দীর্ঘমেয়াদি সঞ্চয় ও ব্যবসা থেকে অর্থাগম যোগ। প্রেমের প্রস্তাব পেতে পারেন। পুজো পাঠে মন। ... বিশদ
রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে ভারতের দুই বৃহৎ দলের বাগবিতণ্ডা দেখে নিশ্চিত মজা কুড়চ্ছে পাকিস্তান! হবেই বা না কেন? ‘সাপে-নেউলে’ শব্দ যুগলের সমার্থক শব্দ হয়তো ভারত-পাকিস্তানকেই মানায়।
অবিরত যুদ্ধ কখনও রাষ্ট্রীয় নেতাদের মুখের ভাষায়, কখনও আবার সীমান্তে দুই দেশের সেনাদের মধ্যে। ভারত-পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে এখনও পর্যন্ত মোট তিনবার যুদ্ধে জড়িয়েছে দুই দেশ। ১৯৪৮,১৯৬৫ এবং ১৯৯৯ সালে যুদ্ধে ল্যাজেগোবরে হয়েছে পাকিস্তান। এখনও প্রতিনিয়ত সীমান্তে লড়াই চলছে। সীমান্তে সেনা হত্যা করার কারণে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ বেঁধে যাওয়ার পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছিল। দক্ষিণ এশিয়ার পরমাণু শক্তিধর রাষ্ট্র দু’টির মধ্যে যদি ফের যুদ্ধ লেগে যায় তাহলে কোন পক্ষ এগিয়ে থাকবে সেটা নিয়েও গোটা দুনিয়ার কৌতূহলের শেষ নেই। কে না জানে, যে দেশের অস্ত্রভাণ্ডার যত বেশি আধুনিক, উন্নত এবং যত বেশি সমৃদ্ধ সেই দেশ যুদ্ধের ময়দানে এগিয়ে থাকবে। ফলে অস্ত্রভাণ্ডার মজবুত করার লক্ষ্যে ফ্রান্স, রাশিয়া, ইজরায়েল, আমেরিকায় ছুটে যাচ্ছে ভারত। হাত গুটিয়ে বসে নেই পাকিস্তানও। প্রতিযোগিতা টিকিয়ে রাখতে ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়েছে চীন।
সম্প্রতি বায়ুসেনা প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল বি এস ধানোয়াও সতর্ক করে বলেছিলেন, ভারতের মতো চাপে বিশ্বের আর কোনও দেশ নেই। দুই পরমাণু শক্তিধর প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছে। আমাদের প্রতিপক্ষের মেজাজ-মর্জি রাতারাতি বদলে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে শক্তিতে প্রতিপক্ষরা যেন ভারতকে ছাপিয়ে না যায় তারজন্য আমাদের প্রস্তুত থাকতে হবে। বলা বাহুল্য এ ক্ষেত্রে পাকিস্তান ও চীনের কথাই বলতে চেয়েছেন ধানোয়া। রাফাল নিয়ে তাঁর বক্তব্য, ‘ভারতের হাতে এই যুদ্ধবিমান এলে উপমহাদেশে খেলা ঘুরে যাবে। এ ধরনের হাই-টেক যুদ্ধবিমান খুবই প্রয়োজন। কারণ, শুধু মিডিয়াম-টেক তেজসকে দিয়ে আর কাজ চালানো যাবে না।’ ধানোয়ার কথায়, চীন খুব দ্রুত তার দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের যুদ্ধবিমানগুলিকে চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তিতে উন্নত করে ফেলছে। বানাচ্ছে পঞ্চম প্রজন্মের যুদ্ধবিমান, যেগুলি খুব শীঘ্রই চীন তার বিমানবাহিনীতে নিয়ে আসবে। ফলে, সীমান্তে আমাদের উদ্বেগটা বেড়ে গিয়েছে। ৩৬টি ফরাসি ‘রাফাল’ যুদ্ধবিমান ও রুশ ‘এস-৪০০’ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধী ব্যবস্থা ভারতীয় বিমানবাহিনীতে এলে দুই শক্তিধর প্রতিবেশীর কাছ থেকে সম্ভাব্য হামলা মোকাবিলার জন্য অন্তত প্রস্তুত থাকা যাবে।
উপমহাদেশের পরিস্থিতি এখন যে রকম, তাতে খুব দ্রুত ভারতীয় বায়ুসেনার সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি বলে বিশেষজ্ঞদের মত। চীন-পাকিস্তানের যৌথ শক্তির মোকাবিলা যদি ভারতকে করতেই হয়, তা হলে খুব দ্রুত যুদ্ধবিমানের সংখ্যা বাড়ানো দরকার। বায়ুসেনার প্রাক্তন প্রধান অরূপ রাহাও উদ্বেগ জানিয়ে বলেছেন, ‘রাজনীতিকরণে আটকে দেশের সামরিক শক্তিবৃদ্ধি।’ রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা মিগ-২১,মিগ-২৭ যুদ্ধবিমানগুলিকে যে ভাবে ধাপে ধাপে বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তাতে গত কয়েক বছরে বেশ দ্রুতই কমেছে যুদ্ধবিমানের সংখ্যা। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা হ্যাল ‘তেজস’ নামে একটি লাইট কমব্যাট এয়ারক্র্যাফ্ট তৈরি করেছে। তেজস অনেক ক্ষেত্রেই মিগ বিমানগুলির স্থান নিতে পারে। কিন্তু যে সংখ্যক যুদ্ধবিমান যে সময়সীমার মধ্যে বায়ুসেনা চাইছে, ততটা তাড়াতাড়ি অতগুলি তেজস তৈরির সক্ষমতা হ্যালের নেই। তাই অত্যাধুনিক রাফালেই আস্থা রাখতে বাধ্য হয়েছে নয়াদিল্লি।
আর সেই রাফাল চুক্তির পরই পাক প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি এক ভাষণে দাবি করেছিলেন, ভারতীয় বাহিনীতে নানা মারণাস্ত্রের অন্তর্ভুক্তি ঘটছে এবং পাকিস্তানের প্রতি ভারতের আচরণ আক্রমণাত্মক। বেশ কয়েকটি রাষ্ট্র ভারতের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করছে এবং পরমাণু প্রযুক্তি ও অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম ভারতকে হস্তান্তর করছে। এতে দক্ষিণ এশিয়ায় শক্তির ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে পড়ছে বলেও প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি দাবি করেছিলেন। এই দাবির পর প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক, পাকিস্তান কি তবে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে? যদি না হয়, তা হলে তৃতীয় কোনও দেশের সঙ্গে ভারতের সামরিক চুক্তি নিয়ে পাকিস্তান বিচলিত বোধ করছে কেন? ভারতের আচরণকে ‘আক্রমণাত্মক’ই বা ভাবছে কেন?
পাকিস্তান কি তবে হাত গুটিয়ে বসে রয়েছে?
ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বলছে, রাফাল চুক্তি যখন ভারতীয় রাজনীতির উত্তাপ বাড়াচ্ছে, ঠিক তখনই নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়ানোর বিপুল পরিকল্পনা করে ফেলেছে পাকিস্তান। কেউই হাত গুটিয়ে বসে নেই। পাকিস্তান তাদের ‘এফ-১৬’ যুদ্ধবিমানগুলিকে আরও উন্নত করেছে। ঢেলে সাজিয়েছে ওই বিমানগুলির ইলেকট্রনিক ব্যবস্থাকে। গোয়েন্দা রিপোর্ট জানিয়েছে, ভারতীয় বাহিনীতে ৩৬টি রাফায়েল জেট যুক্ত হওয়ার আগেই পাকিস্তান ৬২টি জেএফ-১৭ যুদ্ধবিমান তাদের বিমানবাহিনীতে যুক্ত করতে চাইছে। পাকিস্তানের জেএফ-১৭ বহুমুখী যুদ্ধবিমান যৌথভাবে তৈরি করছে পাকিস্তানের অ্যারোনটিক্যাল কমপ্লেক্স এবং চীনের চেংদু এয়ারক্র্যাফট কর্পোরেশন। পাক বিমানবাহিনী যাতে ভারতীয় বিমানবাহিনীর সমকক্ষ হতে পারে, সে জন্য জেএফ-১৭ সিরিজের সবচেয়ে আধুনিক জেএফ-১৭ (ব্লক-৩) বিমানবাহিনীতে সংযুক্ত করতে চাইছে তারা। গোয়েন্দা রিপোর্ট অনুযায়ী, পাকিস্তান ও চীন যৌথভাবে জেএফ-১৭ (ব্লক-৩) বিমান উদ্ভাবনের জন্যও কাজ করছে, যা হবে চতুর্থ প্রজন্মের বিমান।
গত বছর অক্টোবরে রাশিয়ার সঙ্গে পাঁচ বিলিয়ন ডলারের এস-৪০০ চুক্তি করে ভারত। চুক্তি অনুযায়ী আগামী দুই বছরের মধ্যে ভারতের কাছে এস-৪০০ হস্তান্তর করা হবে। স্বাভাবিকভাবেই তা পাকিস্তানের জন্য উদ্বেগ তৈরি করেছে। কারণ, ভারত এস-৪০০ সিস্টেমের পাঁচটি ইউনিট কিনতে চলেছে। এগুলোর মধ্যে তিনটি পাকিস্তান সীমান্তে এবং দুটি চীন সীমান্তে মোতায়েন করা হবে। তার পাল্টা হিসেবে, পাকিস্তান এমআইআরভি (মাল্টিপল ইন্ডিপেনডেন্টলি টার্গেটেবল রি-এন্ট্রি ভেহিক্যাল) তৈরি করেছে। যেটা ব্যবহার করে একটি মিসাইল থেকে একাধিক ওয়্যারহেড নিক্ষেপ করা যায়। ইতিমধ্যে পাকিস্তান সার্ফেস টু সার্ফেস ব্যালিস্টিক মিসাইল আবাবিলের সফল পরীক্ষা করেছে। যেটা একইসঙ্গে একাধিক ওয়্যারহেড ছুঁড়তে পারে। তাছাড়া, পাকিস্তান আজম প্রকল্পের অধীনে চীনের সঙ্গে যৌথভাবে পঞ্চম প্রজন্মের স্টেলথ বিমান তৈরির কাজ করছে। এই বিমানগুলোতে রাডারে ধরা পড়বে না, তাই এস-৪০০ সিস্টেম সেখানে কাজ করবে না।
এখানেই শেষ নয়! সাংহাইয়ের হুডং-ঝোংহুয়া শিপইয়ার্ডে পাক নৌবাহিনীর জন্য যে চারটি নতুন ফ্রিগেট তৈরি হচ্ছে, সেগুলোতে ওয়াইজে-১২ মিসাইলের সিএম-৩০২ ভার্সানগুলো ব্যবহার করা হবে বলে জানা গিয়েছে। সিএম-৩০২ সুপারসনিক গতিতে ছুটতে পারে। আবার রেঞ্জের দিক থেকেও ভারতীয় নৌবাহিনীর ব্রাহ্মস জাহাজ-বিধ্বংসী ক্রুজ মিসাইলের সমান পর্যায়ে রয়েছে এটি। চীনের নির্মিত নতুন ফ্রিগেটে সিএম-৩০২ মিসাইল থাকার অর্থ হল, পাক নৌবাহিনীর একটা নতুন মারণাস্ত্র অর্জন করা।
