পুরনো রোগ চাগাড় দেওয়ায় দেহকষ্ট ভোগ করতে হতে পারে। তীর্থ ভ্রমণ ও ধর্মকর্মে আত্মিক তৃপ্তিলাভ। ... বিশদ
তবে, এর মধ্যেই প্রত্যাশামতোই শুক্রবার রাতে দেশের মাটিতে ফিরে এলেন অভিনন্দন বর্তমান। নানান টালবাহানার পর আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে অভিনন্দনকে ভারতে ফেরত পাঠাতে বাধ্য হল পাকিস্তান। ভারতের সীমায় ঢুকে পড়া পাকিস্তানের এফ-১৬ কে তাড়া করে শত্রুপক্ষের ওই যুদ্ধবিমানকে ভূপতিত করার পর পাল্টা গুলির কারণে দুর্ঘটনার কবলে পড়েন ভারতীয় বায়ুসেনার এই বীর জওয়ান। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর প্রাণ রক্ষা হয়। তবে, তিনি পাকিস্তানের এলাকায় গিয়ে পড়ায় পাকবাহিনীর হাতে বন্দি হন তিনি। এই ঘটনা চাউর হতেই দেশ জুড়ে প্রবল উত্তেজনার সঞ্চার হয়। ভারত সরকার ও তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলি অভিনন্দনকে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ দিতে শুরু করে। দেশজনতা ও সোশ্যাল মিডিয়াও তাঁর মুক্তির দাবিতে রীতিমতো সরগরম হয়ে ওঠে। পাশাপাশি, যুদ্ধবন্দি ফাইটার পাইলট অভিনন্দনের সঙ্গে জেনেভা কনভেনশনের চুক্তিশর্ত অনুযায়ী যাতে ব্যবহার করা হয়—সে ব্যাপারেও পাকিস্তানের ইমরান সরকারের ওপর নানান কূটনৈতিক চাপও উত্তরোত্তর বাড়তে থাকে। আমেরিকা রাশিয়া ফ্রান্স জার্মানি সমেত বিশ্বের বড় বড় শক্তিধর রাষ্ট্র জঙ্গি দমনে পাকিস্তানের ভূমিকা সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করা শুরু করে। এমনকী সাম্প্রতিকের পাক বন্ধু চীনও ঠারেঠোরে বুঝিয়ে দেয় জঙ্গি সন্ত্রাস দমন প্রশ্নে তারাও ভারত ও তার বন্ধু রাষ্ট্রগুলির সঙ্গে একরকম সহমত।
পুলওয়ামা কাণ্ডের জেরে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সার্জিকাল স্ট্রাইকের প্রতিক্রিয়ায় প্রাথমিকভাবে কিছুটা হম্বিতম্বি করলেও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সম্মিলিত চাপের মুখে শেষ অব্দি পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে মুখে অন্তত আপস রফার অনুরোধ জানিয়ে সুর নরম করতে হয়। এবং, এমনকী তাঁর সেনার হাতে বন্দি বায়ুসেনা অভিনন্দনকে নিঃশর্তে অক্ষত শরীরে দ্রুত মুক্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিতে হয়। সেই প্রতিশ্রুতি মোতাবেক প্রায় ৬০ ঘণ্টা পর পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্তি পেয়ে দেশে ফেরেন অভিনন্দন। সামরিক কূটনৈতিক—উভয় দিক থেকেই নিঃসন্দেহে ভারতের এ এক বড় সাফল্য। কদিন আগে পুলওয়ামায় জম্মু-শ্রীনগর জাতীয় সড়কে সেনা কনভয়ে জয়েশ জঙ্গিদের আত্মঘাতী হামলায় ৪৪ জওয়ানের মর্মান্তিক নিধনের বদলায় সীমান্ত-সন্ত্রাস ও জঙ্গি তৎপরতা দমনে ভারতীয় সেনা যে প্রবল অভিযান শুরু করেছিল, বলা চলে, অভিনন্দনের মুক্তিতে তার একটি অধ্যায় যেন সমাপ্ত হল। আন্তর্জাতিক দরবারে ফের একবার ভারতের সেনা তাদের পরাক্রম শৌর্যবীর্যের স্বাক্ষর রেখে সমীহ ও স্বীকৃতি আদায় করে নিল। সেই সঙ্গে সীমান্ত সমস্যা সমাধান ও জঙ্গি সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানি দ্বিধা দৈন্যও যেন আর একবার বিশ্বের সামনে প্রকট হয়ে উঠল। একদিক থেকে এটা তো ভারতের সামরিক সাফল্য বটেই।
