কর্মে শুভ। নতুন কর্মপ্রাপ্তি বা কর্মসূত্রে দূররাজ্য বা বিদেশ গমন হতে পারে। আনন্দানুষ্ঠানে যোগদান ও ... বিশদ
রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, এসব আসলে রাজনৈতিক দুর্বলতারই একটা লক্ষণ। মমতার মাস্টারস্ট্রোক সামলাতে হিমশিম শিবিরের কৌশল মাত্র। আসলে অতীতে দেখা গেছে মমতা যাঁকেই প্রার্থী করেছেন অতি সামান্য ব্যতিক্রম বাদ দিলে তিনি জিতেই ফিরেছেন। মমতার ছোঁয়ায় অসম্ভবও অনায়াসে সম্ভব হয়েছে। ভুললে চলবে কেন, সিপিএমের সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মতো সেকালের অমন প্রভাবশালী দোর্দণ্ডপ্রতাপ প্রার্থীকে হারিয়েই জাতীয় রাজনীতিতে পাদপ্রদীপের আলোয় উঠে এসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাজনীতিতে অসম্ভব বলে যে কিছু নেই, প্রতিপক্ষ যেমনই হোন তাঁর শক্তিকে উপেক্ষা করা যে চরম নির্বুদ্ধিতা—সেটা সেদিন প্রমাণ করে দিয়েছিলেন মমতা। ২০১১ সালে মমতার একক চেষ্টায় সিপিএমের ধূলিসাৎ হওয়া—সেও তো ওই সত্যটিকেই প্রকারান্তরে প্রমাণ করেছিল। তো দলীয় প্রার্থী নির্বাচনে এহেন রাজনীতিকের দূরদর্শিতাকে মান্যতা না দিয়ে যাঁরা যা ইচ্ছে তাই বলে বেড়াচ্ছেন—তাঁদের কী-ই বা বলা যাবে? সময়ই সব বলে দেবে। এখন এটুকুই বলার যে, ওই দুই প্রার্থী সম্পর্কে যা সব বলা হচ্ছে তা বাংলার রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরোধী, বাংলার সাধারণ মানুষের না-পসন্দ। রাস্তাঘাটে কান পাতলেই সেটা মালুম হচ্ছে। অবশ্য, ভোটের সময় এমন অনেক নির্বুদ্ধিতাই দেখা যায়।
তবে, সব মিলিয়ে ভোটের হাওয়া যে গরম হচ্ছে তা বেশ বোঝা যাচ্ছে। অবশ্য, এখনও ভোটের আগের মারামারিটা শুরু হয়নি। একদম শান্তভাবেই এগচ্ছে ভোট প্রচার। প্রচারের সিংহভাগ এখন তৃণমূলের দখলে। সিপিএমের মহম্মদ সেলিমের মতো মমতা-বিরোধী শিবিরের কেউ কেউ প্রচারে নেমেছেন বটে, তবে বাম-কং সমঝোতাপন্থীরা বা গেরুয়া শিবির এখনও পুরোদমে নামেনি। নামলে যে ভোটযুদ্ধের তাপ উত্তেজনা আরও বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। কিন্তু, তার আগেই রাজ্যের জেলায় জেলায় আধা সামরিক বাহিনী নেমে ভোটের গরম হাওয়ায় তাপ বাড়ানোর নতুন মাত্রা যোগ করে দিয়েছে। কোথাও তারা রুট মার্চ করছে, কোথাও রাস্তা আটকে গাড়ি তল্লাশি করছে। সংশ্লিষ্ট এলাকার জনজীবনে এসবের কিছু প্রভাবও পড়তে শুরু করেছে। এর আগে এমন তো দেখেনি পশ্চিমবঙ্গ—ভোটের এত আগে থেকে আধা সামরিক বাহিনীর এমন টহল! সাত দফা ভোটের মতো এই আধা সামরিক তৎপরতা তাই রাজ্যের সাধারণ মানুষের মধ্যে সংশয় কৌতূহলের একটা মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা অবশ্য বিষয়টিকে গুরুত্ব দিচ্ছেন না। তবে শান্ত একটা রাজ্যে এভাবে ভোটের এত আগে আধা সামরিক বাহিনী নামিয়ে দেওয়াকে তিনি ‘রাজ্য ও রাজ্যবাসীর অপমান’ হিসেবেই দেখছেন। তাঁর ভাবনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই তৃণমূল মহিলা কংগ্রেস প্রতিবাদে ধর্নায় বসেছে। পাল্টা ধর্নায় বসেছে পদ্মবাহিনীও! ফলে, ভোটযুদ্ধের আগে রাজ্য-রাজনীতির বাজার আর এক প্রস্থ চড়েছে।
কিন্তু, কথা হল—সাত দফা ভোট এবং আধাসেনার এমন অগ্রিম তৎপরতা কেন? সাধারণ মানুষের ভোট নিরাপত্তা না কি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কোনও সতর্কবার্তা পাঠানো? এর আগে রাজ্যে লোকসভায় যেসব ভোট হয়েছে তাতে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা ছিল না বলছেন? সব ভুয়ো কারবার হয়েছে? কিছু ঘটনা নিশ্চয়ই ঘটেছে, মারামারিও হয়তো হয়েছে—কিন্তু ভোটের সময় তেমন কোথায়, কোন রাজ্যে না হয়? ভোট ছাড়াই তো গত কয়েক বছরে উত্তরপ্রদেশ সমেত দেশের উত্তর দক্ষিণের নানা রাজ্যে অজস্র মারদাঙ্গা খুনোখুনি হয়েছে, নিরীহ সাধারণ থেকে লেখক বুদ্ধিজীবীর প্রাণ গেছে! আমাদের রাজ্য সে তুলনায় তো স্বর্গই বলতে হবে। অন্তত, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ক্ষেত্রে এই বাংলায় বসে সে কথা স্বীকার করতেই হয় এবং তার জন্য যাবতীয় কৃতিত্ব যে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর প্রশাসনের তাতেই বা সন্দেহ কী? তো যিনি এতদিন ধরে এমন সংকটে বিপদে রাজ্যটাকে আগলে রাখলেন, একক চেষ্টায় উন্নয়নের এমন নজির তৈরি করলেন, মা-মাটি-মানুষের জন্য নিরাপত্তা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে অতন্দ্র অবিচল রইলেন—তিনি ভোটে মানুষকে নিরাপত্তা দিতে পারবেন না! বিরোধীরা হাজার কথা বলতেই পারেন, গোটা পশ্চিমবঙ্গকে স্পর্শকাতর ঘোষণার দাবি করতেই পারেন কিন্তু যাঁরা এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন তাঁরা বাস্তব খতিয়ে দেখবেন না! নির্বাচন কমিশন তো শুনছি পুরনো ভোটের তথ্যপরিসংখ্যান খতিয়ে দেখে বিরোধীদের, বিশেষত বিজেপি’র দাবি প্রায় খারিজই করে দিয়েছেন। তাঁদের মতে, বাড়তি নিরাপত্তার জন্য রাজ্যের সামান্য কিছু এলাকা স্পর্শকাতর চিহ্নিত করা যায়—তার বেশি নয়। তাহলে? ভোটের এত আগে থেকে আধা সামরিক বাহিনী কেন?
