গৃহে শুভকর্মের প্রস্তুতি ও ব্যস্ততা। হস্তশিল্পীদের নৈপুণ্য ও প্রতিভার বিকাশে আয় বৃদ্ধি। বিদ্যায় উন্নতি। ... বিশদ
বস্তুত এইরকম বিশ্বমানের নেতাদের ক্রোধ হয়, তখন সেই ক্রোধ যদি নৈতিক দিক থেকে ভুল হয় তাহলে সেটাকে রাজনীতির আচ্ছন্নতায় যুদ্ধ কিংবা যুদ্ধ-পরিস্থিতির দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়াটা কিন্তু রাজনৈতিক ভুল বলেই গণ্য হবে। এমনকী এখানে দেশাত্মবোধের আবেশ তৈরি করাটাও অস্থানে প্রযুক্ত এক ব্যাপ্ত হৃদয়াবেগ, যা রাজনৈতিকভাবে প্রণোদিত বলে গণ্য হতে পারে—পুরাকালে আমাদের প্রাচীন রাজারা, বিশেষত ক্ষত্রিয় জাতিটাই তৈরি হয়েছিল এই মানসিকতায়, যেখানে রাজ্যরক্ষা, প্রজাপালনের মতো উদার ক্ষত্রিয়বৃত্তি অতিক্রান্ত হতো আগ্রাসনের প্রয়োজনে। শৈশবকাল থেকে ক্ষত্রিয়ের পরম পুরুষার্থ ছিল এটাই যে, সে রাষ্ট্রের জন্য বলিপ্রদত্ত, যুদ্ধে যদি তাঁর মৃত্যু হয় তবে স্বর্গের দ্বার সামনে আপনিই খুলে যাবে—স্বর্গদ্বারম্ অপাবৃতম্। রাষ্ট্রের জন্য একটা যুদ্ধ সামনে এসে জুটেছে মানে তার চেয়ে বড় সুখ আর হতে পারে না—সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লক্ষন্তে যুদ্ধমাদৃশম্।
শেষোক্ত কথাটা ভগবদ্গীতায় কৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছিলেন, যদিও এটা জানি যে, ভাই-বেরাদরদের দেখে অর্জুন যেভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তাতে অর্জুনকে প্রথমে চাঙ্গা করে তোলাটাই প্রথম প্রয়োজন ছিল কৃষ্ণের, নইলে যুদ্ধে নিয়োগ করে একটা militancy তৈরি করাটা ভগবদ্গীতার ভাবনা নয়। যাঁরা সেটা বলেন, তাঁরা ভগবদ্গীতা কিছু বোঝেনই না। কিন্তু আমরা কথাটা তুলেছিলাম অন্য কারণে এবং সেটা হল—আমাদের দেশে যেহেতু জাতিবিভাগ একটা বড় ব্যাপার সেখানে ক্ষত্রিয় জাতিটাকে তৈরি করা হয়েছিল militancy ভাবনা দিয়ে। ফলত, যুদ্ধ করার জন্য ক্ষত্রিয়ের বীরমানিতাকে পুষ্ট করা হতো রাজ্যরক্ষা প্রজাপালন এবং নতুন ভূমিখণ্ড যুক্ত করার মন্ত্রে। আমরা এটাকেই এখনকার যুদ্ধ-কামনার অনুকূলে দেশাত্মবোধ তথা জাতীয়তাবাদের ‘অ্যান্টিসিডেন্ট’ বলি।