এবং গোটা দেশ জাতি ধর্ম বর্ণ রাজনীতি ভুলে সেনার এই সাফল্যকে অকুণ্ঠ স্বীকৃতি জানাতেও কসুর করেনি। আমাদের এই রাজ্যে তো বটেই, দেশের অন্যান্য রাজ্যেও পুলওয়ামার মর্মান্তিক কাণ্ডের পর থেকে ভারতীয় সেনার গৌরব গানে মেতে উঠেছে মানুষ, ক্ষোভ ফেটে ফেটে পড়েছে সন্ত্রাসী জঙ্গিদের আশ্রয়দাতা বলে ‘অভিযুক্ত’ প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে! ৪৪ জন বীর শহিদ সেনানীর প্রতি শ্রদ্ধায় মোমবাতি মিছিল করে, প্রতিবাদসভা করে অন্তরের শোক ক্ষোভ প্রকাশ করেছে দেশবাসী। দেশপ্রেমের এক প্রবল আবেগে উত্তাল হয়েছে আসমুদ্রহিমাচল। শুক্রবার অভিনন্দনের মুক্তির রাতে ওয়াঘা বর্ডারে জনতার ঢল ও উন্মাদনায় যে সেই আবেগেরই প্রমাণ মিলেছে, তা অস্বীকার করবেন কে?
কিন্তু, মুশকিলটা হল—পুলওয়ামা কাণ্ড থেকে ভারতীয় বায়ুসেনার সার্জিকাল স্ট্রাইক, পাক অধিকৃত কাশ্মীরে জঙ্গিঘাঁটি ও তিনশো-সাড়ে তিনশো জঙ্গি নিকেশ নিয়ে ইতিমধ্যেই বিরোধী রাজনৈতিক মহল সহ বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উঠেছে। সেসব নিয়ে কাগজে মিডিয়ায় জোর তর্ক-বিতর্কও হয়ে চলেছে সে কথা সকলেই জানেন। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও কিছু সঙ্গত প্রশ্ন তুলেছেন। পুলওয়ামা কাণ্ডে পাকিস্তান যোগের প্রমাণ চেয়েছেন, বায়ুসেনার সার্জিকাল স্ট্রাইকে জঙ্গিঘাঁটি ও তিন-সাড়ে তিনশো জঙ্গি নিধনের প্রমাণ দাবি করেছেন এবং করেছেন সঙ্গত কারণেই। কারণ, ইতিমধ্যেই এই বিষয়গুলো নিয়ে দেশের ও আন্তর্জাতিক মহলের আনাচেকানাচে অনুরূপ প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। পাকিস্তান সরকারও জঙ্গি নিধনে ভারতের দাবি নস্যাৎ করেছে। এবং এসব খবর সাধারণের মহলেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে, বহু জনমনেই একটা সন্দেহ সংশয়ের সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে এই সংশয়ে পড়ে ভাবতেই পারেন দেশের সরকার প্রতিবেশী দেশের প্রতি ভারতীয় জনসমাজের একটা বড় অংশের চিরাচরিত বিরাগ বাড়িয়ে তুলে সেনা জওয়ানদের কৃতিত্ব ফাঁপিয়ে ধরে দেশভক্তির আবেগে দেশের মানুষকে বাদবাকি সব সমস্যা ভুলিয়ে দিতে চাইছেন। উদ্দেশ্য, আসন্ন লোকসভা ভোটে রাজনৈতিক ফায়দা লাভ। আর এক্ষেত্রে এই ভাবনা ও সংশয়ে ইন্ধন জোগাচ্ছে পুলওয়ামা কাণ্ড ও তার প্রতিক্রিয়ায় একের পর এক ঘটতে থাকা উত্তেজনাকর ঘটনাক্রমের সময়কাল। দেশের প্রথম বিজেপি প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ির আমলে যেমন কার্গিল, বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির জমানায় তেমনি কি পুলওয়ামা ইত্যাদি— সন্দেহ বাড়ছে। রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞদের কেউ কেউ আবার বলেই ফেলছেন—রাফাল সমেত সবকিছু উড়িয়ে মোদিজির দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার রাস্তা মোটামুটি তৈয়ার করে দিয়ে গেল পুলওয়ামা! কিন্তু, সত্যিই কি তাই? ভারত-পাক যুদ্ধ পরিস্থিতি আসন্ন ভোটযুদ্ধে মোদিজিকে কি সত্যিই এগিয়ে দিল?
