বিদ্যায় অধিক পরিশ্রম করতে হবে। ব্যবসায় যুক্ত ব্যক্তির পক্ষে দিনটি শুভ। প্রেম-প্রীতিতে আগ্রহ বাড়বে। নতুন ... বিশদ
লন্ডনের বেথনেল গ্রিন অ্যাকাডেমি স্কুলের পড়ুয়া ছিল শামিমা। তার বাবা বর্তমানে বাংলাদেশে থাকেন। তার মায়ের মতো তার বাবার জন্মও বাংলাদেশে। ইসলামিক স্টেট জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগ দিতে মাত্র ১৫ বছর বয়সে ২০১৫ সালে ব্রিটেন থেকে তুরস্ক হয়ে সিরিয়া পালিয়ে গিয়েছিল শামিমা। সঙ্গে ছিল স্কুলের দুই বন্ধু আমিরা আবাসে ও খাদিজা সুলতানা সহ ৮ জন। রাকায় পৌঁছনোর ১০ দিনের মধ্যে ইয়াগো রিদিজেক নামে নেদারল্যান্ডসের বছর সাতাশের এক তরুণকে বিয়ে করে শামিমা। পরে তার স্বামী সিরীয় সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এরপর বাঘুজ থেকে পালিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয় তারা। দু’'টি সন্তান হয়েছিল তাঁদের। কিন্তু অপুষ্টি ও অযত্নে দু’জনের কেউই বাঁচেনি। সম্প্রতি সিরিয়ার শরণার্থী শিবিরে আরও একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দিয়েছেন শামিমা। নাম রেখেছেন জেরাহ। আর সেই নবজাতকের সুরক্ষা-স্বার্থের কথা ভেবেই ব্রিটেনে ফিরতে চান তিনি।
কিন্তু বাঁধ সেধেছে ব্রিটিশ প্রশাসন। চলতি বছরের ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯ বছর বয়সি শামিমার নাগরিকত্বই তারা বাতিল করে দিয়েছে। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, ‘কেউ যদি বিদেশের মাটিতে সন্ত্রাসবাদী সংগঠনকে সমর্থন করতে চায়, তা হলে তার দেশে ফেরা আটকাতে আমরা বদ্ধপরিকর। একটি নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গিগোষ্ঠীতে যোগদানকারী কোনও ব্রিটিশ নাগরিককে সাহায্য করতে গিয়ে আমরা অন্য কাউকে বিপদে ফেলব না।’
ব্রিটেনের চলতি অভিবাসী আইন অনুসারে, বাংলাদেশি ব্রিটিশ দম্পতির যদি অন্য কোনও দেশের নাগরিকত্বও থাকে, তাও তাঁদের সন্তান দ্বৈত নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী ২১ বছর বয়স পর্যন্ত। অর্থাৎ, ২১ বছর হয়ে যাওয়ার পর শামিমা তার স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাওয়া বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখা না রাখার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবে।
এই সুযোগটাই হয়তো নিতে গিয়েছে টেরিজা মে প্রশাসন। শামিমার বাংলাদেশি নাগরিকত্ব আছে, এই অছিলায় তার নাগরিকত্ব বাতিল করে দেওয়া হয়। ঠিক তার পরদিন অর্থাৎ, ২০ ফেব্রুয়ারি এক সাক্ষাৎকারে সাজিদ জাভিদ বলেন, ‘ব্রিটেন তার নাগরিকত্ব কেড়ে নিলেও সে রাষ্ট্রহীন হয়ে পড়বে না।’ ব্রিটেনের আইনে বলা আছে, সরকার মনে করলে ঝুঁকিপূর্ণ যে কারওর নাগরিকত্ব বাতিল করতে পারে। কিন্তু এ কাজ তখনই করা যায়, যখন তার অন্য কোনও দেশের নাগরিকত্ব থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের বিদেশ প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম টুইট করে পরিষ্কার জানিয়ে দেন, ‘আইএসে যোগ দেওয়া শামিমা বেগম বাংলাদেশের নাগরিক নয়। ভুল তথ্যের উপর ভিত্তি করে তাকে বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত করার বিষয়টি গভীর উদ্বেগজনক। জন্মসূত্রে সে ব্রিটেনের নাগরিক। দ্বৈত নাগরিকত্ব পাওয়ার বিষয়ে সে কখনও বাংলাদেশের কাছে আবেদন করেনি। এমনকী তার বাবা-মায়ের জন্মস্থান হলেও, শামিমা আগে কখনও বাংলাদেশে আসেনি। সুতরাং তাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই আসে না।’