মহাভারতের কালে একটা রাজনৈতিক সমাজবোধ তৈরি হয়ে গিয়েছিল বলে যুদ্ধ পরিহার করার চেষ্টাটা তুঙ্গে গিয়ে পৌঁছেছিল। কুরুক্ষেত্রে একটা বিরাট যুদ্ধ হয়েছিল বটে, কিন্তু সে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য মহাবীর কৌরবদের বিপ্রতীপে মহাবীর পাণ্ডবদের প্রতিবাদ ছিল শৈশবকাল থেকে প্রায় প্রৌঢ় বয়স পর্যন্ত তাঁদের সহ্য করার ক্ষমতার মধ্যে। উদ্যোগ পর্বে যুদ্ধ না করার চেষ্টা আর ফলবতী হয়নি। কৌরব পক্ষের প্ররোচনা এবং war-mongering এতটাই চরমে ওঠে যে, যুদ্ধটা তখন ধর্মযুদ্ধ হয়ে ওঠে। ঘটনা এইরকম দাঁড়ায় যে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র পর্যন্ত বারবার তখন বলতে থাকেন যে যুদ্ধ করে কোনও লাভ নেই, কেননা যুদ্ধে যেহেতু স্বপক্ষ এবং পরপক্ষ দুই পক্ষেরই অনন্ত ক্ষয়ক্ষতি হয়, তাই যুদ্ধে জয় এবং পরাজয় দুইই সমান।
কিন্তু, ধৃতরাষ্ট্র এত জ্ঞানের কথা জানালেও তিনি কিন্তু পাণ্ডবদের প্রাপ্য রাজ্যাংশ ফিরিয়ে দেওয়ার নামও করেননি। অর্থাৎ তিনি প্রবঞ্চনা করেই যাবেন আর যুদ্ধবাজ দুর্যোধনকে বাঁচানোর জন্য যুদ্ধের ব্যাপারে ‘না’ বলছেন—এই প্রবঞ্চনাটাও যখন পরিষ্কার হয়ে গেল তখন কিন্তু যুধিষ্ঠিরের মতো ধর্মবুদ্ধি মানুষও সমস্ত ধৈর্য হারিয়ে ফেলছেন। বস্তুত এটাও একপ্রকার প্ররোচনা, যেখানে প্রতিপক্ষের কাছে প্রত্যাঘাত করাটা ভয়ংকরভাবে সত্য হয়ে ওঠে। কৌরব দুর্যোধন যেখানে যুদ্ধ ছাড়া কিছুই বুঝতে চাইছেন না, সেখানে যুধিষ্ঠিরের শান্তিচেষ্টাগুলিকেও তিনি দুর্বলতা বলে ব্যাখ্যা করছেন। বস্তুত দুর্যোধনের এই নীতিহীন যুদ্ধকামিতাই কিন্তু সেকালের ক্ষত্রিয়-জাতির মানস তৈরি করেছিল এবং সেই নীতিহীনতাকেই যখন কৌরব দুর্যোধন স্বঘোষিত ক্ষত্রিয়-জাতি গর্বকে দেশগর্বে পরিণত করে ধৃতরাষ্ট্রকে বলেন—বর্তমান সমস্ত পৃথিবী আমাদের হাতে—অসম্মৎ সংস্থা চ পৃথিবী—যত সব রাজারা সব আমার জন্য এসেছেন, তাঁরা সব আমার সুখেই সুখী, আমার দুঃখেই দুঃখী। আমার জন্য তাঁরা আগুনে ঝাঁপ দিতে পারেন, সমুদ্রেও প্রবেশ করতে পারেন।
এই যে দুর্যোধন সমস্ত ক্ষত্রিয় রাজাদের মধ্যে যুদ্ধের উন্মাদনা তৈরি করেছেন, ক্ষত্রিয়ের গৌরব এবং রাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধের যে প্রবৃত্তি তিনি তৈরি করেছেন—এইখানেই রাজনীতি ধর্ম এবং নৈতিকতাকে আক্রান্ত করে। উল্টো দিকটায় দেখুন, কৃষ্ণ যুধিষ্ঠিরের সম্বন্ধে বলেছিলেন—ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অধর্মভাবে দেবতাদের সমৃদ্ধ রাজ্যও আকাঙ্ক্ষা করেন না, নৈতিকতার প্রয়োজনে একটা গ্রামে থেকেও তিনি গ্রাম শাসনের দায়িত্ব নেবেন, তাও ঠিক আছে—‘অধর্ম যুক্তং ন চ কাময়েত রাজ্যং সুরান নপি ধর্মরাজঃ’। সত্যি বলতে কী, যুদ্ধ যাতে না লাগে সেজন্য যুধিষ্ঠির সন্ধির শর্ত কমিয়ে এনে নিজের পৈতৃক