কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
অন্যদিকে সরকারপাড়া বুথের সামনের এই নারকী কাণ্ড নিয়ে যুযুধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে চাপান-উতোর—দোষারোপ, পাল্টা দোষারোপের পালা চলেছে চ্যানেলযুদ্ধে। নিহত রাজমিস্ত্রি কংগ্রেসের স্থানীয় কর্মী বলে চিহ্নিত হয়ে গেছেন। তাঁর সঙ্গে আহত দু’জনের একজন কংগ্রেস, অন্যজন তৃণমূল বলে স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ফলে, একটি নির্মম নারকী হত্যাকাণ্ড রাজনৈতিক সংঘর্ষের শিরোপা পেয়ে গেছে এবং সেখানেও জয়-পরাজয় নিয়ে পক্ষে, প্রতিপক্ষে একটা হইহই যুদ্ধপরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যেমন হয়, যেমনটি আমরা দেখতে অভ্যস্ত তেমনই আর কী! এবং এবারের মোটামুটি শান্তির ভোটে রক্তের ছাপ লাগল কার দোষে—তা নিয়ে বাদানুবাদের আসরও বসে গেছে বিভিন্ন মহলে। এর মধ্যে ব্যতিক্রম ছিল কেবল একটাই, যাকে বলে একেবারে বেখাপ্পা ব্যতিক্রম—এক তরুণ। বুক খোলা রক্তে ভেজা শার্ট, বিধ্বস্ত মুখ, কান্না থমকে থাকা ভারী চোখ আর অসহায় মর্মান্তিক একটা চাহুনি। সরকারপাড়া হত্যাকাণ্ড নিয়ে জেগে ওঠা রাজনৈতিক কোলাহল থেকে দূরে হাসপাতালের বারান্দায় সেই তরুণের বুকফাটা আর্তনাদে কেঁপে কেঁপে চলেছে বৈশাখের তপ্ত নীল কঠিন আকাশ—আমরা তো যে যখন যা বলেছে করেছি, যেমন বলেছে দিয়েছি... তাও কেন এমন হল...! তাকে ঘিরে ছোট্ট ভিড়! নিরুত্তর!
সেটাই স্বাভাবিক। আমরাই কি জানি ছাই ওই সরল প্রশ্নের উত্তর! আমরা যারা শিক্ষিত সভ্যসজ্জন জাতীয় কি আন্তর্জাতিক সব বিষয়ে সমান দক্ষ মার্কসবাদ থেকে মোদিবাদ সব যাদের মুখস্থ কণ্ঠস্থ, আমরা যারা প্রতিনিয়ত গণতন্ত্রের হয়ে ধ্বজা তুলি গরিব মেহনতি মানুষের জন্য যাদের চোখের জল কখনও শুকোয় না, আমরা যারা বক্তৃতার মঞ্চ পেলে কথার কুঠারের দশ-পাঁচ ঘায়ে এভারেস্টকেও চাইলে নামিয়ে আনতে পারি পদতলে—সেই আমরাও কি জানি—সব মেনে নেওয়ার পরও কেন এমন হয়! জানলে তো নিশ্চয়ই আগেভাগে জানিয়ে দেওয়া যেত ওই তরুণের বাপকে—বুঝিয়ে দেওয়া যেত, বাপু ভোট নিয়ে ঝঞ্ঝাটে যেও না। চুপচাপ যাও, পারলে দাও না পারলে ফিরে এস। রাজমিস্ত্রির কাজে চলে যাও। কামাও, খাও বাল-বাচ্চা নিয়ে ঘর কর।
জানি না বলেই বলা হয় না। আর সেই খামতি কেড়ে নেয় টিয়ারুল ইসলামের মতো প্রাণ। আর ঘটনার পর আমাদের যাদের মঞ্চ আছে অজুহাত দিই, যুক্তি খাড়া করি ওই মৃত্যু থেকে দু-চার সের রাজনৈতিক ফায়দা আসে কি না তার হিসেব কষি। আর যাদের সেই মঞ্চ নেই তাদের বাক্স আছে—বাক্স খুলে হত্যা ও তৎসংলগ্ন রাজনীতির রোমাঞ্চকর গল্প শুনি, ছবি দেখি। দেখি কীভাবে রাজমিস্ত্রির মতো একজন সাধারণও মৃত্যুর পর কয়েকদিনের জন্য হলেও রাজনীতির চরিত্র হয়ে উঠছেন, কাগজে মিডিয়ায় ছাপা হচ্ছে তাঁর ছবি, কত লোক তাঁকে নিয়ে তাঁর ঘর-পরিবার নিয়ে কত কিছু বলছেন এবং সব মিলিয়ে ক’দিন আগের অজ্ঞাতপরিচয় মানুষটির ‘বিশেষ’ পরিচয় তৈরি হয়ে যাচ্ছে জনমনে! আজ বলে নয়—এই ট্র্যাডিশন চিরকালই ছিল, আজও চলছে। মিডিয়ামুগ্ধ এই যুগে তার প্রতিপত্তি যে বহুগুণ বেড়েছে—তাতেই বা সন্দেহ কি?
