বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
বিশ্বের সবথেকে দ্রুতহারে স্মার্টফোন ক্রেতার বাড়ছে ভারতে। সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। অথচ ভারত আজও কোনও নিজস্ব স্মার্টফোনকে আন্তর্জাতিক বাজারের ব্র্যান্ডযুদ্ধে দাঁড় করাতেই পারেনি। সবথেকে টপ পাঁচটি মডেল হল স্যামসাং, হিউয়েই, অ্যাপল, জিওমি এবং অপ্পো। পাঁচের মধ্যে দুটোই চীন। ব্যবসার দিক থেকে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পাঁচটি টেলিকম কোম্পানি কী কী? একটাও ভারতের নয়। প্রথম স্থানে চায়না মোবাইল লিমিটেড, এরপর আমেরিকার ভেরিজোন কমিউনিকেশন, আমেরিকারই এটি অ্যাণ্ড টি, ব্রিটেনের ভোদাফোন এবং জাপানের নিপ্পন টেলিগ্রাফ কর্পোরেশন। গোটা দুনিয়ার সবথেকে জনপ্রিয় এবং বিক্রি হওয়া টেলিভিশন মডেল কোন কোন দেশের? দক্ষিণ কোরিয়ার স্যামসাং এক নম্বরে। এরপরের স্থানও তাদের, এল জি। তারপর জাপানের সোনি, আমেরিকার ভিজিও এবং চীনের টিসিএল। ভারত নেই।
বিশ্বের সবথেকে ব্যবহার করা ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন কোনগুলি? গুগল, বিং, ইয়াহু, আস্ক ডট কম। চীন কিন্তু আমেরিকার সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করেই না বলা যায়। তাদের নিজেদের সার্চ ইঞ্জিন বাইডু। সবথেকে ব্যবহৃত সার্চ ইঞ্জিন। আমরা সারাক্ষণ ইন্টারনেটে মুখ গুঁজে আছি। কিন্তু এখনও ভারতের একটিও নিজস্ব সার্চ ইঞ্জিন জনপ্রিয় হল না।
আমরা এত যুদ্ধ ভালোবাসি। একবার পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ পরিস্থিতি হলে প্রায় সকলেই ওয়ার স্পেশালিস্ট, আর্মি বিশেষজ্ঞ এবং দেশভক্তির যোদ্ধায় পরিণত হই, অথচ ভারত আজও নিজেদের অস্ত্রশস্ত্র নিজেরা তৈরি করার মতো জায়গায় যেতে পারল না কেন? আমরা শুধুই অস্ত্র কিনি অন্যদের থেকে। আমাদের বন্ধু ভাবে ইজরায়েল, আমেরিকা, ফ্রান্স, রাশিয়া, ব্রিটেন সকলেই। কেন? কারণ আমরা তাদের সবথেকে বড় প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের ক্রেতা। আসলে আমরা বাজার। ১৩০ কোটির কর্পোরেট বাজার। তাই আমরা বন্ধু। অস্ত্রনির্মাণে আমরা উন্নত দেশগুলিকে চ্যালেঞ্জ করতে পারছি না কেন?
