বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
রাহুল বহুদিন ধরেই রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলছেন। স্লোগান দিচ্ছেন, ‘চৌকিদার চোর হ্যায়’। এতদিন বিজেপি নেতারা তার জবাবে কটূক্তি করেছেন বলে শুনিনি। কিন্তু গত ৫ মে মোদিকে রাহুলের উদ্দেশে বলতে শোনা গেল, আপনার বাবা তো একসময় মিস্টার ক্লিন বলে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু তিনি ভ্রষ্টাচারী নম্বর ওয়ান হিসাবে মারা গেলেন।
প্রয়াত রাজীব গান্ধীর আমলে বোফর্স কেলেঙ্কারির অভিযোগ উঠেছিল। প্রধানমন্ত্রী তার কথাই বলতে চেয়েছেন। তিনি যে কথাটি ভুলে গিয়েছেন, তা হল, বোফর্স নিয়ে রাজীবের বিরুদ্ধে অভিযোগ আদালতে টেকেনি। প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী কোনও দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন বলে প্রমাণ নেই।
সুতরাং আইনের চোখে ওই অভিযোগ অসত্য। তার চেয়েও বড় কথা হল, মৃত ব্যক্তির নামে অভিযোগ করা শিষ্টাচারসম্মত নয়। মনে হয় নরেন্দ্র মোদি কোনও কারণে নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। নার্ভাস হলে মানুষ অল্পে মেজাজ হারায়। উল্টোপাল্টা বলে ফেলে।
কেন মোদি নার্ভাস হচ্ছেন? দেশে পাঁচ দফা ভোটগ্রহণের পরে তাঁর মনে কি জয় নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে? তিনি অবশ্য মুখে বলছেন, এবার জিতছেনই। সত্যিই কি তিনি জিতবেন বলে নিশ্চিত? নাকি দলীয় কর্মীদের চাঙ্গা করার জন্য এইসব বলছেন?
মোদি ২০১৪ সালে ভোটের আগে বলতেন, দেশকে জঙ্গিদের হাত থেকে সুরক্ষিত রাখবেন। কোটি কোটি চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করবেন। কালো টাকার মালিকদের শায়েস্তা করবেন। মেয়েদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন। এইরকম আরও কত কী! সেই প্রতিশ্রুতিগুলি নিয়ে এবার আর বিজেপি নেতারা বিশেষ উচ্চবাচ্য করছেন না। গত কয়েক মাস যাবৎ ভোটের প্রচারে মোদি, অমিত শাহ এবং তাঁদের দলের অন্যরা সবচেয়ে জোর দিচ্ছেন সন্ত্রাসবাদ দমনের ইস্যুতে। গত ফেব্রুয়ারি মাসে কাশ্মীরের পুলওয়ামায় মারাত্মক কাণ্ড ঘটে। সিআরপিএফ-এর কনভয় যখন হাইওয়ে দিয়ে যাচ্ছিল, বিস্ফোরক ভর্তি গাড়ি নিয়ে তাতে ধাক্কা মারে এক জঙ্গি। ৪০ জনের বেশি আধা সেনা জওয়ান নিহত হন।
স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনার প্রতিক্রিয়া দেখা যায় দেশ জুড়ে। জঙ্গি হানার কয়েক দিনের মাথায় আমাদের বায়ুসেনা পাকিস্তানের অভ্যন্তরে ঢুকে বালাকোট নামে এক জায়গায় বোমা ফেলে আসে। সেখানে জঙ্গিদের শিবির ছিল। সরকারের দাবি, সন্ত্রাসবাদীদের যোগ্য জবাব দেওয়া হয়েছে।
কংগ্রেসের পাল্টা দাবি, মোদির আমলে জম্মু-কাশ্মীরে আরও তৎপর হয়ে উঠেছে সন্ত্রাসবাদীরা। সাধারণ মানুষ ও নিরাপত্তাকর্মীদের ওপরে আক্রমণের ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে ২৬০ শতাংশ। অনুপ্রবেশও বৃদ্ধি পেয়েছে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দেওয়া তথ্যে জানা যায়, ২০১৩ সালে কাশ্মীরে জঙ্গি হানা হয়েছিল ১৭০টি। ২০১৮-তে হয়েছে ৬১৪টি। এই জন্য কংগ্রেস বলছে, সন্ত্রাসবাদীদের তৎপরতা বেড়েছে ২৬০ শতাংশ।
কিন্তু শুধু দু’বছরের তথ্য দিয়ে কাশ্মীরের পুরো ছবিটা বোঝা যায় না। সামগ্রিকভাবে কংগ্রেস আমলের তুলনায় বিজেপি জমানায় জঙ্গি হানার সংখ্যা খুব বাড়েনি, কমেওনি। মোটামুটি একই আছে। ২০০৯ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যে কেন্দ্রে ছিল কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকার। তখন কাশ্মীরে জঙ্গি হানা হয়েছে ১৭১৭ বার। অন্যদিকে ২০১৪ থেকে ২০১৮-র মধ্যে কেন্দ্রে ছিল বিজেপি। ওই বছরগুলিতে জঙ্গি হানার সংখ্যা ১৭০৮। ২০১৮-১৯ সালে জঙ্গিরা কতবার হামলা করেছে, তার হিসাব এখনও মেলেনি।