রাজ্য এবং তাঁর পূর্ব রাজত্ব ইন্দ্রপ্রস্থের অধিকার পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে পাঁচখানি গ্রামমাত্র চেয়েছিলেন দুর্ধোধনের কাছে। দুর্যোধন সেটা তো দেনইনি, বরঞ্চ তাঁর প্রাপ্য দাবি কমিয়ে আনার ঘটনাকে, অথবা যুদ্ধ পরিহার করার শান্তি প্রবৃত্তিকে দুর্যোধন পরিহাস করে বলেছেন—যুধিষ্ঠির কেমন ভয় পেয়েছে দেখেছ? আমি এবং আমার সৈন্যবাহিনী দেখে এতটাই ভয় পেয়েছে ব্যাটা, যে, এখন আর তার পূর্ব রাজ্য ইন্দ্রপ্রস্থ-পুরীর দাবি থেকে সরে এসে পাঁচখানি গ্রাম ভিক্ষা চাইছে—
যুধিষ্ঠিরঃ পুরং হিত্বা পঞ্চ গ্রামান্ চ যাচতে।/ ভীত হি মামকাৎ সৈন্যাৎ প্রভাবাচ্চৈব মে বিভো।।
আপন ক্ষমতার বলে বলীয়ান অহংকারী দুর্যোধনের মতো মানুষ যুদ্ধ-বিরোধী শান্তিকামী যুধিষ্ঠিরের মতো মানুষকে দুর্বল এবং ভীতু ভাবতে থাকেন। অথচ দুর্যোধনের এই ভাবনাটা জানা সত্ত্বেও যুধিষ্ঠির কিন্তু কিছুতেই দুর্যোধনের মতো যুদ্ধবাজ হয়ে উঠতে পারেননি। বিশেষত, রাজ্যভ্রষ্ট অবস্থায় নীতিপ্রবৃত্ত রাজনীতিকে দেশাত্মবোধে পরিণত করার সুযোগই তাঁর ছিল না। অন্যদিকে, যুদ্ধ জয় করার পরেও স্বজন-নিধনের ফলে যেহেতু প্রকৃত জয় সম্পন্ন হয় না, তাই যুদ্ধ ব্যাপারটাকেই যুধিষ্ঠির আমিষখণ্ড লাভের জন্য দুই পক্ষের কুকুর-লড়াই বলে মনে করেন যুধিষ্ঠির।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে গিয়েছে, যুধিষ্ঠির শত শত যুবকের জননীদের হাহাকার শুনেছেন এবং তাঁর সম্পূর্ণ ধিক্কার তৈরি হয়েছে ক্ষত্রিয় আচারের উপর—যাঁরা অকারণে যুদ্ধের আগ্রহ এবং আড়ম্বর তৈরি করেন। যুধিষ্ঠির বলেছেন—এই যুদ্ধ করে আমাদের কোনও অভিলাষ পূর্ণ হয়নি—আমি অভিমন্যুর মায়ের সামনে দাঁড়ার কী করে? আমি দ্রৌপদীর সামনে মুখ দেখাব কী করে? পাঞ্চালরা সব কোথায় গিয়েছেন? আমার অভিলাষ তাই পূর্ণ হয়নি স্বজন-বিহনে। আবার দুর্যোধনের অভিলাষও পূর্ণ হয়নি এতটুকুও—কাজেই এই যুদ্ধে আমরাও জয়ী হইনি, দুর্যোধনও জয়ী হননি—ন সাকামা বয়ং তে চ ন চাস্মাভির্ন তৈর্জিতম্। যুধিষ্ঠির মনের দুঃখে অর্জুনকে বলেছেন—এর থেকে আমি যদি দ্বারকায় গিয়ে ভিক্ষে করতাম, তাহলে এই জ্ঞাতিবধ আমাকে দেখতে হতো না। কৌরবদের কোনও প্রয়োজন তো মিটলই না মাঝখান দিয়ে আমরা নিজেরাই হত্যা করলাম বা করালাম। এটা কী ধর্ম হল, না নীতি হল—আত্মানমাত্মানা হত্বা কিং ধর্ম ফলমাপ্নুমঃ।