এই যে কোনও আধুনিক সভ্যতার উপকরণ নির্মাণেই আমরা পশ্চিমি দেশের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছি না এটাই কি শেষ কথা? ভারত কি সত্যিই কোনও আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডিং-এই এক নম্বর নয়? এটা ভুল ধারণা। আমরা এক নম্বর স্থান পেয়েছি একটি আন্তর্জাতিক ইস্যুতে। সেটি হল ফেক নিউজ। মাইক্রোসফট সম্প্রতি একটি সমীক্ষা করে জানিয়েছে, বিশ্বের সবথেকে বেশি ফেক নিউজ প্রচারের জায়গায় পরিণত হয়েছে ভারত। গোটা বিশ্বের অ্যাভারেজ যেখানে ৫৭ শতাংশ, ভারতে সেটা ৬০ শতাংশ। সবথেকে বিপজ্জনক ট্রেণ্ড হল ভারতে ক্রমেই ফেক নিউজই রিয়াল নিউজে পরিণত হয়ে যাচ্ছে। আসন্ন লোকসভা ভোটের আগে এই প্রবণতা আরও বেড়ে চলেছে। শুধু ফেক নিউজ নয়, অনলাইনে অভদ্র ব্যবহার, যৌনতা প্ররোচনামূলক পোস্ট, ভুল তথ্য শেয়ার এবং মতের অমিল হলেই পরস্পরকে চরমভাবে গালিগালাজ করার প্রবণতা ভারতে প্রবলভাবে বেড়ে চলেছে। এই তথ্য জানা যাচ্ছে মাইক্রোসফটের ‘ডিজিটাল সিভিলিটি ইনডেক্স’ সমীক্ষায়। সেখানে অনলাইনে অভব্য আচরণের ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে মোট ২২টি দেশকে চিহ্নিত করা হয়েছে। তার মধ্যে ভারতের স্থান প্রথম সাতের মধ্যে। ভারতে সবথেকে বেশি ফেক নিউজ ছড়ানো হয় ধর্ম ও রাজনীতি নিয়ে। কেন এত বাড়ছে ফেক নিউজ? শুধুই কি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিভাজন ঘটিয়ে সেই থেকে ফায়দা লোটা? তার পাশে উল্লেখযোগ্য যে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে, তা হল ক্রমেই ফেক নিউজ একটি দুর্দান্ত লাভজনক বিজনেস মডেল হয়ে উঠেছে। নিয়মটা হল, প্রথমেই একটা ফেসবুক পেজ তৈরি করা হবে। এরপর সেই পেজ কারা কারা দেখছে সেটি ট্র্যাক করা হয়। তার জন্য থাকে প্রফেশনাল হ্যাকার। কতবার সেই পেজ খোলা হয়েছে সেটা মনিটর করা হয় এবং তারপর লাইকের সংখ্যা ধরে ধরে এগনো হয় সেটিকে গ্রুপে গ্রুপে পোস্ট করা। আমার রাজনৈতিক ও ধর্মীয় অবস্থানের সঙ্গে সাযুজ্যপূর্ণ পোস্ট দেওয়া হলে স্বাভাবিকভাবেই আমি সেগুলির প্রতি আকৃষ্ট হই বেশি বেশি। কারণ ওইসব পোস্টে যেসব তথ্য ও যুক্তি দেওয়া থাকে সেগুলিকে আমি ব্যক্তিগতভাবেও আমার বিরুদ্ধপক্ষীয়দের সঙ্গে তর্কে ব্যবহার করতে পারবো। যদিও সেই তথ্যগুলির সিংহভাগ মিথ্যা। আমাদের কাছে তর্কযুদ্ধে জয়টাই বেশি জরুরি। সত্যমিথ্যার বিচার নয়। ফলো করতে থাকি। লাইক করতে থাকি। এভাবে যখন এরকম ফেসবুক পেজগুলির লাইক ও ফলো করার সংখ্যা কয়েক লক্ষ পেরিয়ে যায়, তখনই দেখা যায় বিজ্ঞাপন বাড়ছে। এভাবে পেজটি একটি লাভজনক ব্যবসায় পরিণত হয়। আর তারপর সেই পেজটি বিক্রি করার ডিল শুরু হয়ে যায়। ওই পেজ কাজে লাগবে এরকম রাজনৈতিক, ধর্মীয়, সামাজিক সংগঠনের সোশ্যাল মিডিয়া উইং ওইসব পেজ কিনে নেয় বিপুল টাকা দিয়ে। এমনকী সাধারণ ব্যবসায়ীও সেই পেজ বেশি দামে কিনে তারপর নিজের মতো আরও অন্য কনটেন্ট দিয়ে আরও ব্যবসা বাড়ানোর জন্য নতুন স্পনসর খুঁজে নেয়।