দেশভক্তি, দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ ইত্যাদি আবেগ যে গেরুয়া শিবিরের প্রচার প্রতিষ্ঠার অন্যতম হাতিয়ার তা এখন সকলেই জানেন। এই আবেগ ‘জাগাতে’ ইতিমধ্যেই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অনেক অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেছে। সেসবের জেরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পরিবেশ বজায় রাখতে বহুক্ষেত্রেই হিমশিম খেয়েছেন সংশ্লিষ্ট এলাকার মানুষজন। কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাবলি, ৪৪ শহিদসেনা, তার পাল্টায় ভারতীয় বাহিনীর সামরিক তৎপরতা দেশের মানুষের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্ত দেশপ্রেমের যে আবেগ সঞ্চার করেছে—তাকে আসন্ন ভোটযুদ্ধে ব্যবহার করতে শাসক পদ্মশিবির যে আগ্রহী হবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই মত রাজনৈতিক তথ্যভিজ্ঞদের অধিকাংশের। তাঁদের বক্তব্য, এর মধ্যেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিজির নানা বক্তৃতা ও মন্তব্যে তার আভাস মিলেছে। পুলওয়ামার পরিপ্রেক্ষিতে সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় সার্জিকাল স্ট্রাইক সহ যাবতীয় অভিযান নিয়ে তাঁর ‘পাইলট প্রজেক্ট’ ও ‘মূল প্রজেক্টে’র মতো মন্তব্যগুলিকে তার প্রমাণ হিসেবে দাখিল করছেন তাঁরা। তাঁরা বলছেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশের সাধারণ জনমতের একটা অংশে যে চিরকালীন বিরাগ ও উষ্মা তাকেও নানাভাবে উস্কে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। তাতে ভোট রাজনীতিতে হয়তো ফায়দা কিছু মিলবে, তবে এতে দেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ধর্মনিরপেক্ষতার সুদৃঢ় ভিতে টান পড়ার সম্ভাবনাও থাকছে!
আজ এই উনিশ সালে দাঁড়িয়ে যুদ্ধ পরিস্থিতি আর দেশপ্রেমের আবেগ হাতিয়ার করে ভোটযুদ্ধে বাজিমাত কতটা সম্ভব তা নিয়ে অবশ্য অনেকের মতো আমাদেরও সংশয় আছে। বিশেষ করে যে সরকারের আমলে নোটবন্দি নীরব-মালিয়া-চোকসি ব্যাঙ্ককাণ্ড সিবিআই-আরবিআই কর্তাবিরোধ থেকে রাফালের মতো চাঞ্চল্যকর এবং একই সঙ্গে জন-আশাভঙ্গের ঘটনা ঘটেছে তার ক্ষেত্রে কেবল দেশপ্রেমের মলমে বাকি কদিনে সব ক্ষত মুছে যাবে— এমনটা সহজে ভেবে ওঠা সহজ নয়। লক্ষ করুন, এই রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে লোকসভা ভোটে ৪২-এ ৪২ দাবি করছেন তা কিন্তু কোনও সস্তা সেন্টিমেন্টকে হাতিয়ার করে নয়—ব্যাপক উন্নয়ন, জনকল্যাণ ও মা-মাটি-মানুষের প্রতি তাঁর একনিষ্ঠ দায়বদ্ধতাকে পুঁজি করে। মমতার প্রতি বাংলার মানুষের বিশ্বাস শ্রদ্ধা ও আস্থার ভিত্তিও তাই। একসময় মোদিজি ও তাঁর দলও মানুষের এমন শ্রদ্ধা ও আস্থা পেয়েছিলেন। কিন্তু, গত পাঁচ বছরের নানা অপ্রীতিকর ঘটনা জনমনে সেই আস্থার ভিতটাকেই তো দুর্বল করেনি, দেশ জুড়ে গেরুয়া বাহিনীর প্রতি প্রবল এক বিরূপতাও তৈরি করেছে। এখন আসন্ন লোকসভা যুদ্ধের আগে কাশ্মীরের পুলওয়ামা ও ভারতীয় সেনার অসাধারণ কৃতিত্ব সেই বিরূপতাকে কতটা মুছে দিতে পারে—এখন সেটাই দেখার।