কংগ্রেস আমলের তুলনায় এখন অনুপ্রবেশ কিছু কমেছে। সরকারের দেওয়া তথ্য বলছে, ২০০৯ থেকে ’১৩-র মধ্যে অনুপ্রবেশ হয়েছিল ১৭৬২ বার। ২০১৪ থেকে ’১৮-র মধ্যে ওই সংখ্যা কমে হয়েছে ১৪৫৬।
২০১৬ সালে কাশ্মীরে বুরহান ওয়ানি নামে এক জঙ্গি নিহত হয়। সে সন্ত্রাসবাদী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদিনের নেতা ছিল। এই মৃত্যুর পরে কাশ্মীর উপত্যকায় গোলযোগ বৃদ্ধি পায়। অনুপ্রবেশের চেষ্টাও বাড়তে থাকে। সম্ভবত বুরহানের মৃত্যুর প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর থেকে সন্ত্রাসবাদীরা এদেশে ঢুকতে চেষ্টা করেছিল। কিন্তু তাদের অনেককে যে রুখে দেওয়া গিয়েছে তাতে সন্দেহ নেই।
সন্ত্রাসবাদীরা শুধু জম্মু-কাশ্মীরেই নেই, দেশের অন্যত্রও আছে। উত্তর-পূর্বের বেশ কয়েকটি রাজ্য দীর্ঘদিন ধরে সন্ত্রাসকবলিত। এছাড়া মধ্য ভারতের দণ্ডকারণ্যে আছে মাওবাদীরা। ওইসব জায়গায় শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য বিজেপি সরকারের চেষ্টা কতদূর ফলপ্রসূ হয়েছে?
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৫ সালের পর থেকে উত্তর-পূর্বে জঙ্গি হানায় হতাহতের সংখ্যা কমেছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯৭ সালের পরে ২০১৭ সালেই ওই অঞ্চল ছিল সবচেয়ে শান্ত।
মধ্য ভারতের ছবিটা কীরকম?
গতবছরে মোদি এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ২০১৪ থেকে ’১৭-র মধ্যে আত্মসমর্পণ করেছে ৩৩৮০ জন মাওবাদী। যদিও নানা মহল থেকে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে, আত্মসমর্পণকারী বলে যাদের দেখানো হয়েছে, তারা সকলে সত্যিই মাওবাদী ছিল তো? নাকি অনেক ক্ষেত্রে গ্রামের নিরীহ মানুষকে ধরে আত্মসমর্পণকারী সাজিয়ে দেওয়া হয়েছে?
যাই হোক, মাওবাদী হিংসা যে আগের চেয়ে কিছু কমেছে তাতে সন্দেহ নেই। কিন্তু তার কৃতিত্ব বিজেপি’র একার নয়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকই বলছে, মাওবাদীদের তৎপরতা কমতে শুরু করে ২০১১ সাল থেকে। তার মানে কংগ্রেস আমল থেকেই মাওবাদী দমনে সাফল্য আসতে শুরু করেছিল।
বিজেপি নেতারা সন্ত্রাসবাদীদের কঠোর হাতে দমন করার কথা বলেন ঠিকই, কিন্তু কংগ্রেস আমলের তুলনায় তাঁদের রেকর্ড তেমন উজ্জ্বল নয়।
অর্থনীতির ক্ষেত্রে মোদি সরকারের সাফল্য কেমন? নতুন নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে কি?
এককথায় বলতে গেলে, এক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের রেকর্ড খুব খারাপ। তথ্য বলছে, চলতি বছরে দেশে বেকারত্বের হার ৬.১ শতাংশ। ১৯৭২-৭৩ সালের পরে বেকারত্বের হার কখনও এত বেশি হয়নি। ২০১১-১২ সালে দেশে কর্মহীন ছিলেন ২.২ শতাংশ মানুষ। সেই তুলনায় কর্মহীনের সংখ্যা এখন অনেক বেড়েছে বলতে হবে। ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে যাদের বয়স, তাদেরই কাজের অভাব সবচেয়ে বেশি। ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের কাজের সুযোগ কম। শহরে তরুণদের মধ্যে ১৮.৭ শতাংশ ও তরুণীদের ২৭.২ শতাংশের হাতে কাজ নেই। গ্রামের ক্ষেত্রে তরুণদের ১৭.৪ শতাংশ ও তরুণীদের ১৩.৬ শতাংশ কাজ খুঁজছেন।
যে দেশে যুবকদের এক বড় অংশ বেকার থাকে, সেখানে নানা অশান্তি সৃষ্টি হয়। তরুণদের একাংশ অবধারিতভাবে নানা অসাধু কার্যকলাপে জড়িয়ে পড়ে। নানা স্বার্থান্বেষী মহল তাদের নিজেদের কাজে লাগায়। অনেক সময় বেকার যুবকদের একটা অংশ চরমপন্থীদের দলে ভেড়ে। এইভাবে অর্থনৈতিক সংকট সমাজে অস্থিরতার জন্ম দেয়।
কর্মসংস্থানের হাল এত খারাপ কেন?
