বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
জল্পনার অবসান হল বৃহস্পতিবার। প্রিয়াঙ্কা দাঁড়াচ্ছেন না বারাণসীতে। শোনা যাচ্ছে, সোনিয়া গান্ধী নাকি চাননি, মেয়ে রাজনীতিতে এসেই প্রথমে মোদির বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করুক। প্রিয়াঙ্কার নিজের নাকি আপত্তি ছিল না।
মোদির বিরুদ্ধে ভোটে প্রার্থী হচ্ছেন না ঠিকই, কিন্তু গৈরিক ব্রিগেডের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তিনি যে কংগ্রেসের অন্যতম প্রধান সেনাপতি, তাতে সন্দেহ নেই। হাইকমান্ড নিশ্চয় বুঝেছিল, একা রাহুলকে দিয়ে চলবে না। তাই লোকসভা ভোটের ঠিক আগে প্রিয়াঙ্কাকে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে এনেছে।
এর মধ্যে কংগ্রেস সমর্থকরা তাঁর মধ্যে প্রয়াত ইন্দিরা গান্ধীকে খুঁজে পাচ্ছেন। প্রিয়াঙ্কা নিজেও ঠাকুমার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলছেন, আমি ইন্দিরাজির আদর্শে চলব।
এবার ভোটে নরেন্দ্র মোদির হাতিয়ার হিন্দু জাতীয়তাবাদ। সন্ত্রাসদমন। এনআরসি করে অনুপ্রবেশকারী বিতাড়ন। তিনি অবশ্য উন্নয়ন নিয়ে বেশিকিছু বলছেন না। তবে তাঁর জনসভায় ভিড় হচ্ছে মন্দ নয়।
বিপরীতে প্রিয়াঙ্কাকে কেন্দ্র করেই কংগ্রেস এবার ঘুরে দাঁড়াতে চায়। কংগ্রেসের বর্ষীয়ান নেতারা স্মরণ করছেন, বিংশ শতাব্দীর ছয়ের দশকের শেষদিককার কথা। সেবার গুরুতর সঙ্কটে পড়েছিল তাঁদের দল। পরিত্রাতার ভূমিকার অবতীর্ণ হয়েছিলেন প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা।
সেইসময়টা ছিল খুব টালমাটাল। তার কয়েক বছর আগে অস্ত গিয়েছেন নেহরু। দেশে প্রবল অর্থনৈতিক সঙ্কট। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা থমকে দাঁড়িয়েছে। চাকরি-বাকরি নেই। যুবকরা খেপে উঠেছে। দলের প্রবীণ নেতারা মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন।
এই অবস্থায় ইন্দিরা যে এসে দলকে ফের বাঁচিয়ে তুলবেন, তা অনেকেরই ভাবনার অতীত ছিল। কিন্তু নেহরু বুঝেছিলেন, তাঁর মেয়ের সেই ক্ষমতা আছে। তাঁর অবর্তমানে শক্ত হাতে কংগ্রেসের হাল ধরতে পারবে। মেয়েকে দলের সর্বোচ্চ পদটিতে বসানোর কাজটি তিনি করে গিয়েছিলেন সন্তর্পণে।
জরুরি অবস্থার অবসানের পর বরুণ সেনগুপ্ত একটি বই লেখেন—‘ইন্দিরা একাদশী’। তাতে আছে, কীভাবে মৃত্যুর আগে নেহরু কামরাজ পরিকল্পনার নামে একে একে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন বয়োবৃদ্ধ নেতাদের। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল মেয়েকে নেতৃত্বের সামনের সারিতে নিয়ে আসা।