ভারতের সঙ্গে একের পর এক বৃহৎ শক্তি যে ভাবে চুক্তিবদ্ধ হচ্ছে, ভারতের সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণ যে ভাবে ঘটছে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতের গুরুত্ব যে ভাবে বাড়ছে, তাতে পাকিস্তান কতটা শিহরিত, তার প্রমাণ মেলে বিপুল অস্ত্রভাণ্ডারের তালিকা দেখলেই। গোয়েন্দা সংস্থার রিপোর্ট বলছে, ইসলামাবাদ প্রায় ৬০০ যুদ্ধ ট্যাঙ্ক কিনতে চলেছে, যার মধ্যে অত্যাধুনিক রাশিয়ান টি-৯০ ট্যাঙ্কও রয়েছে। পাকিস্তানের নতুন ট্যাঙ্কগুলোতে অত্যাধুনিক ফায়ারিং নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম থাকবে যেগুলো দিয়ে আরও নিখুঁতভাবে চার কিলোমিটার দূরত্বের মধ্যে টার্গেটকে আঘাত হানা যাবে। ইতালির কাছ থেকেও ২৪৫টি মাইক-১০ ১৫০ মিলিমিটারের এসপি কামান কেনার পরিকল্পনাও রয়েছে। প্রথম সারির প্রতিরক্ষা ফার্মগুলোর কাছ থেকে ৩৬০টি যুদ্ধ ট্যাঙ্ক কেনা ছাড়াও পাকিস্তান চীনের সহায়তায় নিজস্বভাবে আরও ২২০টি ট্যাঙ্ক তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে সামরিক বাহিনীর অস্ত্র সম্ভারকে সমৃদ্ধ করার অংশ হিসেবে এই পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু রাফাল যুদ্ধবিমান কেনা নিয়ে তীব্র বাগবিতণ্ডা ভারতের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির গতিতে জোর ধাক্কা দিয়েছে। ভারত এবং ফ্রান্সের কৌশলগত সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। নিশ্চিত তা তাড়িয়ে তাড়িয়ে ‘উপভোগ’ করেছে ইসলামাবাদও।
অভিজাত পরমাণু ক্লাব বা এনএসজি-তে অন্তর্ভুক্তি থেকে পরমাণু চুক্তি, দীর্ঘদিনের প্রতিরক্ষা সম্পর্ক বহাল রাখা, বিনিয়োগ, ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারতকে মজবুত করা—সর্বত্রই ফ্রান্স নিঃশব্দে পাশে থেকেছে ভারতের। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক বিতর্কে নয়াদিল্লিকে সমর্থন করেছে প্যারিস। ভূকৌশলগত রাজনীতিতে প্রতিবেশী রাষ্ট্র, বিশেষ করে চীন এবং পাকিস্তানের প্রবল চাপকে হজম করে পায়ের তলায় জমি শক্ত করা সম্ভব হয়েছে অনেকটাই ফ্রান্সের জন্য, এমনটাই মনে করেন কূটনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে ফরাসি বিমান কেনাবেচায় দুর্নীতির প্রসঙ্গ তুলে মোদি সরকারকে কোণঠাসা করে প্রচার চালাবে বিরোধী দলগুলি। কিন্তু ভোটের রাজনীতির এই দাপটে ক্রমশ রাহুগ্রস্ত হবে ভারত-ফ্রান্স দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক, যা এই মুহূর্তে অন্যতম দামি সাউথ ব্লকের কাছে। এমনটাই মনে করছে কূটনৈতিক শিবির। তাছাড়া, ভারত মহাসাগরে নয়াদিল্লির সক্রিয়তা খর্ব করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে চীন। নিজের আধিপত্য ধরে রাখতে ফ্রান্সের মত অংশীদার রাষ্ট্রের প্রয়োজন ভারতের। ফলে রাফাল নিয়ে বিতণ্ডা ভারতের জন্য আদৌ সুখকর নয়।