আমরা এক মুহূর্তের জন্যও আধা সামরিক বাহিনী মোতায়েনের বিরুদ্ধে নই। কেন্দ্র কি নির্বাচন কমিশন চাইলে আসতেই পারে বাহিনী—যখন খুশি আসতে পারে। তবে কী, আধা সামরিক বাহিনী এলাকায় টহল দিলে বা পথ আটকে গাড়ি মানুষের খানাতল্লাশি করলে যে আমজনতার স্বাভাবিক জীবন কিছুটা হলেও অস্বস্তিতে পড়ে, তা কি বলে বোঝাতে হয়। বিশেষ করে এলাকা যখন শান্ত, কোথাও ঝুটঝামেলা নেই ভোট আসছে এগিয়ে—তখন সেনা নামলে আমজনতার মনে একটা যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব এবং সেই সঙ্গে এক ধরনের আশঙ্কাও কি ঢুকে পড়ে না মানুষের মনে? সেই সঙ্গে রাজ্যের যিনি সর্বময় কর্তা, মুখ্যমন্ত্রী, যাঁর প্রশাসনিক দক্ষতায় গোটা রাজ্যে শান্তি বহাল আছে—এমন অসময়ে বাহিনী নিয়োগ কি তাঁর রাজনৈতিক সততা সদিচ্ছা প্রশাসনিক যোগ্যতার প্রতি অবিশ্বাস নয়? বিশেষত, যে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী প্রবাদপ্রতিম জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, জাতীয় রাজনীতিতে যাঁর ভূমিকা আজ অগ্রগণ্য, আসন্ন লোকসভা যুদ্ধে জাতীয় বিরোধী শিবিরের যিনি অন্যতম প্রধান মুখ এবং সত্যি বলতে কী যাঁর শাসনে এই ভোটযুদ্ধের ক্রমবর্ধমান উত্তেজনার মধ্যেও রাজ্য একেবারে শান্ত, ঝুটঝামেলাহীন—সেইখানে কেন্দ্রীয় বাহিনী! একটু অস্বাভাবিক লাগছে না?
প্রশ্নটা আমাদের নয়, রাজ্যের আম পাবলিকের। তাঁদের আরও প্রশ্ন—এভাবে আধাসেনা নামিয়ে কি ভোটযুদ্ধে মমতাকে ঘায়েল করা যাবে? আধাসেনা কি মুখ্যমন্ত্রী মমতার বিপুল উন্নয়ন, জঙ্গলমহল থেকে দার্জিলিং পাহাড় গরিবের জীবনমানের এমন অভাবনীয় উন্নতি সাম্প্রদায়িক প্রীতি রক্ষায় তাঁর অনমনীয় দৃঢ়তা অসাধারণ প্রশাসনিক দক্ষতা সব ভুলিয়ে দিতে পারবে? বিজেপি শাসনে নোটবন্দির মতো ঘটনাগুলোতে যে দুর্দশা মানুষকে ভোগ করতে হয়েছে, যে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে হয়েছে—সে সবও কি ভুলিয়ে দিতে পারবে? ভোটের এত আগে নিরাপত্তা বাহিনী নামিয়ে দেশের বাকি অংশের কাছে হয়তো রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা নিয়ে একটা নেতিবাচক বার্তা পাঠানো যেতে পারে, তবে তাতে রাজ্যের মানুষের মতি বদলাবে কি? মমতার প্রতি তাঁদের আনুগত্য ভালোবাসা কিছুমাত্র টাল খাবে কি? এসব প্রশ্নের উত্তর অবশ্য প্রশ্নকর্তা বঙ্গবাসী মাত্রেই জানেন। আসলে, ক্ষমতার আগ্রাসন কেউই পছন্দ করেন না। বাংলার মানুষ ২০১১ সালে সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন। এবার তার ব্যতিক্রম হয় কি না—বলবে ২৩ মে’র ভোটফল। তবে, এ পর্যন্ত জনমনের যা আভাস মিলছে তাতে এটুকু বলাই যায়, ভোটের এত আগে বাহিনী নামায় ভোটযুদ্ধের ময়দানে মমতার রাজনৈতিক অবস্থানই আরও জোরালো হল।