ইন্দিরার পক্ষে প্রধানমন্ত্রী হওয়া অত সহজ হয়নি তা’বলে। নেহরুর পরে যিনি প্রধানমন্ত্রী হলেন, সেই লালবাহাদুর শাস্ত্রী ভালো চোখে দেখতেন না তাঁকে। ইন্দিরা একসময় নাকি হতাশ হয়ে ভেবেছিলেন, দেশ ছেড়ে চলেই যাবেন লন্ডনে।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের পরে শাস্ত্রীজি তাসখন্দে আচমকাই মারা গেলেন। তখন কংগ্রেসে প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার মোরারজি দেশাই। তিনি খুব কঠোর প্রকৃতির মানুষ। কংগ্রেসের নেতারা অনেকে পছন্দ করতেন না তাঁকে। তাঁরা উদ্যোগ নিয়ে ইন্দিরাকে মসনদে বসালেন।
অনেকেই ভাবতেন, ইন্দিরা শান্তশিষ্ট মুখচোরা মহিলা। কোনও ব্যাপারে জোরের সঙ্গে নিজের মত প্রকাশ করতে পারেন না।
প্রবীণ কংগ্রেসিদের মধ্যে তাঁর একটা চালু নাম ছিল—‘গুংগি গুড়িয়া’। তার মানে বোবা পুতুল। অনেকে চেয়েছিলেন, ইন্দিরা সত্যিই প্রধানমন্ত্রী পদে কাঠপুতলির মতো বসে থাকুন, তাঁরা আড়াল থেকে দেশ চালাবেন।
ইতিহাস সাক্ষী, তাঁরা খুব ভুল ভেবেছিলেন।
ইন্দিরা যে দক্ষ রাজনীতিক হয়ে উঠবেন তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। তিনি রাজনীতি করা পরিবারের সন্তান। তাঁর দুটি প্রজন্ম আগে নেহরু পরিবারের রাজনীতিতে প্রবেশ ঘটেছে। তাঁর ঠাকুর্দা ও বাবা, দু’জনেই জাতীয় রাজনীতিতে খুব নামকরা নেতা ছিলেন।
পরিবারের সুবাদে ছোটবেলা থেকে দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের সঙ্গে ইন্দিরার পরিচয়। সেই আমলের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যাঁরা ক্ষমতাশালী ব্যক্তি, তাঁদেরও তিনি চিনতেন। শুধু রাজনীতিক নয়, বিশ্ববরেণ্য সাহিত্যিক, বৈজ্ঞানিক, চিত্রকর ও অন্যান্য বিখ্যাত ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর আলাপ ছিল। উঁচু মানের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তিনি বড় হয়েছেন। তাঁর চরিত্র ছিল সংবেদনশীল। দেশের দরিদ্র জনতা, বিশেষত তরুণরা কী চায়, তিনি ভালো বুঝতেন। ছয়ের দশকের শেষে যখন কংগ্রেসের মধ্যে নতুন ধ্যানধারণা আনা খুব প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল, তখন তিনি হয়ে উঠেছিলেন অবিসংবাদী নেত্রী।
সেই আমলে বামপন্থীরা কথায় কথায় কংগ্রেসকে বড়লোকের দল বলে গাল দিত। কিন্তু ইন্দিরা যখন রাজন্যভাতা বিলোপ করলেন, ব্যাঙ্ক জাতীয়করণ করলেন, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দিলেন, সিপিএমের মতো দলও তাঁর প্রশংসা না করে পারেনি।
একাত্তর সালে ইন্দিরার জনপ্রিয়তা উঠেছিল তুঙ্গে। ভোটেও তাঁর সামনে বিরোধীরা খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়েছিল।
কংগ্রেসিরা কেউ কেউ আশা করছেন, প্রিয়াঙ্কার নেতৃত্বে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে। আবার অনেকে ভাবছেন, অত দূর না হলেও প্রিয়াঙ্কার ক্যারিশমার জোরে অন্তত কেন্দ্রে জোট সরকার গড়ার মতো আসন পেতে পারে কংগ্রেস।
তাঁর উপর এত দূর আশা করা কি ঠিক হচ্ছে?
