পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
সামগ্রিকভাবে বিশ্লেষণ করলে গোটা দেশজুড়েই শুধু সিপিএম নয়, মোটের ওপর অন্যান্য বামপন্থী দলগুলোর প্রভাবও ক্রমহ্রস্বমান। সিপিআইএম-এর পরে আরও অক্ষর যোগ করা অতি বামেরাও বিভিন্ন সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। বিহার, উত্তরপ্রদেশ এবং অন্যান্য রাজ্যে গত সহস্রাব্দের শেষের দিকে তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। কিন্তু আজকের দিনে ভোট শতাংশের হিসেবে তাদেরও খুঁজে পাওয়া শক্ত। সরকারিভাবে দেশজুড়ে যারা বামফ্রন্ট বলে পরিচিত, তারা এখন শুধুমাত্র কেরলে ক্ষমতায় আছে। পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরায় তাদের সমর্থন আছে অবশ্যই, কিন্তু লোকসভার নিরিখে তা শুধু ভোট শতাংশে। আসনের হিসেবে তার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া শক্ত। রাজস্থান কিংবা হিমাচলপ্রদেশে সিপিএমের অস্তিত্ব থাকলেও লোকসভায় আসন দখলের তেমন গল্প নেই। বিহারে লালুর আরজেডির সঙ্গে আঁতাঁত করে বেগুসরাই থেকে কানহাইয়া কুমার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে হয়তো সিপিআই-এর সেখানে একটা আসন জুটবে। ২০০৪ লোকসভা নির্বাচনে সব মিলিয়ে ষাটোর্ধ্ব আসন পাওয়া বামফ্রন্ট এবার কেরলে ভালো ফল করে যদি কোনওক্রমে কুড়ি পেরোয় সেই সুখস্বপ্ন দেখছেন বাম সমর্থকেরা।
২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে তৃণমূলের ভোট বাড়ার কারণ তো মোটেই হঠাৎ করে বিপুল সংখ্যক নতুন মানুষ জন্মানোর জন্যে নয়। মূল বিষয় হল অনেক বাম সমর্থক ঘুরে গিয়েছিলেন তৃণমূলের দিকে। তারপর থেকে তৃণমূলের ভোট বেড়েই চলেছে, অল্প হলেও বাড়ছে বিজেপির ভোটও। আর রক্তক্ষরণ অব্যাহত বাম দলগুলোর। অর্থাৎ ভোট যাঁরা করাতে পারেন তাঁরা ‘সিপিয়েম’ ছেড়ে যাওয়ার পর এখনও ‘সিপিএমে’ ফিরে আসেননি। রয়ে গেছেন তৃণমূলে অথবা সেখান থেকে পা বাড়াচ্ছেন বিজেপিতে। তবে আসন না থাকলেও মানুষের সমর্থনের নিরিখে বর্তমানে বামেদের উপস্থিতি ততটা খারাপ নয়। উদাহরণস্বরূপ দেশজোড়া কৃষক মিছিলের সংগঠনে বাম নেতৃত্ব ঘাম ঝরাচ্ছেন। তবে যিনি চাষ করেন সব ফসল তো তার ঘরে যায় না। সেই নিয়মেই অসংখ্য মানুষের বহুপথ হাঁটা মিছিলের শেষে মঞ্চাসীন রাহুল গান্ধী দেশজুড়ে আসন বাড়াচ্ছেন কংগ্রেসের। এবারের লোকসভা নির্বাচনেও হয়তো বামেদের ভোটে ভর করে পশ্চিমবঙ্গে কিছু আসন জুটিয়ে ফেলত কংগ্রেস, যদিও আপাতত তারা একা লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে জোটের জট কাটলে আবার হয়তো মত বদল হবে। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে আলাদা লড়ে বামফ্রন্ট পেয়েছিল ২৯.৭১% ভোট এবং কংগ্রেস ৯.৫৮% (যোগফল ৩৯.২৯%)। এরপর ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস একসঙ্গে লড়াই করে বামের ভোট ছিল ২৬.৩৬% আর কংগ্রেসের ১২.২৫% (যোগফল ৩৮.৬১%)। কিন্তু, তারপর থেকে বিভিন্ন উপনির্বাচন, পুরসভা এবং পঞ্চায়েতে বিপুলভাবে ভোট কমেছে এই দুই দলের। নির্বাচনী অস্বচ্ছতার অভিযোগ আমাদের রাজ্যে থাকলেও, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সাংগঠনিকভাবে এই দুই দলের প্রভাব ফিকে হয়েছে গত প্রায় তিন বছর ধরে। ফলে জোট হলেও এই দুই দল তাদের ভোট শতাংশ কতটা ধরে রাখতে পারবে তা নিয়ে সন্দেহ আছে।