যুধিষ্ঠির কিন্তু এটাই বলতে চাইছেন যে নৈতিক দৃষ্টিতে যেটা ভুল সেটা কখনও রাজনৈতিকভাবে সঠিক হতে পারে না এবং এই রাজনৈতিক ভুলের জন্য তিনি একমাত্র দায়ী করছেন ক্ষত্রিয় আচারকে, ক্ষত্রিয়ের যুদ্ধ-বিষয়ক মানসিকতাকে। বলছেন—ধিক্কার দিই আমাদের এই ক্ষত্রিয় আচারকে, ধিক্কার দিই আমাদের বল এবং পৌরুষকে, ধিক্কার দিই সেই সমুদ্যত ক্রোধকে—যাতে আজ আমরা এক ধ্বংসের মুখে দাঁড়িয়ে আছি—ধিগস্তু ক্ষাত্রমাচারং ধিগস্তু বল-পৌরুষম্।
ক্ষত্রিয় আচারের দোষটা কেন? এইজন্য যে ক্ষত্রিয়ের বলাব্ধতাই যুদ্ধকে ত্বরান্বিত করে এবং ক্ষত্রিয়ের এই মহিমান্বিত গৌরবই কিন্তু বহুল মানুষকে এক আত্মা- রোপিত দেশাত্মবোধে প্রণোদিত করে। দুর্যোধন শান্তির বার্তা বয়ে-আনা অলৌকিক বুদ্ধিসম্পন্ন কৃষ্ণকেই কথা শুনিয়ে বলেছিলেন—কারও নরম-গরম কোনও কথা বা কোনও কাজে আমরা ভয় পেয়ে দেবরাজ ইন্দ্রের কাছেও মাথা নোয়াতে পারি না। আর কৃষ্ণ! তোমার তো ক্ষত্রিয়ধর্ম বলে কিছু নেই। আমরা আমাদের স্বধর্ম ক্ষত্রিয়ধর্ম অনুসারে চলি। তাতে যদি অকালে মরেও যাই তাহলে স্বর্গের পথ খোলা। আমরা শত্রুর কাছে অবনত হই না, যুদ্ধে মরলে আমরা যে বীরশয্যা লাভ করি বাণ-বিছানো ভূমিতে—যজ্জয়ীমহি সংগ্রামে শরতল্পগতা বয়ম্।
ক্ষত্রিয়বৃত্তির মধ্যে এই যে ‘মিলিটারিজম’-এর প্রচার, যেটা দেশগর্বের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে দুর্যোধন বলেন—এই যে এত শত মহাবীরেরা, এঁরা আমার জন্য জীবন দিয়েই রেখেছেন—অন্যেচ বহবঃ শূরা মদর্থে ত্যক্তজীবিতাঃ—এইসব জীবন-পণ করা ক্ষত্রিয় বীরদের কথা শুনলেই মনে হবে যেন এঁদের মতো মহান কেউ হতে পারে না, শত্রুবধের জন্য এঁরা প্রাণ পর্যন্ত দিতে প্রস্তুত। কিন্তু বাস্তবে এঁদের এই বলোদ্দৃপ্ত প্রচারই রাজাদের অহংকারী করে তুলত—যে অহংকারের কথা শুনলে মনে হবে যেন রাজ্যরক্ষার মতো মহদ্ বিষয়, প্রজাকল্যাণের মতো বিরাট কিছু সম্পন্ন করার জন্যই তাঁদের এই অহংকার এবং বলখ্যাপন। কিন্তু মহদাশয়তার জন্য হলেও এই বস্তুটা যেহেতু বলখ্যাপন এবং অহংকার, অতএব সেটা কখনওই নৈতিকতা এবং ধর্মের উপাদান হয়ে ওঠে না। হয়তো এই কারণেই মহাভারতে ব্রহ্মদত্ত-পূজনী সংবাদে পক্ষিণী পূজনী বলেছিল—সমস্ত মানুষের অপকারী ক্ষত্রিয়দের কখনও বিশ্বাস কোরো না—কেননা এরা সবসময় অপকার করেও ঠান্ডা মাথায় অনর্থক মধুর কথা বলে প্রলেপ দেবার চেষ্টা করে—আমাদের ভাষায় এটাই অনৈতিকতার ওপর রাজনৈতিক প্রলেপ—
ক্ষত্রিয়েষু ন বিশ্বাসঃ কার্য্যঃ সর্বাপকারিষু।/ অপকৃত্যাপি সততং সান্ত্বয়ন্তি নিরর্থকম্।।
ছবি: সংশ্লিষ্ট সংস্থার সৌজন্যে