কিন্তু, মঙ্গলবারের ওই ঘটনা নিয়ে এত কথা কেন? সেদিনের ভোটের সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে সরকারপাড়ার খুনটাকে একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবেই তো দেখতে হয়। তার কারণ ওই দিন তৃতীয় দফার ভোটেও অশান্তি প্রায় হয়নি বললেই চলে। ডোমকলের টিকটিকি পাড়ায় অল্পবিস্তর বোমাবাজি (তাও বুথ থেকে ছ-সাতশো মিটার দূরে) দক্ষিণ দিনাজপুরের কুশমণ্ডিতে বিজেপি সমর্থকদের ভোটদানে বাধা বা হরিহরপুরে একটি বুথের কাছে চা-দোকানে ভাঙচুরের মতো ঘটনা বা বুথের ভিতরে-বাইরে ভোটার প্রভাবিত করার ঘটনা নিয়ে তৃণমূল, বিজেপি, কংগ্রেসের এজেন্টদের মধ্যে বচসাকে আর যা-ই হোক বড় ঘটনা বলা যায় কি? তাছাড়া, একথা অতি বড় নিন্দুকও স্বীকার করছেন যে, মঙ্গলবার পাঁচ কেন্দ্রের ভোটেই কেন্দ্রীয় বাহিনী ও পুলিস যথেষ্ট ছিল। নির্বাচন কমিশনের নজরও ছিল কড়া। ফলে গণ্ডগোল পাকানোর হোতাদের বিশেষ সুবিধা হয়নি। মানুষ মোটের ওপর নির্বিঘ্নেই ভোট দিয়েছেন। অথচ, এমন সামগ্রিক শান্তির পরিবেশেই সরকারপাড়ায় খুনের ঘটনাটা ঘটেছে। প্রথম দুই পর্ব শান্তিতে মিটতে দেখে মানুষের মনে পরবর্তী পর্বগুলো নিয়ে যে আশ্বাস-বিশ্বাস দানা বাঁধছিল—সরকারপাড়া তাতে একটা জোর ধাক্কা দিয়ে গেছে। সেজন্যই এত কথা।
বাংলার ভোটে হিংসা কোনও নতুন ব্যাপার তো নয়। কিন্তু, এবার প্রথম থেকেই ভোটের পরিবেশ পরিস্থিতি একটু আলাদা বলেই মনে হয়েছে। একদিকে কেন্দ্রীয় বাহিনীর ব্যাপক টহলদারি, নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষকদের নজরদারি এবং অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুলিস প্রশাসনের সক্রিয়তা সহযোগিতায় সাধারণ মানুষজনের মনের ভোটভীতিও অনেকটাই প্রশমিত দেখিয়েছে। ফলে, ভোট প্রচারে যুযুধান পক্ষের নেতানেত্রীর তরজায় উত্তেজনার পারদ যতই চড়ুক, একটা সৌহার্দের পরিবেশে ভোট শেষ হবে এমন প্রত্যাশা বেড়ে উঠছিল মানুষের মধ্যে। মঙ্গলবারের মর্মান্তিক ঘটনা তাতে একটা ধাক্কা দিয়েছে। ধাক্কা দিয়েছে তবে ভাঙতে পারেনি—পথেঘাটে সাধারণের কথায় তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। এবং জনমহলে যে ভোট জল্পনা চলছে সেখানেও এই আঁটোসাটো নিরাপত্তার ভূমিকা স্বীকৃতী হচ্ছে। আসলে, বাংলার মানুষ তা তিনি রাজনৈতিক কর্মী-সমর্থকই হোন, কি সাধারণ পাবলিক—কেউই