দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
তিন অক্ষরের নেতাজি শব্দটি নিজেই স্বয়ং প্রকাশ। যেখানে শুদ্ধাভক্তিই শেষ কথা। আত্মগরিমাক্লিষ্ট কোনও কলঙ্কবান তাঁকে স্পর্শ করতে পারে না। তাঁর অর্নিবাণ জ্যোতির্ময় জীবন জড়তাগ্রস্ত জাতিকে অগ্নিশুদ্ধ, অগ্নিময় করে তুলতে পারে তার প্রমাণ আজাদ হিন্দ মুক্তি আন্দোলনের রক্তাক্ত আত্মদানের ইতিহাস। যুদ্ধবন্দি, রাজবন্দিদের হঠাৎ রাজবিদ্রোহী হয়ে ওঠার নেপথ্যে ছিল নেতাজির সেই সর্বত্যাগী আহ্বান। যে প্রেরণার তূর্যনাদে আর ঘুমভাঙানিয়া সুরে সারা ভারতে বিদ্রোহের আগুন তাড়া করেছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অনুচরদের। শাসকদের কাছে যুগে যুগে তিনি ব্রাত্য হলেও দেশপ্রেমিক হৃদয়ে তিনি পরম ভালোবাসার সম্পদ। পরাধীন দেশের সেই সন্ন্যাসী দেশনায়ককে দশকের পর দশক আড়ালে রেখে, মুক্তি ইতিহাসের ভিন্নগান গেয়ে স্মৃতি খুঁজে ফেরার ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছে।
নেতাজির ভারত সাধনাপর্বে কোনও কৃত্রিম খণ্ডিত চিন্তার স্থান হয়নি। ভারতমায়ের দাসত্ব মুক্তিযজ্ঞে তাই হিন্দু মুসলিম শিখইশাইদের আলাদা করে শনাক্তকরণের দরকার হয়নি। আজাদি-দধীচিদের তাজা বুকের রক্তে ভারতে প্রবেশপথের পার্বত্যভূমি ভিজে গিয়েছিল। যশোরের ঝিকোরগাছার কপোতাক্ষ নদী, প্রাচীন বৃক্ষগুলি মৌনমুখর হয়ে আজও সাক্ষী দেয় নেতাজির দামাল সেনাদের ওপর কী ভয়ানক অত্যাচার করে খুন করা হয়েছিল। এপার বাংলার ব্যারাকপুর নীলগঞ্জের সাহেববাগানের বন্দিশিবিরে শতশত নিরস্ত্র আজাদি সেনাদের রাতের অন্ধকারে ব্রিটিশ বুলেট ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। রক্তে ভেসে গিয়েছিল লাগোয়া লাবণ্যবতী নদী যা আজও নোয়াই খাল নাম নিয়ে নীরবে বয়ে চলেছে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তাঁরা স্বজনদের থেকে হারিয়ে গেলেন চিরদিনের জন্য। তাঁদের স্মৃতিকে বর্তমান ও আগামীর জন্য অক্ষয় রাখতে আজ পর্যন্ত কোনও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়নি। নেতাজি ফাইলের বদান্যতায় হাজার হাজার আজাদি শহিদের যে তালিকা মিলেছে তা এখনও অসম্পূর্ণ। অখণ্ড দেশ ও সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে উঠতে পারত শহিদদের নাম-শোভিত আজাদিসৌধ। বাপুজির ‘প্রিন্স অব প্যাট্রিওস্’-এর জন্য এটুকু কি অসম্ভব ছিল!
ফিরে যাই কবিগুরুর ‘নিরুদ্দেশের পথিক’, তাঁর দেশনায়ক সুভাষচন্দ্রের কৈশোরের এক টুকরো চিঠির প্রসঙ্গে। কটক থেকে তাঁর মা প্রভাবতীদেবীকে লিখেছেন যে, ভারতবর্ষ ভগবানের বড় আদরের দেশ। যুগে যুগে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তিনি অবতাররূপে অবতীর্ণ হন।
নেতাজির প্রতি দেবত্ব ‘আরোপে’ অনেক শুষ্ক রাজনীতিক বুদ্ধিজীবী ছুঁৎমার্গে ভুগে থাকেন। লিখিত মানবসভ্যতার ইতিহাসে এমন মঙ্গলজনক আবির্ভাবকে আলাদা করে অবতাররূপে চিহ্নিত করার কৃত্রিম প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় না। তাঁর কর্মে, ধ্যানে, মননে মনীষায় তিনি অনন্য। বিবেক বাণীর সজীবভাষ্য তিনি, স্বামীজি-নিবেদিতার ভারত সাধনার মূর্তপ্রতীক তিনি, তাই তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী প্রকৃত অর্থেই ভারতপথিক।
মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদোয়ারে ভক্তের উপাসনায় তাঁদের চিত্ত শুদ্ধির পথ প্রশস্ত হয়, সঠিক জীবনবোধে উদ্বুদ্ধ হয় তাদের সমাজ। ভারতের সমাজ-জীবনেও আজ প্রয়োজন দেখা দিয়েছে নেতাজির সর্বধর্মসমন্বয়ের আদর্শের উপাসনার। তাঁর আদর্শের মর্মবাণী ভারতের সমাজের গভীর শিকড়ে আবদ্ধ। বিচ্ছিন্ন, বিজাতীয় ও অগভীর ভাবনায় তাঁকে সর্বস্তরে আড়াল করে আত্মমগ্ন স্বার্থসর্বস্ব সমাজ বিস্তারে—মদত চলেছে এতকাল। ত্যাগব্রতী, সেবাব্রতী সুভাষচন্দ্র হারিয়ে গিয়েছেন পাঠ্যে, বিকৃত ইতিহাসে, সিনেমা-সিরিয়ালের অপটু নির্মাণে। তরুণের স্বপ্নের নায়ক সেদিন যথার্থই ডাক দিয়েছিলেন ‘আমার জীবন লভিয়া জীবন জাগোরে সকল দেশ।’
দেশে একদা কোনও কোনও রাজনৈতিক নেতা, বড় অভিনেতা ভক্তকুলের মাধ্যমে নিজেরা ‘নেতাজি’ ডাক শুনতে ভালোবাসতেন কিংবা ভালোবাসেন আজও। আমাদের ঘরের নেতাজিকে ভুলে অনেক বিদেশি নেতার ছবি পোশাকে মুদ্রিত করে প্রগতিশীল প্রমাণের আপ্রাণ প্রচেষ্টা কোনও কোনও রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে দেখা যায়। জীবনের সকরুণ সবুজ ডাঙায়, যেখানে জলের গতি স্পর্শ করে সততা, বীরত্ব, ত্যাগ, সেবাব্রত ও দেশপ্রেমের আগুনে প্রজ্বলিত পঞ্চপ্রদীপকে, সেই শক্ত জমির হৃদাসনে আরাধ্য করেছে একজনকেই। তিনি এই বাংলার ঘরের ছেলে সুভাষ, চিরকালের নেতাজি।
লেখক নেতাজি গবেষক