ির যেমন ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি, তেমন মোদির রাজত্বে দলে তো দু’নম্বর পদে অমিতের উত্থান। তাহলে মোদি কি তাঁর উত্তরাধিকারের নিরুচ্চার ঘোষণাটাও সেরে রাখলেন? জানা গিয়েছে, বাদ দেওয়ার আগে মোদি–শাহরা একবারও কথা বলেননি আদবানির সঙ্গে। বরং চাপ দেওয়া হয়েছে, তিনি অবসর ঘোষণা করুন! আদবানি নীরব। এতটা অপমান প্রাপ্য ছিল তাঁর?
প্রার্থী না হতে পেরে নীরব আদবানি শুধু ৫৩৫ শব্দের একটা ব্লগ লিখলেন। যার শিরোনাম: নেশন ফার্স্ট, পার্টি নেক্সট, সেল্ফ লাস্ট। দেশ আগে, দল পরে, শেষে নিজে। নিশানা অব্যর্থ। জানিয়ে দিয়েছিলেন, প্রথমে ভারতীয় জনসঙ্ঘ, পরে ভারতীয় জনতা পার্টিতে তিনি বা অটলবিহারী বাজপেয়িরা চিরকাল নিজেকে পিছনে রেখে দল এবং দলের উপরে দেশকে স্থান দেওয়ার অনুশীলনই করে এসেছেন। সেটাই করে যাবেন বাকি জীবন। অথচ, মোদি-শাহের আমলে দল ছাপিয়ে নেতাই বড় হয়ে উঠেছেন। প্রার্থী নন আর, প্রচারেও নেই। এক রকম অন্তরালে ঠেলে দিতে চাওয়া হয়েছিল যাঁকে, সেই তিনিই যে ভোটের মুখে এমন ‘মেঘনাদ’ হবেন, বোধহয় ভাবতেও পারেনি টিম মোদি। আদবানির কথা ভেবে দুঃখপ্রকাশ করেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। মোদির নাম না-করে মমতার কটাক্ষ, ‘যখন প্রয়োজন ছিল, তখন আদবানি ছিলেন প্রকৃত মেন্টর (মাগদর্শক)। যখন তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে গিয়েছে, যখন তুমি খুব বড় হয়ে গিয়েছে, তখন তুমি অতীতকেই ভুলে গেলে। কিন্তু ওল্ড ইজ অলওয়েজ গোল্ড। প্রত্যেকেই একদিন বুড়ো হবে। একদিন সবাইকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। এটাই বাস্তব।’
আদবানিকে আবার প্রার্থী না-করার সিদ্ধান্ত নিয়ে খুব বেশি অবাক হওয়ার কোনও কারণ নেই। রাজনীতিতেও একটা সময় অবসর নিতেই হয়। তিনি দেশের উপ-প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সামলেছেন। তার আগে জনতা সরকারের আমলে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রকের দায়িত্বে ছিলেন। লোকসভা ও রাজ্যসভায় বিরোধী নেতার দায়িত্ব সামলেছেন। একসময় রাজ্যসভার নেতাও ছিলেন। দীর্ঘ সময় ধরে দলের সভাপতির দায়িত্ব সামলেছেন। বর্তমান নেতৃত্বের অধিকাংশই তাঁর নিজের হাতে তৈরি। প্রধানমন্ত্রী মোদি থেকে শুরু করে সুষমা স্বরাজ, অরুণ জেটলি, বেঙ্কাইয়া নাইডু, সদ্যপ্রয়াত অনন্ত কুমার-দের গুরু হলেন আদবানি। কিন্তু তাঁর এই প্রস্থানটা একেবারেই সাদামাটা। বিজেপি নেতাদের একাংশের মতে, যিনি দলটাকে নিজের হাতে তৈরি করে শক্তিশালী করেছিলেন, তাঁর বিদায়টা সম্মানজনক হতে পারত। এতটা উপেক্ষার কোনও প্রয়োজন ছিল না। আর একটু মর্যাদা তাঁর প্রাপ্য ছিল। আর এত নেতার ছেলে-মেয়েকে প্রার্থী করা হচ্ছে, সেখানে আদবানির ছেলে বা মেয়েকেও প্রার্থী হওয়ার প্রস্তাব দেওয়াই যেত।