বিরোধীরা বলছেন, এর জন্য দায়ী নোটবন্দি আর জিএসটি।
২০১৬ সালে ৮ নভেম্বরের সন্ধ্যায় প্রধানমন্ত্রী সবাইকে চমকে দিয়ে ঘোষণা করলেন, দেশে পাঁচশো আর হাজার টাকার নোট বাতিল। দেশে ওইসময় যত নোট চালু ছিল, তার ৮৬ শতাংশই পাঁচশো ও হাজার টাকার। সরকার ভেবেছিল, নোট বাতিল করে কালো টাকার মালিকদের জব্দ করা যাবে। কিন্তু পরে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানায়, প্রায় সব নোট ফেরত এসেছে।
তাহলে আর কালো টাকার মালিকদের শাস্তি দেওয়া হল কই?
অসাধু উপায়ে যারা বিপুল ধনসম্পত্তির মালিক হয়েছে, তারা দিব্যি রয়ে গেল। কিন্তু নোট বাতিলের ফলে ক্ষতি হল অর্থনীতির। বিশেষত, অর্থনীতির যে শাখায় সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থান হয়, সেই অসংগঠিত ক্ষেত্র পড়ল সবচেয়ে বিপদে। সেখানে মূলত নগদ টাকায় কারবার হয়। নোটবাতিলে অনেক ছোট ব্যবসার ঝাঁপ বন্ধ হল। তার অনিবার্য পরিণতি, কর্মসংকোচন। হাজার হাজার মানুষের বেকার হয়ে যাওয়া।
২০১৭ সালের জুলাই মাসে দেশে গুডস অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্যাক্স চালু হয়। এতেও ছোট ও মাঝারি ব্যবসা সংকটে পড়ে। বহু কর্মী ছাঁটাই হন। মোদি বলেছিলেন, ম্যানুফ্যাকচারিং ক্ষেত্রে দেশকে সুপার পাওয়ারে পরিণত করবেন। তার কী হল?
সরকারের দাবি, ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ প্রকল্পের জোরে আর্থিক বৃদ্ধি ঘটবে। ২০২৫ সাল নাগাদ দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনের ২৫ শতাংশ আসবে ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে।
ওই প্রকল্প চালু হয়েছে কয়েক বছর হয়ে গেল। এখন ছবিটা কী?
তথ্য বলছে, এখনও পর্যন্ত জিডিপি-র বড়জোর ১৫ শতাংশ আসে ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে। আগামী দিনে তার পরিমাণ খুব বেশি বাড়বে বলে আশা কম।
২০১২ সালে দিল্লিতে নির্ভয়া কাণ্ডের পরে বোঝা গিয়েছিল, পথেঘাটে মেয়েদের কতবড় বিপদ ঘটতে পারে। মোদি বলেছিলেন, তাঁর সরকার মহিলাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবে। কিন্তু তথ্য বলছে, বিপদ কমেনি। বরং বেড়েছে। নারী নির্যাতনের নানা মামলায় যারা জেলে বন্দি, তারা শাস্তি পেয়েছে কমই। অনেক সময় দেখা গিয়েছে, আক্রান্ত মেয়েটি লোকলজ্জার ভয়ে সাক্ষী দেয়নি। অনেক সময় নিপীড়নকারী পুরুষটিই ভয় দেখিয়েছে আক্রান্ত মহিলা ও তার পরিবারকে।
সারা দেশে চাষিরা কেমন আছেন?
মোদি তো বলেছিলেন, ২০২২ সালের মধ্যে কৃষকদের আয় হবে ডবল। তার কোনও ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে কি? মনে হয় না।
কৃষকদের ঋণ বাড়ছে। চাষের যন্ত্রপাতি, বীজ, সার ইত্যাদি কিনতে গিয়ে তাঁরা দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন। ফসলের ন্যায্য দামও সবসময় মিলছে না। দেনার দায়ে আত্মঘাতী হয়েছেন অনেক চাষি। গত কয়েক বছরে দেশে কয়েকটি বড় কৃষক মিছিল দেখা গিয়েছে।
সব মিলিয়ে স্পষ্ট, এনডিএ সরকারের পাঁচ বছরে ব্যর্থতার ভাগ বেশি। সাফল্য কম। ভোটের বাক্সে সেই ব্যর্থতার প্রতিফলন পড়তে বাধ্য। মোদি তো নার্ভাস হবেনই।