ইস্কুল স্ট্রাইক করা এক আশ্চর্য ষোড়শীর গল্প
অতনু বিশ্বাস
এটা একটা স্কুলের মেয়ের গল্প। তার ভয়, অবসাদ, দৃঢ়তা আর সংগ্রামের গল্প, তার সংকল্পের কথকতা। কেবলমাত্র ইস্কুল পালিয়ে, থুড়ি, ইস্কুল স্ট্রাইক করে, মানে একেবারে বলে-কয়ে ইস্কুল না গিয়ে, পনের-ষোল বছরের মেয়েটি চলে এসেছে পৃথিবীর খবরের শিরোনামে। হয়ে উঠেছে বিশ্ব-জনতার নয়নের মণি। এমনটাও হয় বুঝি! ইস্কুল পালানোর মানসিকতা বা প্রচেষ্টা তো নতুন কিছু নয়। তবু, পার্থক্য কিছু আছে বইকি। টম সয়্যার পেটে ব্যাথা বলে ইস্কুল পালিয়ে বাড়িতে শুয়ে থাকত। আর এই মেয়েটি কিন্তু সটান গিয়ে হাজির সুইডেনের সংসদের সামনে।
একটু খোলসা করে বলা যাক। গ্রেটা থানবার্গ সুইডেনের মেয়ে। বড় হয়েছে স্টকহোমে। সম্প্রতি পরিবেশের উষ্ণায়ন রুখতে তার কর্মকাণ্ডে কিন্তু নড়েচড়ে বসেছে পৃথিবী। ২০১৮-র আগস্টে প্রথম পৃথিবীর নজরে আসে ক্লাস নাইনের ছাত্রীটি। সে বছরের গ্রীষ্মে গোটা ইউরোপ জুড়েই চলেছে তাপপ্রবাহ, আর তার ফলশ্রুতিতে নজির-বিহীন গরম, সুইডেন এবং ইউরোপের অন্যান্য জায়গায় বনে-জঙ্গলে ঘটেছে অগ্নিকাণ্ড। ২০ আগস্ট, গ্রেটা স্কুলের সময়কালেই বসে পড়ল রিকস্ড্যাগ বা সুইডেনের সংসদের সামনে। হাতে একটা প্ল্যাকার্ড, সুইডিশ ভাষায় যাতে লেখা ‘স্ললস্ট্রেক্জ ফর ক্লাইমাটেট’, অর্থ ‘জলবায়ুর জন্য ইস্কুল স্ট্রাইক’। সংসদের দৃষ্টি আকর্ষণের উদ্দেশ্যে। জলবায়ু রক্ষায় প্যারিস পরিবেশ চুক্তি অনুসারে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য। এমনি করে চলল সেপ্টেম্বরের ৯ তারিখ, অর্থাৎ সুইডেনের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত। জলবায়ুর সমস্যাকে ‘সংকট’ হিসেবে দেখার দাবিতে গ্রেটার একক প্রতিবাদ কর্মসূচি। ইস্কুল কেটে। নির্বাচনের পরেও গ্রেটা তার স্ট্রাইকটা চালিয়ে চলল, তবে সপ্তাহে একদিন, শুক্রবার।
গ্রেটা খুব সম্ভবত তার স্ট্রাইকের অনুপ্রেরণাটা পেয়েছে আটলান্টিকের ওপারে মার্কিন মুলুকের ফ্লোরিডার পার্কল্যান্ড স্কুলের ছাত্রদের কাছ থেকে। বন্দুকবাজ গণহত্যা চালায় এই স্কুলে। স্কুলের রক্ষা পাওয়া ছাত্ররা তাই ক্লাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে মার্কিন দেশের ঢিলেঢালা বন্দুক আইনের প্রতিবাদে।
গ্রেটার ভাবনার মতই এ গ্রহের ক্ষেত্রে ‘ফ্রাইডেজ ফর ফিউচার’ হয় কি না সেটা বলা এখনই সম্ভব নয়। তবে পৃথিবীজুড়েই একটা আলোড়ন যে উঠেছে সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। পরিবেশের জন্যে স্কুল স্ট্রাইকের এই আন্দোলনের তরঙ্গটা ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবী জুড়ে। বিশ্বের কয়েকশো শহরের হাজারে হাজারে স্কুলছাত্র শামিল হল এতে। কেবলমাত্র বার্লিন শহরেই ২৫,০০০ ছাত্র-ছাত্রী শামিল