বেশ কিছু ফেক নিউজের মধ্যেই দেখা যায় কয়েকটি শব্দ হাইলাইট করা কিংবা তার নীচে লেখা থাকবে রিলেটেড নিউজ। সেখানে ক্লিক করলে একটা ওয়েবসাইট বেরিয়ে আসবে। আমরা সরল মনে ভাবছি ওই ওয়েবসাইট হল ওই পোস্টে লেখা যুক্তির সপক্ষে সোর্স বা প্রমাণ। কিন্তু আমরা জানতেই পারি না ওই বিশেষ ফেসবুক পেজ যারা চালাচ্ছে তারাই সেই ওয়েবসাইট খুলেছে। এর ফলে যারাই ওই পেজ পড়ছে, তারা আবার ক্লিক করে এই ওয়েবসাইটেও চলে যাচ্ছে আরও তথ্যের আশায়। এভাবে ভিউয়ারশিপ বেড়ে চলে এবং বিজ্ঞাপনও দ্বিগুণ হয়ে যায়। সেই কারণেই যতটা বিশ্বাসযোগ্যভাবে কোনও মিথ্যা খবর ও ভিডিও লেখা ও তৈরি করা হবে ততই সেটির বিজনেস বাড়ছে। তাই বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সংগঠনে রিসার্চ করা ও পোস্ট লেখার জন্য যাদের রিক্রুট করা হয় তাদের প্রতি পোস্ট পিছু যথেষ্ট মোটা টাকা দেওয়া হয়। অথবা মাসিক স্যালারির ব্যবস্থা। সেটা কখনও সখনও ৫০ হাজার টাকাও ছাপিয়ে যায়। আর কনটেন্ট ডিরেক্টর বেতন পায় এক লক্ষ টাকার বেশি। ফেক নিউজ নিছক রাজনৈতিক দল, ধর্মীয় সংগঠনগুলিকে লাভ দেয় তাই নয়, এটা সবটাই একটা ইন্ডাস্ট্রি। আমরা বোকার মতো আমাদের প্রিয় দলের হয়ে অনলাইনে অবিরত যুদ্ধ করি, একে অন্যকে গালিগালাজ করি, ফেক নিউজ শেয়ার করি। আমাদের আর্থিক, সামাজিক লাভ হয় না কিছু। সাময়িক আত্মতৃপ্তি পাই যে ‘কেমন দিলাম’! কিন্তু আদতে আমাদের ব্যবহার করেই কোটি কোটি টাকা ব্যবসার লেনদেন হয়ে চলেছে। সে কোটি টাকার বিজনেস মডেলের সূত্রপাত নিছক একটি গ্রুপ অথবা পেজ স্টার্ট করে। নো ইনভেস্টমেন্ট।
অনলাইনে দুরকম মিডিয়া আছে। একটি সরকারের কাছে রেজিস্টার করা মিডিয়া সংস্থা। তাদের মালিক, লগ্নি, শেয়ার, রেজিস্ট্রেশন নম্বর সবই সরকারের কাছে আছে। পাশাপাশি দ্রুত বিশ্বজুড়ে আর একটি সংস্থা তৈরি হচ্ছে, তার নাম কনটেন্ট কোম্পানি। স্বচ্ছ কনটেন্ট কোম্পানির পাশাপাশি ক্রমেই বাড়ছে ফেক নিউজের কোম্পানিও। এই সংস্থাগুলির হয়ে লেখার জন্য কনটেন্ট রাইটার, এডিটর আর গ্রাফিক্স আর্টিস্ট রিক্রুট করা হয়। তাদের কাজ হল, যে দল বা সংগঠনের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট হয়েছে, তাদের সুবিধামতো ১) বিভিন্ন অতীত ইতিহাসকে ভুল তথ্য সহযোগে পোস্ট করা ২) বর্তমান ঘটনার সঙ্গে ফোটোশপ করা ছবি দিয়ে একটা নিউজের মতো দেখতে আইটেম বানানো আর ৩) এডিটিং করে ভিডিও শেয়ার করা। উদাহরণ হিসেবে যেমন ধরা