বাধা ও অসফলতার জন্য চিন্তা। মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে কোনও ভালো যোগাযোগ পেতে পারেন। ... বিশদ
আমাদের গণতন্ত্র সমাজের একেবারে প্রান্তবাসী মানুষের সঙ্গে নেতা-মন্ত্রী-ভোটপ্রার্থীদের কথা বলার সুযোগ করে দেয়। সম্ভব-অসম্ভব নানারকম প্রতিশ্রুতি নিয়ে তাঁরা ভোটের আগে আপনার আমার দরজায় এসে দাঁড়ান। দেশের কোনও উপকার হোক না হোক, এও তো কিছু কম কথা নয়! কিন্তু এই কথাবার্তাতেও তো পরিবেশের কোনও জায়গা থাকে না। বিরোধীদের অকর্মণ্যতা, প্রার্থীর যোগ্যতা, বংশমর্যাদা, নানারকম অবিশ্বাস্য প্রতিশ্রুতি, নির্বাচনী সন্ত্রাস, দুর্নীতি ইত্যাদি নানা হাতে-গরম প্রসঙ্গের ভিড়ে পরিবেশের কথা ওঠার কোনও অবকাশই থাকে না। সেকথা না বলেন প্রার্থী ও নেতারা, না বলি আমরা। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, কর্ম সঙ্কোচন, বেকারি, উন্নয়ন, কর্মসংস্থান, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য, সন্ত্রাস, দুর্নীতি সব বিষয় নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলব আমরা, বক্তৃতা দেবেন নেতারা, কিন্তু যে বিষয়টির সঙ্গে উপরোক্ত প্রতিটি বিষয়ের পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে তা নিয়ে একটি কথাও হবে না। কেউ বলবে না, আমাদের এলাকার নদীটির গতিপথ রুদ্ধ হচ্ছে কেন; কেন খনি মালিকরা পাহাড় আর টিলাগুলিকে অদৃশ্য করে দিচ্ছেন; কেন সাফ হয়ে যাচ্ছে জঙ্গল; কেন বেআইনি পাম্পসেট টেনে নিচ্ছে ভূগর্ভের জল সেসব কথা। অথচ এসবই আমরা বলব বলে ভেবে রেখেছিলাম, কিন্তু শেষমেশ আমরা আর বলে উঠতে পারি না। আমাদের বলার পরিসরই থাকে না!
ভোটের সময় নেতারা মানুষকে বলেন দেশের একেবারে নিচুতলার মানুষদের মধ্যে তাঁরা সবচেয়ে বেশি সুবিধা কীভাবে পৌঁছে দেবেন। কিন্তু নিজের দেশের জল, মাটি, অরণ্য, নদী, পাহাড়, প্রান্তর, সমুদ্র কোনও কিছুর অধিকার থেকে সাধারণ মানুষকে কীভাবে বঞ্চিত করা হচ্ছে, সরকার ও বিরোধী কোনও দলের বক্তব্যেই তার কোনও উল্লেখ থাকে না। দেশের উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম—এক শ্রেণীর নেতা, বহুজাতিক সংস্থা এবং মাফিয়াদের মসৃণ অপারেশনে আমাদের চোখের সামনে জল-মাটি-অরণ্য-বালি-খনিজ সম্পদ-নদী অবাধে লুট হয়ে যাচ্ছে। ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, বিহার, ওড়িশা সর্বত্র চলছে অবাধে পরিবেশ লুণ্ঠন। এখন সবারই তা গা-সওয়া হয়ে গেছে। এটা মানতেই হবে, বাংলায় এই লুণ্ঠনের চেহারা তেমন ব্যাপক নয়। তবে স্থানীয় প্রশাসন ও এক শ্রেণীর নেতাকে ম্যানেজ করে এখানেও চলছে মাটি কাটা, নদী থেকে বালি তোলা এবং চোরাগোপ্তা বন্যপ্রাণ হত্যা, অরণ্য বিনাশ ও বনসম্পদ লুণ্ঠনের কাজ এবং এটা বাড়ছে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর হুঁশিয়ারিতে সময় সময় কমলেও, আবার তা মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
এবারের ভোটে সব রাজনৈতিক দলেরই মনোযোগের কেন্দ্রে রয়েছে কৃষক সম্প্রদায়। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে তারা শাসকদের নজরের বাইরে চলে গিয়েছিলেন। একদিকে ভোটের মুখে সব দলই রং-বেরঙের কৃষক বান্ধব প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। বলা হচ্ছে, সহজ শর্তে কৃষিঋণ, চাষের জন্য উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক, ব্যবস্থা করার কথা। অন্যদিকে বহুজাতিক সংস্থা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীদের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে চাষবাস গোল্লায় পাঠানোর রাস্তায়। কিন্তু পরিবেশকে ধ্বংস করে যে কোনও উন্নয়ন হয় না এবং হলেও তা টিকিয়ে রাখা যায় না সেকথা কেউ বলেন না। কেউ বলেন না চাষ করার জন্য ভূগর্ভ থেকে জল না পাওয়া গেলে, কীটনাশক ব্যবহারে জমির উর্বরতা ধ্বংস হলে চাষ কীভাবে হবে? বনবাসী মানুষদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে অরণ্যের অধিকার, ব্যাপক বন বিনাশে এখন তারা নিজভূমে পরবাসী। নদী ধ্বংস হওয়ার ফলে বিপন্ন মৎস্যজীবী মানুষ, পরিবেশ, বায়ু ও জলদূষণ বাড়াচ্ছে পেশাগত অসুখ, কমছে কর্মদক্ষতা। বুকের ভেতরে অজস্র ক্ষোভ নিয়ে মানুষ দিন কাটালেও তা ভোটের বাক্সে প্রতিফলিত হয় না। কারণ পরিকল্পিত উপায়েই পরিবেশকে ইলেকশন অ্যাজেন্ডার মূল বিষয় হিসেবে আনা হয় না। হলে অনেক হিসেব উল্টে যেত। রাম রাজ্য প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, জয় শ্রীরাম ধ্বনি তুলে যাঁরা ক্ষমতায় এলেন, তাঁরাও কি তাঁদের কথা রাখলেন? তাঁদের আমলেই দেশে পরিবেশ উদ্বাস্তুর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করতে বেনারসে গঙ্গাস্তোত্র পাঠ করে নমামি গঙ্গে প্রকল্প শুরু করেছিলেন দেশের প্রধানমন্ত্রী। প্রায় কোটি কোটি টাকা খরচ করেও গঙ্গার হাল ফেরেনি। দূষণমুক্ত গঙ্গা দেখতে চেয়ে ১১৩ দিন অনশনের পর শহিদ হলেন অধ্যাপক জি ডি আগরওয়াল।
রামায়ণে পড়েছি, রামচন্দ্র বনবাসে যাওয়ার পর ভরত তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, যেতে যেতে তিনি দেখছেন, পথের দু’পাশে গাছ লাগানো হচ্ছে, চলছে নদী সংস্কার, খনন করা হচ্ছে গভীর হ্রদ। সেসব কাজের তদারক করছেন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীরা। এটাই তো যাকে বলে স্ট্যান্ডার্ড প্র্যাকটিস, বিধিসম্মত ব্যবস্থা। অমিত-মোদিদের রাম রাজ্যে পরিবেশ রক্ষার সাধারণ নিয়মকানুনগুলোকেই তো গোল্লায় পাঠিয়ে দেওয়া হল?