হয়েছে স্কুল স্ট্রাইকে। পুরো জার্মানিতে সংখ্যাটা ৪০ হাজারের বেশি। বিশ্বজোড়া স্কুল স্ট্রাইকের তেত্রিশ সপ্তাহ এটা।
ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের বাইরে ‘রাইজ ফর ক্লাইমেট’ আন্দোলনে শরিক হয়েছে গ্রেটা। আর ইতিমধ্যেই বড় বড় মঞ্চে বেশ কিছু বক্তৃতা দিয়ে ফেলেছে ছোট্ট গ্রেটা। অক্টোবরে লন্ডনে, নভেম্বরে স্টকহোমে টেডএক্স কনফারেন্সে, ডিসেম্বরে রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বৈঠকে, এবং প্লেনারি অ্যাসেমব্লিতে, জানুয়ারিতে দাভোসে ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের মিটিংয়ে, ফেব্রুয়ারিতে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কমিটির কনফারেন্সে। সুইজারল্যান্ডের দাভোসে বিশ্বের নেতৃবর্গের কাছে তার আবেদন ছিল, ‘‘আমাদের ঘরে আগুন লেগেছে। আপনারাও এটা নিয়ে ভাবুন, সাঙ্ঘাতিক ভয় পান, যে ভয়টা আমি পেয়ে চলেছি প্রতিনিয়ত।’’ সুকান্তর নাট্যকাব্য ‘অভিযান’-এর নায়িকা সংকলিতার মত গ্রেটাও যেন বলছে, “আমরা যে বড়ই বিপন্ন।’’
আসলে আট বছর বয়স থেকেই জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে মাথাব্যাথা গ্রেটার। তার কাছে এটা একটা বিশ্বযুদ্ধ ঘটে চলার মতই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ছোটবেলায় আর পাঁচটা বাচ্চার মতই শিক্ষামূলক ছবি দেখেছে গ্রেটা—যেমন উত্তর সমুদ্রের বরফ গলছে, বিপন্ন মেরু ভাল্লুকের দল, কিংবা প্লাস্টিকের দূষণে সমুদ্রের স্তন্যপায়ীদের বিপন্নতা। কিন্তু গ্রেটার মাথায় তা যেন গেঁথে গিয়েছে একেবারে, অন্য বাচ্চাদের থেকে সম্পূর্ণ আলাদাভাবে। গ্রিক উপকথায় রয়েছে ক্যাসান্দ্রা-র গল্প। ট্রয়ের রাজা প্রিয়ামের মেয়ে। ভবিষ্যদ্বাণী করায় তুখোড় ছিল সে। ট্রয়ের ধ্বংসের পূর্বাভাষ করেছিল ক্যাসান্দ্রা। গ্রেটা থানবার্গ যেন আধুনিক যুগের জলবায়ুর পরিবর্তনের ক্ষেত্রে ক্যাসান্দ্রার ভূমিকা পালন করতে এসেছে। যে এই প্রলয়-সন্ধ্যায় দুনিয়ার রাজনৈতিক ক্ষমতাসম্পন্নদের মনে করিয়ে দিচ্ছে দিনের অন্তিমকালের কথা।