একথা সত্যি যে, প্রিয়াঙ্কা রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ নন।
তিরিশ বছর আগে, ’৮৯ সালে তিনি প্রথম ভোটে প্রচার করেছিলেন বাবার হয়ে। সেবার রাজীব গান্ধীর কেন্দ্র ছিল আমেথি।
প্রিয়াঙ্কার জন্ম ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি। ’৮৯ সালে তিনি বছর সতেরোর কিশোরী। তখন থেকেই রাজনীতিতে হাতেখড়ি।
তারপর দীর্ঘ বিরতি। ’৯৯ সালে তিনি ফের প্রচারে রায়বেরিলিতে। লোকসভা ভোটে বিজেপির প্রার্থী অরুণ নেহরু। তিনি একসময় রাজীব গান্ধীর খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। পরে গেরুয়া শিবিরে যোগ দেন।
বিপরীতে কংগ্রেস প্রার্থী ক্যাপ্টেন সতীশ শর্মা। ২৭ বছরের তরুণী প্রিয়াঙ্কা সেবার খুব আক্রমণাত্মক। মানুষকে প্রশ্ন করছেন, কেয়া, আপ উস ব্যক্তি কো ভোট দেঙ্গে জিসনে মেরি পিতা কো পিঠ মে ছুরি ভুঁকি হ্যায়? আপনারা কি সেই ব্যক্তিকে ভোট দেবেন, যিনি আমার বাবার পিঠে ছুরি মেরেছেন?
সেবার সতীশ শর্মা জয়ী হন। তার মানে, প্রিয়াঙ্কার প্রচারে ফল হয়েছিল।
২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে সকলের আশা ছিল, রাজীব তনয়া নিজে প্রার্থী হবেন। কিন্তু তিনি হননি। সেবার সোনিয়া তাঁর আমেথি কেন্দ্র ছেড়ে সরে গেলেন রায়বেরিলিতে। আমেথিতে প্রার্থী হলেন রাহুল। সবাই বুঝল, তিনিই নেহরু-গান্ধী পরিবারের রাজনৈতিক উত্তরসূরি, প্রিয়াঙ্কা নন।
আমেথিতে রাহুলের হয়ে প্রচারে দেখা গেল তাঁর বোনকে।
২০১৪ সালে আরও একবার উত্তরপ্রদেশে জোরালো দাবি উঠল, প্রিয়াঙ্কাকে প্রার্থী হতে হবে। এলাহাবাদের কংগ্রেস কর্মীরা একটা ব্যানার তৈরি করেছিলেন, যাতে লেখা—‘‘মাইয়া অব রহতি বিমার, ভাইয়া পর পড় গয়ি ভার, প্রিয়াঙ্কা ফুলপুর সে বনো উম্মিদবার, পার্টি কা করো প্রচার, কংগ্রেস সরকার বানাও তিসরি বার।’’
এর অর্থ—মা সোনিয়া গান্ধী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ভাই রাহুলের উপর বেশি চাপ পড়ে যাচ্ছে। প্রিয়াঙ্কা ফুলপুর থেকে প্রার্থী হোন। তৃতীয় বার কংগ্রেস সরকার বানান।
তিনি এই আবেদনেও সাড়া দেননি। কিন্তু ভোটের কৌশল রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। শোনা যায়, উত্তরপ্রদেশে তাঁর মত নিয়ে অন্তত ২০ জন প্রার্থী ঠিক হয়েছিল। দেশের অন্যান্য প্রান্তেও প্রার্থী ঠিক করার সময় তাঁর পছন্দ অপছন্দ গুরুত্ব পেয়েছিল।
২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের ভোট ছিল মোদি সরকারের অ্যাসিড টেস্ট। তার ক’মাস আগে নোটবন্দি হয়েছে। রাতারাতি ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট বাতিল। ব্যাঙ্কে বিরাট লাইন। সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ।