রক্তারক্তি খুনোখুনি পছন্দ করেন না। এই ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতার যুগেও রক্তপাত এড়িয়ে চলতে চান এ রাজ্যের অধিকতর মানুষ—একথা তথ্যভিজ্ঞজনেরাও স্বীকার করেন। ওইসব পছন্দ যারা করে তাদের একমাত্র পরিচয়—দুষ্কৃতী, সমাজবিরোধী। তৃণমূল, সিপিএম, কংগ্রেস, বিজেপি কিচ্ছু না—খুনেগুন্ডা, দুষ্কৃতী। কিন্তু, দুর্ভাগ্য এই যে, আমাদের দেশে এরা অনেক সময়ই নানা কৌশলে রাজনৈতিক একটা পরিচয় পেয়ে যায়! এক্ষেত্রেও এত বছরে কোনও ব্যত্যয় ঘটেনি! আর এই না ঘটার মাশুল গুনতেই সরকারপাড়া ঘটে! আমাদের ভোট উৎসব কলঙ্কিত হয়। সেজন্যই এত কথা।
যাইহোক ভোট চলছে। সাত পর্বের তিন পর্ব শেষ। সুদূর উত্তর থেকে জেলার পর জেলা পার হয়ে ক্রমশ কলকাতা মহানগরীর দিকে এগিয়ে আসছে নির্বাচন। যত এগিয়ে আসছে তত তাপ বাড়ছে ভোটের ময়দানে। মোদি-মমতার সভা, পাল্টা সভায় সরগরম ভোটবাজার। এবং তৃতীয় পর্বে রক্তপাত প্রাণহানির পর সঙ্গত কারণেই সাধারণ মানুষজনের মহলে প্রশ্ন জেগেছে—শেষ চার পর্বের ভোট রক্তপাতহীন হবে তো? মানুষের নিরাপত্তা ভোটকর্মীদের সুরক্ষা বজায় থাকবে তো? থাকবে কি থাকবে না সেটা বলবে সময়। তবে, ইতিমধ্যেই ভোট-কমিশন জানিয়ে দিয়েছে, চতুর্থ পর্বে ৯৮ শতাংশ বুথে কেন্দ্রীয় বাহিনী থাকবে। রাজ্যের পুলিস তো থাকবেই। ফলে, সাধারণের মধ্যে একটা আশ্বাসের বাতাবরণ নিশ্চিত তৈরি হয়েছে। কিন্তু, পাশাপাশি তক্ষাদের মনে একটা খটকা থেকেই যাচ্ছে। মুর্শিদাবাদের সরকারপাড়াতেও তো যথেষ্ট আঁটোসাঁটো নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল। পুলিস বাহিনী সবই ছিল। তা সত্ত্বেও হাঙ্গামা হল কীভাবে! কীভাবে দুষ্কৃতীরা একজনকে বুথে না হলেও বুথের কাছাকাছি অমন নৃশংসভাবে খুন করে বেরিয়ে গেল!? যতদূর মনে পড়ছে টিভি চ্যানেলে একজন স্থানীয় বলেছেন, ঘটনার সময় বুথে প্রহরারত নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে সাহায্য চাইতে গেলে তাঁরা নাকি বলেছিলেন, বুথ ছেড়ে যাওয়া যাবে না! এবং, নিরাপত্তার সেই ফাঁকেই ঘটে গিয়েছে ওই মর্মান্তিক হত্যা! দুষ্কৃতীরাও চম্পট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে! প্রশ্ন একটাই, আসন্ন পর্বগুলোতে নিরাপত্তার ওই ফাঁকটা ভরানো হবে তো? না হলে বুথের শুদ্ধতা হয়তো বাঁচবে, কিন্তু ভোটারদের মনে প্রাণচিন্তাটা থেকেই যাবে— তাই না?