ইস্কুল পালানো মেয়েটিকে স্বীকৃতি দিতে কিন্তু কার্পণ্য করেনি দুনিয়া। ২০১৮-র ডিসেম্বরে টাইম ম্যাগাজিন গ্রেটাকে বলল বছরের সেরা ২৫ প্রভাবশালী টিন-এজারের একজন। ইতিমধ্যেই অজস্র আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভেসে গিয়েছে গ্রেটা। এইতো সদ্য পেল জার্মান গোল্ডেন ক্যামেরা অ্যাওয়ার্ড। এ বছরের ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সুইডেনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নারী হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে গ্রেটা। আর নরওয়ের তিনজন সংসদ সদস্য গ্রেটার নাম সুপারিশ করেছেন শান্তির নোবেলের জন্য। অ্যাসপারজার সিন্ড্রোম, অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপার অ্যাক্টিভিটি ডিসঅর্ডার, অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার, সিলেক্টিভ মিউটিজম্-এর মত অসুখে আক্রান্ত ষোল বয়সি একটা মেয়ের এই বিশ্বজয়ের রহস্য কিন্তু সহজ নয়।
গ্রেটার প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে এ গ্রহের কোনায় কোনায়। এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে। ব্রিটেন, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি, আয়ার্ল্যান্ড, উগান্ডা, থাইল্যান্ড, কলম্বিয়া, পোল্যান্ড। দাবিটা সহজ। এ বিশ্বকে নবজাতকের বাসযোগ্য করতেই হবে। দরকার হলে আইন বদলে। নিশ্চিন্ত থাকলে চলবে না। ‘ভয়’ পেতেই হবে। মর্ত্যলোকে মহাকালের নতুন খাতার পাতাজুড়ে একটা শূন্য নামার ‘ভয়’। সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে নড়েচড়ে বসতে বাধ্য করাটাই উদ্দেশ্য। প্রয়োজনে পরিবেশ এবং জলবায়ুর জন্যে করতে হবে আরও কঠিন আইন। মার্চের ১৫ তারিখ ১১২টা দেশের হাজার হাজার স্কুল ছাত্র একসাথে স্ট্রাইক করল। পৃথিবীর ইতিহাসে পরিবেশের জন্য বৃহত্তম প্রতিবাদ। আর এসবের পিছনে ১৬ বছরের এক সুইডিশ মেয়ে। গ্রেটা।
গ্রেটার আন্দোলনের কিছু ফল দেখা যাচ্ছে এখনই। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জাঁ-ক্লডে জানকার ইতিমধ্যেই জলবায়ু নিয়ন্ত্রণে এক লক্ষ কোটি ইউরো খরচের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন ২০২১-২৭ সময়সীমায়। সুইডিশ সংসদের বাইরে গ্রেটার ফি শুক্রবারের স্ট্রাইক কিন্তু চলছেই। দেশে দেশে এই স্ট্রাইকে অবশ্যই খানিকটা ভিন্ন ভিন্ন দাবি-দাওয়া যোগ হয়েছে। কিছু প্রতিবাদী যেমন ইতিমধ্যেই দাবি তুলেছে ভোট দেবার বয়সসীমা কমানোর, যাতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আরও বেশি করে সক্রিয় হতে পারে ছাত্ররা, খানিক কম বয়স থেকেই।