অনেকে ভেবেছিলেন, ভোটে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। কংগ্রেস ভোটে স্ট্র্যাটেজি ঠিক করার জন্য প্রশান্ত কিশোরের সাহায্য নিয়েছিল। কংগ্রেসের সঙ্গে সমাজবাদী পার্টির যাতে জোট হয় সেজন্য অখিলেশ সিং যাদবের সঙ্গে আলোচনা চালিয়েছিলেন প্রিয়াঙ্কা। নভজ্যোৎ সিং সিধুসহ বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কংগ্রেসে নিয়ে আসার কৃতিত্বও নাকি তাঁর। ২০১৮ সালে কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট পদে যাতে রাহুলের অভিষেক হয় তাও নাকি তিনিই নিশ্চিত করেছিলেন।
অর্থাৎ দীর্ঘকাল ধরে তিনি নেপথ্যে থেকে কংগ্রেস সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। এতদিনে সামনে এলেন।
ইন্দিরা যখন কংগ্রেসের দায়িত্ব নেন তখন তাঁর প্রধান প্রতিপক্ষ ছিলেন দক্ষিণপন্থীরা। সে-যুগে কংগ্রেসের মধ্যেই ছিল দক্ষিণপন্থী লবি। অন্যদিকে, ইন্দিরা ছিলেন বামঘেঁষা। গরিবদরদি ভাবমূর্তি ছিল তাঁর।
সেইসময়কার সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতির কিছু মিল আছে।
এখনও দক্ষিণপন্থীরা জাতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের প্রধান প্রতিপক্ষ। তাদের দল বিজেপি। অভিযোগ, তারা ধনীদের তোষণ করে। মোদি গত লোকসভা ভোটের আগে বলেছিলেন বটে যে ক্ষমতায় এলে কালো টাকার কারবারিদের শায়েস্তা করবেন। বাস্তবে কিছুই করেননি।
কংগ্রেস ইন্দিরার আমলের মতোই গরিবদরদি কর্মসূচির কথা বলছে। রাহুল গান্ধী বলেছেন, ক্ষমতায় এলে ‘ন্যায়’ প্রকল্প রূপায়ণ করবেন। দেশের সবচেয়ে গরিব পরিবারগুলি মাসে কমপক্ষে ১২ হাজার টাকা আয় করতে পারবে।
কংগ্রেসের একটা বড় অভিযোগ, মোদির আমলে ভারতের সহনশীলতার ঐতিহ্য নষ্ট হয়েছে।
একথা ঠিক যে, গত কয়েক বছরে গোরক্ষার নামে বেশ কয়েকজন নিরীহ মানুষ খুন হয়েছেন। তার পিছনে বিজেপি নেতৃত্বের একাংশের মদত ছিল।
কংগ্রেসের আর একটা হাতিয়ার ‘রাফাল দুর্নীতি’। কয়েক মাস ধরে রাহুল গান্ধী টানা অভিযোগ করে আসছেন অত্যধিক দাম দিয়ে ফ্রান্স থেকে যুদ্ধবিমান কিনছে এনডিএ সরকার। বিমান কেনার চুক্তিতে বিশেষ সুবিধা পেয়েছেন মোদির বন্ধু শিল্পপতি অনিল আম্বানি।
ধরে নেওয়া যায়, এবারও প্রিয়াঙ্কা লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের কৌশল রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছেন। বিজেপিকে কোন কোন ইস্যু তুলে আক্রমণ করা হবে, সে-ব্যাপারে নিশ্চয় তার মতামত নেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু কেবল ইস্যু তুললেই হল না, তা জনসাধারণের কাছে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলা চাই। ইন্দিরা সেই কাজটি পেরেছিলেন। প্রিয়াঙ্কা কি পারবেন? শুধু কংগ্রেসিরা নন, বিজেপি-বিরোধী সব দলই চাইছে তিনি সফল হোন। কারণ, সর্বভারতীয় স্তরে মোদির মোকাবিলা করার মতো আর কোনও নেতা বা নেত্রী নেই।