আজ হয়তো ২০০২ সালের ১১ এপ্রিলের কথা আদবানির নিশ্চয়ই মনে পড়ে যাচ্ছে বারবার। সেদিন তিনি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়িকে বাধ্য করেছিলেন, গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে মোদিকে সরানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে। দু’জনেই ছিলেন একই বিমানের যাত্রী। গুজরাতের দাঙ্গা (যা তখনও থেমে যায়নি) মোকাবিলায় ব্যর্থতার জন্য মহা খাপ্পা বাজপেয়ি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে সরে যেতে বলবেন মোদিকে। কিন্তু সেদিনের বিমানযাত্রায় আদবানি ও তাঁর কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী বাজপেয়িকে চাপ দিয়ে কার্যত বাধ্য করেছিলেন সিদ্ধান্ত বদলাতে। দলের কথা ভেবে আদবানি সেদিন কাজটা না করলে মোদির ভাগ্যের চাকা হয়তো অন্য পথেই ঘুরে যেত। গ্রহের ফেরে সেই মোদিই আদবানির শেষ স্বপ্ন পূরণের পথে সবচেয়ে বড় দেওয়াল হয়ে উঠেছিলেন। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগেই নরেন্দ্র মোদি বনাম লালকৃষ্ণ আদবানির লড়াই চরমে উঠেছিল। গোয়ায় জাতীয় যে কর্মসমিতির বৈঠকে নরেন্দ্র মোদিকে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী করা হয়েছিল, সেই বৈঠক বয়কট করেছিলেন আদবানি। বৈঠকে সুষমা প্রায় মিনিট পঁয়তাল্লিশ পরে পৌঁছেছিলেন। আদবানি তো ক্ষোভে বিজেপির সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারক সংস্থা পার্লামেন্টারি বোর্ডের বৈঠক থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন। পরে পার্লামেন্টারি বোর্ড সেই ইস্তফা খারিজ করে। সে সময় মুরলি মনোহর যোশি, শান্তা কুমার, যশবন্ত সিনহারা এই প্রস্তাবের বিরোধী ছিলেন। পাঁচ বছর পর এসে দেখা যাচ্ছে, তাঁরা আর কেউ প্রার্থী নন। ভোটের ময়দান থেকে তাঁদের সরে যেতে হয়েছে। মোদি বিরোধী হলেই টিকিট নেই বিজেপিতে। আর বিজেপির বিজ্ঞাপন: ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।’
বিজেপির মার্গদর্শক মণ্ডলের সদস্য পঁচাশি বছর বয়সি মুরলি মনোহর যোশি কিন্তু আদবানির মতো নীরবে মেনে নেননি। হাটে হাঁড়ি ভেঙে কানপুরের ভোটদাতাদের উদ্দেশে খোলা চিঠি দিয়ে তিনি জানিয়েছিলেন, ‘আমার প্রিয় কানপুরের ভোটদাতারা, বিজেপির সংগঠন সচিব রামলাল আমায় বলেছেন, আমি যেন কানপুর বা অন্য কোথাও প্রার্থী না হই।’ মোদি-শাহর নির্দেশ ছিল, যোশিকেই ঘোষণা করতে হবে যে, তিনি আর প্রার্থী হতে চান না। কিন্তু যোশি একেবারে সরাসরি কানপুরের ভোটারদের জানিয়েছেন, দল তাঁকে জানিয়েছে, তিনি যেন কানপুর বা অন্য কোনও কেন্দ্র থেকেই প্রার্থী না হন। একইভাবে শান্তা কুমার, করিয়া মুন্ডা, কলরাজ মিশ্রদের বলা হয়েছিল, তাঁরা যেন নিজেরা ভোটে না-লড়ার কথা ঘোষণা করেন। আদবানি সেই ঘোষণা করেননি। কিন্তু প্রতিবাদের রাস্তাতেও যাননি। বাকিরা নির্দেশ মেনেছেন। হুকুম দেবনারায়ণ যাদবের ছেলেকে প্রার্থী করা হয়েছে। তাই তাঁর কোনও ক্ষোভ নেই। ভুবন চন্দ খান্ডুরির ছেলে কংগ্রেসের প্রার্থী হিসেবে তাঁর জেতা আসন থেকে লড়ছেন। তাই তিনিও জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ভোটে আর লড়বেন না।