অবশ্য সবাই যে এই শুক্রবারের স্টাইকটাকে খুব ভালো চোখে দেখছে তেমনটাও নয়। যেমন সুইডেনের এক স্কুল তার ছাত্রদের পরিবেশের জন্যে স্ট্রাইক করতে দিতে নারাজ। তাই চাকরি ছেড়েছেন মনিকা নামে এক শিক্ষিকা। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টেরিজা মে-র অফিস ছাত্রদের স্কুল কেটে বেরিয়ে যাওয়াটাকে বর্ণনা করল ‘পড়ার সময় নষ্ট’ হিসেবে। আর গ্রেটা সঙ্গে সঙ্গেই ট্যুইট করল, “কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা তাদের নির্লিপ্ততায় নষ্ট করেছে ৩০ বছর। এটা তার থেকে কিছুটা কম খারাপ।’’ অস্ট্রেলিয়ার এক শিক্ষামন্ত্রী ১৫ মার্চের স্ট্রাইক করা ছাত্রদের শাস্তি দেবার হুমকি দিয়েছেন। এমন চিন্তাধারা আছে আরও অনেকেরই।
আমার মেয়ে মোটামুটি গ্রেটার বয়সি। তাই খুব উৎসাহ নিয়েও ওকে বলছিলাম গ্রেটার গল্প। অ্যাসপারজার-আক্রান্ত, অর্থাৎ সামাজিক সংযোগ স্থাপনেই যার সমস্যা—তেমন একটা লাজুক, অবসাদে ভোগা ওর বয়সি মেয়ে গোটা পৃথিবীর সাথেই সংযোগ স্থাপন করে ফেলেছে কোন এক জাদুমন্ত্রে! দেখা গেল, এই ইস্কুল স্ট্রাইক করার বিষয়টায় আমার মেয়ের কিন্তু বড্ড অস্বস্তি। আন্দোলন বা প্রতিবাদটা কি অন্যভাবে করা যায় না? জিজ্ঞেস করেই ফেলল, “আচ্ছা, শুক্রবারে কি ওর ইস্কুলে কোনও কঠিন বিষয়ের হোমওয়ার্ক থাকে?” জানি না আমিও। তবে নজর কাড়তে হলে বোধহয় সিস্টেমে কোনও ভাবে আঘাত করতে হয়। মেয়েকে নিয়ে আবার একদিন বসতে হবে। শুনতে হবে ওর যুক্তিও। তবে, সব রকমের স্কুল পালানো নিশ্চয়ই এক নয়। বলতে হবে সেটাও। আবার অরাজনৈতিক স্ট্রাইক করাটাও খুব সহজ নিশ্চয়ই নয়। আর একা একা স্ট্রাইক শুরু করাটাতো ভয়ানক কঠিন আর অবাস্তব বলেই মনে হয়। তবু, একটা ষোল বছরের অবসাদে ভোগা মেয়েও তেমনটা করে দেখাতে পারে বইকি! আর ক্রমে তার সঙ্গী হয় হাজার হাজার ছাত্র। পৃথিবীজুড়ে। তাই ইস্কুল পালিয়ে কেউ টম সয়্যার হয়, কেউ বা ‘মালগুডি ডেজ’-এর স্বামীনাথন হয়। কেউ হয় গ্রেটা থানবার্গ। তবু, কলেজে পড়া ছেড়ে দিলেই তো আর বিল গেটস্ হওয়া যায় না। তেমনি কিন্তু ইস্কুল কেটে গ্রেটা থানবার্গ হওয়াটাও সহজ নয়।
নোবেলটা পেয়ে গেলে গ্রেটাই হবে বিশ্বের সবচেয়ে কম বয়সি শান্তির নোবেল বিজেতা। মালালার রেকর্ড ভেঙে। সেটা হোক আর নাই হোক, গ্রেটার স্কুল স্ট্রাইক কিন্তু লজ্জায় ফেলে দিয়েছে পৃথিবীকে। নির্লিপ্ত জনতাকে, রাজনীতিকদের। আমাদেরও। দেশে দেশে। আমরা যারা জড়তার শীতঘুমে থেকে সৌরমণ্ডলের তৃতীয় গ্রহটার পরিবেশ, আবহাওয়া আর জলবায়ুকে এক আসন্ন সর্বনাশের সামনে এনে ফেলেছি। আর তাই আশ্চর্য মেয়ে সংকলিতাই আজ দিশারি হয়েছে উদ্ভ্রান্ত বিভ্রান্ত বিশ্ব-জনতার।
ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট, কলকাতার রাশিবিজ্ঞানের অধ্যাপক। মতামত ব্যক্তিগত
06th April, 2019