যাক, একটি রাজনৈতিক সমাবেশে একজন নেতা বা নেত্রী তাঁর প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বললেন, ‘ওই দলটি যদি ক্ষমতায় আসে, তাহলে কিন্তু ভারতের পক্ষে সেটা হবে চরম বিপজ্জনক। ভারতের ভালোর জন্যই তাই ওই দলকে ভোট দেবেন না। ’এবার ঠিক এই বক্তৃতার ক্লিপিংস নিয়ে ফেক নিউজ ফ্যাক্টরিতে শুরু হয় এডিটিং। সূক্ষ্ম কাজ। বেছে বেছে যেখানে ‘ভারতের’ শব্দটি বলা হয়েছে, সেখানেই ওই বক্তার গলাটি নকল করে এডিটেড ভার্সানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় নতুন শব্দ। ‘পাকিস্তানের’। তৎক্ষণাৎ বাক্যটি কী দাঁড়াল? ‘ওই দল যদি ক্ষমতায় আসে তাহলে কিন্তু ‘পাকিস্তানের’ পক্ষে সেটা হবে চরম বিপজ্জনক। তাই ‘পাকিস্তানের’ ভালোর জন্য ওই দলকে ভোট দেবেন না।’ ব্যস! এবার এটা শেয়ার করা শুরু হল। ওই নেতানেত্রীর বিরোধীরা তো বটেই, তাঁদের সমর্থকরাও ভাবতে শুরু করলেন এরকম কথা বলা ঠিক হয়নি। এটা তো পাকিস্তানের হয়ে কথা বলা! এভাবেই সার্কুলেট হতে থাকে ফেক নিউজ। এই যে কনটেন্ট কোম্পানি এগুলির কোনও সরকারি রেগুলেশন নেই। ভারতে রেজিস্টার্ড মিডিয়ায় সরাসরি এখনও বিদেশি কোনও মিডিয়া সংস্থা আসেনি। শেয়ার রয়েছে। পরিচালনায় নেই। কিন্তু সেই নিয়ন্ত্রণ কনটেন্ট মার্কেটিংয়ে নেই। এটা একাটা গ্লোবাল প্ল্যাটফর্ম। তাই বিদেশি অজানা সংস্থাও লগ্নিতে ঢুকে পড়েছে।
হোয়াটস অ্যাপের প্রতিটি অ্যাকাউন্টের অ্যাক্টিভেশনের সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল নম্বর, আইপি অ্যাড্রেস আর কেরিয়ার ইনফরমেশন মাদার সার্ভারে চলে যায়। এমনকী কে টাইপ করছে সেটাও জানা সম্ভব। কিন্তু কী টাইপ করছে সেটা হোয়াটস অ্যাপ জানতে পারে না (অন্তত তারা সেরকমই দাবি করে)। হোয়াটস অ্যাপ কর্তৃপক্ষ বলে, এটা এন্ড টু এন্ড এনক্রিপশনের প্রাইভেসি। কিন্তু একটি মেসেজ পাঁচটির বেশি শেয়ার করা যাবে না। ফেক নিউজ যারা ছড়ায় তারা সেই কারণে একসঙ্গে বহু মোবাইল থেকে বাল্ক গ্রুপ তৈরি করে। আর সেভাবে প্রতিটি গ্রুপে পাঁচটি করে ফেক নিউজ পোস্ট করে মাল্টিপল শেয়ার করে দেওয়া শুরু হয়। ফেক নিউজ শেয়ারকারীরা জেনে যায় আমাদের কারা কারা সেই পোস্ট রিপোস্ট অথবা রিশেয়ার করেছি। তারা এরপর আমাদের টার্গেট করে রোজই কিছু না কিছু শেয়ার করতে থাকে। সেসব আমাদের পছন্দসই সাবজেক্ট হওয়ায় আমরাও শেয়ার করতে থাকি। সত্যকে আমরা চ্যালেঞ্জ করে বলি, তুমি মিথ্যে। মিথ্যেকে আমরা সাদরে বরণ করে বলি, তুমিই সত্য!
এভাবে ক্রমেই হারিয়ে যায় আসল নিউজ। আসল ইতিহাস। আসল সত্য। একটি সমাজ ক্রমেই বিশ্বাস করতে শুরু করে, তার যেটা পছন্দ সেটাই সত্য! তার যেটা অপছন্দ সেটাই মিথ্যা। আর তাই নতুন যুগের নতুন ধ্রুবপদ—মিথ্যাই সত্য!