আসলে এভাবেই বাজপেয়ি-আদবানির অনুগতদের এক এক করে এই পাঁচ বছরে মোদি-শাহ জুটি ছেঁটে ফেলেছে। যশবন্ত সিনহা, শত্রুঘ্ন সিনহা, অরুণ শৈরীরা আগেই বাদ গিয়েছেন। হাওয়া বুঝে উমা ভারতী তো কবেই হারিয়ে গিয়েছেন। হাওয়া বোঝার সেই ক্ষমতা আছে সুষমা স্বরাজেরও। স্বাস্থ্যের দোহাই দিয়ে বিদিশার এমপি অনেক দিন আগেই তাই জানিয়ে দিয়েছিলেন, অনেক হয়েছে, আর ভোট নয়। দলের উপেক্ষার পর পঁচাত্তরে পা দেওয়া লোকসভার স্পিকার সুমিত্রা মহাজনকেও জানাতে বাধ্য করা হয়েছে, তিনি আর ভোটে লড়বেন না। অথচ, মধ্যপ্রদেশের ইন্দোর থেকে আট বারের সাংসদ এটাও বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি এবারও লড়তে চেয়েছিলেন। ফলে পঁচাত্তর পেরিয়ে যাওয়া নেতাদের ব্যাপারে বিজেপির নীতিও স্পষ্ট হয়েছে। মোদির রাজনীতিতে এ এক নয়া পাঠ তো বটেই। এবার নির্বাচনে প্রবীণদের মনোনয়ন না দিয়ে একপ্রকার বাণপ্রস্থেই ঠেলে দেওয়া হয়েছে। চিরতরে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সংসদে তাঁদের আনাগোনা। জল্পনা উঠেছে দল গড়লেন যাঁরা তাঁদেরকেই অলিখিত ‘বৃদ্ধাশ্রমে’ পাঠিয়ে ঠিক কী বার্তা দিতে চাইলেন মোদি? আদৌ কি এই সিদ্ধান্ত সঠিক? নাকি সময়ের দাবি?
বিজেপির একাংশের মতে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে যেতে পারতেন ৩০ পৃথ্বীরাজ রোডে তাঁর একসময়কার রাজনৈতিক গুরুর বাড়ি। লোককল্যাণ রোডে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি নিবাস থেকে দূরত্ব এক কিলোমিটারও নয়। কিন্তু সেই রাস্তায় মোদি হাঁটলেন না। পাঠালেন সঙ্ঘের নেতা রামলালকে। আদবানিকে তিনি বললেন, দল চায় ভোটে না দাঁড়ানোর ইচ্ছার কথা তিনি নিজেই যেন দুনিয়াসুদ্ধ সবাইকে জানিয়ে দেন। অপমানিত আদবানি চুপ করে রামলালের কথা শুনেছিলেন। একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। রাজনীতি নিষ্ঠুর সবারই জানা। কিন্তু অনুশাসিত বলে গর্ব করা বিজেপির কাছে রাজনীতি যে এতখানি হৃদয়হীন, আদবানিদের অপসারণের মধ্য দিয়ে তা আজ স্পষ্ট।
আদবানি হয়তো দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সমাপ্তিটা টানতে চাইছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদে বসে। শিষ্য মোদির তাঁকে ডিঙিয়ে এগিয়ে যাওয়াটা তাঁর জন্য বাড়া ভাতে ছাই পড়ার মতো। একদিন হয়তো ৬৮ বয়সের এই নরেন্দ্র মোদিও কোনও উগ্র নেতার কাছে মিইয়ে যাবেন। আজকের আদবানির মতো তিনিই সেদিন হবেন নরমপন্থী। তিনিও মাগদর্শনে আচ্ছন্ন হবেন। কে না জানে, ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসের চাকা ঘুরছে অনবরত। তা বিলকুল জানে নাগপুরও!