তবে বামপন্থায় সবটুকুই তো সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোট শতাংশের হিসেবনিকেশ নয়। সেখানে রাজনীতিতে মাঝে মধ্যে নীতি থাকে। দুর্ভাগ্যবশত নব্বইয়ের দশক থেকে বামপন্থাকে পুরোপুরি গিলে ফেলেছিল পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন বামফ্রন্ট। ২০১১-তে তারা ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়ার পরে অবশ্যই দলের মেদ ঝরেছে। ফলে আজকের দিনে আবার বামপন্থায় ফেরার চেষ্টা করছে বাম দলগুলো। সেই কারণেই ফেব্রুয়ারির তিন তারিখ সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত কলকাতার মানুষ প্রত্যক্ষ করেছেন বামপন্থীদের স্বতস্ফূর্ত জনতার ব্রিগেড। বামেদের সাম্প্রতিক সমাবেশগুলিতে আর একটি উল্লেখযোগ্য পর্যবেক্ষণ ছাত্র-যুবদের উপস্থিতি। তৃণমূল ক্ষমতায় আসার সময়ে যারা ছিল স্কুলের পড়ুয়া, তারা এখন সদ্যযুবা। এদের মধ্যে বামপন্থীরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। সংখ্যায় ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে পাল্লা না দিলেও, সরু বাঁশের মাথায় লাল নিশান জড়িয়ে পশ্চিমবঙ্গের পথেঘাটে এদের উজ্জ্বল উপস্থিতি নজর এড়াচ্ছে না। একই ধারায় গত বছরে কৃষকদের নাসিক থেকে মুম্বই দুটি এবং দিল্লিমুখী একটি মহামিছিল আর মাস দুই আগে পশ্চিমবঙ্গের বাম মনোভাবাপন্ন জনগণের (শিক্ষিত শহরতলিতে ‘পিপলস’) ব্রিগেড হয়তো সফল। কিন্তু তার মানেই নির্বাচনভিত্তিক সংসদীয় গণতন্ত্রে সফলতা নয়। সেই জায়গায় কিন্তু অনেক বেশি সংখ্যক ভোটারের মনোযোগ সাম্প্রতিক তৃণমূল আর বিজেপির নীতি বনাম দুর্নীতির (যথাক্রমে নয়, বরং দলবদলের ঠেলায় কে কোন দিকে সেটা বুঝতে জনগণ গলদঘর্ম) দ্বৈরথে। বামপন্থীদের মিছিল সেদিক থেকে ভোটারের নজর ঘোরাতে পারবে কি না তার উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের ভ্রূণে।
তবে, আজকের দিনেও সিপিএম যে পুরোপুরি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারছে না, বরং তাদের পার্টির অভ্যন্তরে বিভিন্ন তাত্ত্বিক কচকচি যে এখনও কিছুটা বজায় আছে তার প্রমাণ সদ্য প্রকাশিত প্রার্থী তালিকা। সিপিএমের খাতায় বৃহত্তর কলকাতার (দুই ২৪ পরগনার কিছু অংশ ধরে) উত্তর এবং দক্ষিণের সংসদীয় রাজনীতিতে সবথেকে জনপ্রিয় মুখ তন্ময় ভট্টাচার্য এবং সুজন চক্রবর্তীর নাম অনুপস্থিত। অনেকে যুক্তি দিচ্ছেন যে এঁরা দুজনেই বিধায়ক। কিন্তু সে যুক্তি ধোপে টিকছে না, তার কারণ রানাঘাট থেকে সিপিএম প্রার্থী হয়েছেন আর এক জনপ্রিয় বিধায়ক রমা বিশ্বাস। তৃণমূল এবং বিজেপিতে অভিনেতাদের অভিনেত্রীদের বিপুল জনঘনত্বে বাম মনোভাবাপন্ন সব্যসাচী চক্রবর্তীকে প্রার্থী হিসেবে ভেবেছিলেন অনেকে। সমর্থকদের সে আশা পূর্ণ হয়নি। রাজ্যে তৃণমূল সরকারের বিরুদ্ধে গলা তুলে কথা বলার মতো অরাজনৈতিক বিদ্বজ্জনেরাও খুব বেশি জায়গা পাননি বামেদের তালিকায়। ব্যতিক্রম অবশ্যই স্বনামধন্য চিকিৎসক রেজাউল করিম, তিনি লড়ছেন বীরভূম কেন্দ্র থেকে। সেই নিয়ে আবার গোঁসা হয়েছে কংগ্রেসের যে তাদের চিকিৎসক সংগঠনের নেতা কীভাবে বামেদের সমর্থন পেলেন! একথা সত্যি যে বামেদের তালিকায় অন্যদল থেকে জার্সি পাল্টে আসা পেশাদার মেসি-রোনাল্ডোদের মতো রাজনীতির সম্পদদের দেখা যাচ্ছে না। তবু বাম আমলে প্রত্যাখ্যাত প্রবীণ নেতাদের তুলনায় প্রার্থী তালিকায় নতুন মুখের সংখ্যা আরও কিছুটা বাড়াতে পারত সিপিএম এবং সহযোগী দলগুলি।
সোজা কথায় আরও চমকপ্রদ এবং অধিকতর জনপ্রিয় তালিকা পেশ করার সুযোগ ছিল বামপন্থীদের সামনে, কিন্তু রাজ্য বামফ্রন্ট সে সুযোগ পুরোপুরি নিতে পারেনি অথবা নিতে চায়নি। মনে রাখতে হবে যে শুধুমাত্র সিপিএমের গম্ভীর পার্টি-সদস্যরা এই নির্বাচনে মতদান করবেন না, ভোট দেবেন অনেক হুজুগে সমর্থকও। দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ নয়, আসন জিততে গেলে ভোট পেতে হবে সাধারণ মানুষদের, যাঁরা ক্রমাগত বামফ্রন্টের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে রাখছেন। এর সঙ্গে চলছে জোট নিয়ে গন্ডগোল। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হওয়া কিংবা না-হওয়া আশাভঙ্গের কারণ হবে না কি শাপে বর, সেটা বোঝা যাবে ফলপ্রকাশের পরেই। সব মিলিয়ে আসন্ন নির্বাচনে বাম নেতাদের গুরুদায়িত্ব থাকবে দেশজুড়ে সংসদীয় বামপন্থাকে বাঁচিয়ে রাখার। ১৯২০-র তাসখন্দের তাত্ত্বিক সম্মেলন নিরানব্বই বছর পর কতটা ফলিত রূপ ধরে রাখতে পারছে সে প্রমাণ দেবে এবারের ভোটফল।