বাংলাদেশি নয়, শামিমা কিন্তু মনেপ্রাণে ব্রিটিশ। জেরাহকেও বড় করতে চান ব্রিটিশ মূল্যবোধ অনুযায়ী। তাঁর বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদে মদত দেওয়ার যে অভিযোগ তুলেছে ব্রিটিশ প্রশাসন, তার উত্তরে শামিমার জবাব, ‘আমি সেখানে গেলাম, একজন গৃহবধূ হিসেবে বাড়িতে বসে রইলাম, তারা আমার যত্ন নিল—এগুলো আসলে ঠিক তাদের সাহায্য করা নয়। আমি তাদের বুলেটের খরচ জোগাইনি, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যও আমি কোনও পয়সা দিইনি। কিন্তু তাও যদি মনে করা হয় আমি অন্যায় করেছি, ক্ষমা চাইছি ব্রিটেনের কাছে। আমার ছেলেকে আমি বড় করতে চাই, তাকে কোরান পড়াতে চাই। তাকে নামাজ শিক্ষা দিতে চাই। কিন্তু জেহাদ... আমি ঠিক জানি না।’
ব্রিটেনে বসবাসকারী অধিকাংশ বাংলাদেশিই কঠিন পরিশ্রমী। সাধারণ মানুষ যেমন আছেন তেমনই টিউলিপ সিদ্দিকি, রুশানারা আলি, রূপা হকের মতো হাউস অব কমন্সের প্রভাবশালী সদস্যরাও রয়েছেন সেখানে। অর্থাৎ, শুধুমাত্র ব্রিটিশ অর্থনীতি নয়, ব্রিটেনের রাজনৈতিক আঙিনাতেও বাংলাদেশিদের অবদান খুব গুরুত্বপূর্ণ। তবুও শরণার্থীদের সঙ্গে ব্রিটেনের সম্পর্ক বেশ জটিল। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ নিজেও একজন শরণার্থী। তাঁর বাবা-মা দু’জনেই পাকিস্তানি। তাই ব্রিটিশ হওয়ার প্রমাণ আজও ব্রিটেনকে দিতে হচ্ছে তাঁকে। এই লড়াইয়ের ফল হচ্ছে হয় নিজের সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াও নয়তো নিজের দেশের বিরুদ্ধে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ আর আইএসে যোগ দেওয়া শামিমা বেগম—নিজস্ব ভাবাবেগের বিরুদ্ধে দুই এশীয় শরণার্থীর এহেন লড়াই ব্রিটেনের পক্ষে লজ্জার বইকি!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউরোপের দেশগুলিকে অনুরোধ করেছেন তাদের আইএস জঙ্গিদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। কারণ, তাঁরা অধিকাংশ মৌলবাদ বা বিচ্ছিন্নতাবাদের সংস্পর্শে এসেছেন ইউরোপে। ব্রিটেনের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকই জানিয়েছে, ৯০০-র বেশি ব্রিটিশ নাগরিক ইরাক-সিরিয়ায় আইএসে যোগ দিয়েছিলেন। তবে তাঁদের মধ্যে কমবেশি ৪০০ জন ব্রিটেনে ফেরত এসেছেন। তাহলে শুধুমাত্র ব্রিটিশ-পাকিস্তানি কিংবা ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া বর্ণবৈষম্যেরই নামান্তর নয় কি! কই, জঙ্গিবাদে নাম লেখানো কোনও ব্রিটিশ- আমেরিকান, ব্রিটিশ -ইউরোপিয়ান কিংবা ব্রিটিশ -অস্ট্রেলিয়ানের ক্ষেত্রে তো নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার এমন তৎপরতা তো দেখা যায় না! আর শামিমার স্বামী যেখানে তাঁকে নেদারল্যান্ডসের নগারিকত্ব পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে তৎপরতা শুরু করেছে, সেখানে ব্রিটেনের হাত গুটিয়ে বসে থাকাটা দৃষ্টিকটূই বটে।
শর্মিমা বেগম নামে এক মহিলার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ঘর ছেড়েছিল শামিমা। বলা হয়, শর্মিমা কিন্তু মৌলবাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন পূর্ব লন্ডনের এক মসজিদে। তাঁর মতো আরও হাজার হাজার
যাঁরা মৌলবাদের সংস্পর্শে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে অধিকাংশই রক্ষণশীল পরিবারের। তাঁরা
কিন্তু জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়েননি। বরং বলা যেতে পারে, তাঁরা বেশ ভালোই আছেন। রাষ্ট্রও সেটা জানে। কিন্তু তারপরও শামিমাদের বিরুদ্ধে এই অবস্থান কেন?
আসলে নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাইছে মে প্রশাসন। উল্টে দোষ চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সেইসব পরিবারের উপর, তাঁদের মতাদর্শের উপর, তাদের সংস্কৃতির উপর। কারণ, রাষ্ট্রযন্ত্র ভুল করছে কি না, তা খতিয়ে দেখার চেয়ে অন্য কারও ঘাড়ে বন্দুক রাখাটা সহজ।
আন্তর্জাতিক আইনের আওতায় যে কোনও ব্রিটিশ নাগরিককে ব্রিটেন দেশে ফিরতে দিতে বাধ্য, যদি না তিনি অন্য দেশের নাগরিকত্ব দাবি করেন। আসলে সাম্যবাদ, মানবিকতা—এগুলোও ব্রিটিশ সংস্কৃতির অঙ্গ! সেই খাতিরে অন্তত শামিমাকে ঘরে ফেরানোর কথা হয়তো ভাবতে বাধ্য হবে ব্রিটেন। কারণ, নিজস্ব নাগরিকদের নাগরিকত্ব বাতিল করে দেওয়ার অর্থ তাঁদের স্বাধীনতার অধিকারকেই লঙ্ঘন করা।